ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজ জাতির ইতিহাস

বাংলার মত ইংরেজিও ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষাগোষ্ঠীর জার্মানিয় শাখার পশ্চিম অঞ্চলের একটি ভাষা। উৎস বিচারে ইংরেজি ভাষাটির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ভাষাটি হল ফ্রিজিয় ভাষা। এছাড়া এটির সাথে ওলন্দাজ ভাষা, ফ্লেমিশ ভাষা (বেলজিয়ামে প্রচলিত ওলন্দাজ ভাষার উপভাষা) ও নিম্ন জার্মান উপভাষাগুলির সম্পর্ক আছে। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের দক্ষিণাংশে অবস্থিত ইংল্যান্ড নামক দেশটিতে খ্রিস্টীয় ৫ম-৬ষ্ঠ শতকে ইংরেজি ভাষার জন্ম হয়। বর্তমানে এটি যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ক্যারিবীয় সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে ছড়িয়ে থাকা অনেক দ্বীপরাষ্ট্রের প্রধান ভাষা। ইংরেজি প্রায় ৩৮-কোটি মানুষের মুখের মাতৃভাষা। মাতৃভাষিক বক্তাসংখ্যার বিচারে এর অবস্থান বিশ্বে ৩য় ভাষা!
:
ইংরেজি এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুর এবং আফ্রিকার সাব সাহারা-নিম্ন অঞ্চলের অনেক রাষ্ট্রের (বিশেষ করে নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার) সরকারি ভাষা। ইংরেজি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অধীত দ্বিতীয় ভাষা। প্রায় ৩০ থেকে ৫০ কোটি লোক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে অনর্গল ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারেন। সব মিলিয়ে মাতৃভাষি নন এরকম ৭৫-কোটি মানুষ বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষাতে কথা বলতে পারেন। আধুনিক ইলেকট্রনিক, টেলিযোগাযোগ ও কম্পিউটার প্রযুক্তি, বিশ্ববাণিজ্য ও কূটনীতির প্রধান ভাষা হিসেবে ইংরেজি গোটা বিশ্বের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। ধারণা করা হয় বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ লোক অর্থাৎ প্রায় ২০০ কোটি লোক ন্যূনতম বা তার চেয়ে বেশি দক্ষতার ইংরেজি বলতে পারে। অনেকে তাই ইংরেজি ভাষাকে বর্তমান বিশ্বের “লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা” মনে করে থাকেন।
:
জার্মানিয় গোত্র অ্যাংগল্‌স, স্যাক্সন ও জুটদের ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষার উৎপত্তি। এই গোত্রগুলি ৪৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ ও পূর্ব উপকূলে পা রাখে এবং সেখানকার কেল্টীয় ভাষাভাষি আদিবাসিদের উত্তরে ও পশ্চিমে স্কটল্যান্ড, কর্নওয়াল, ওয়েল্‌স ও আয়ারল্যান্ডে হটিয়ে দেয়। এই হানাদার জার্মানিয় গোত্রগুলির মুখের ভাষাই প্রাচিন ইংরেজি ভাষার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। ৬০০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ জার্মানিতে প্রচলিত উচ্চ জার্মান উপভাষাগুলিতে দ্বিতীয় বারের মত ব্যঞ্জনধ্বনি সরণ ঘটে। কিন্তু উত্তর জার্মানিতে প্রচলিত নিম্ন জার্মান উপভাষাগুলিতে ও ওলন্দাজ ভাষায় দ্বিতীয়বারের মত ব্যঞ্জনধ্বনি সরণ ঘটেনি (এদের সাথেই ইংরেজির সবচেয়ে বেশি মিল দেখা যায়); এদের মত ইংরেজিতেও দ্বিতীয় ধ্বনি সরণ ঘটেনি। পরবর্তীতে ৮ম ও ৯ম শতকে নরওয়েজীয় ভাইকিং হানাদারদের প্রাচিন নর্স ভাষাও প্রাচীন ইংরেজিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
:
১০৬৬ সালে উত্তর ফ্রান্সের নরমঁদি অঞ্চলে বসবাসকারী নর্মান জাতি ইংলিশ চ্যানেল নামক সমুদ্র প্রণালি পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমণ করে। নর্মানদের ইংল্যান্ড বিজয়ের পর প্রায় ৩০০ বছর ধরে ইংল্যান্ডের রাজারা ছিলেন নর্মান বংশোদ্ভূত এবং এসময় রাজকিয় ও প্রশাসনিক কাজকর্ম কেবল নর্মানদের কথ্য এক ধরনের প্রাচীন ফরাসি ভাষায় সম্পন্ন হত। এই যুগে বিপুল পরিমাণ ফরাসি শব্দ প্রাচীন ইংরেজি ভাষায় আত্মীকৃত হয়ে যায়, ইংরেজি ভাষার বেশির ভাগ বিভক্তি লুপ্ত হয় এবং ফলস্বরূপ মধ্য ইংরেজি ভাষার আবির্ভাব ঘটে। প্রাচীন ও মধ্য ইংরেজির সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের মধ্যে আছে বেওউল্‌ফ এবং চসারের দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস।
:
১৫০০ সালের দিকে বৃহৎ স্বরধ্বনি সরণ সংঘটিত হয় এবং আধুনিক ইংরেজি ভাষার উদ্ভব ঘটে। শেক্‌সপিয়ারের রচনাসহ আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের পুরোটাই এই আধুনিক ইংরেজিতে লেখা। ভাষা-গবেষণার আকরগ্রন্থ এথ্‌নোলগ অনুসারে ইংরেজি ভাষার মাতৃভাষির সংখ্যা প্রায় ৩৪-কোটি। মাতৃভাষির সংখ্যা অনুযায়ি ইংরেজির স্থান ম্যান্ডারিন, হিন্দি ও স্পেনীয় ভাষার পরেই।
:
ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষার চেয়ে খুব একটা প্রাচীন নয় । তেরোশো শতাব্দির পর হাতে লেখা বাংলা দিয়ে যখন টুকটাক দলিল, রাজ্ হুকুম জারির নামে আহাজারি এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত রচনা হতো, সেই সময় থেকে ইংরেজি ভাষায় তিনটি মৌলিক পরিবর্তন হয়, যা তাকে বর্তমান আন্তর্জাতিক ভাষা করেছে ।
এক] Geoffrey Chaucer ; দুই] Shakespeare; তিন] Bible
এক] Geoffrey Chaucer
চোদ্দোশো শতাব্দীতে Canterbury Tales সহ আরো কিছু লেখা লিখেন চসার, যা পুরো ইংরেজি ভাষার খোল পরিবর্তন করে দেয় । ইংরেজি লেখার আলাদা একটি রূপ দেন তিনি এবং চসারের পদ্যের হাত ধরে তা আসে । ইংরেজির বর্তমান রূপটির জন্ম হয় এমন করে সাতশো বছর আগে । পনেরোশো শতাব্দি জুড়ে চসারের পদ্যের হাত ধরে গদ্য লেখার পটভূমি তৈরী হয় ধীরে ধীরে । পনেরোশো শতকে ইউরোপের জার্মানে একটি পরিবর্তন আসে : গুটেনবার্গের প্রেস ! বই ছাপানোর এই পর্ব ইংরেজি ভাষার দরজা খুলে দেয় সীমিত আকারে ।
:
দুই] Shakespeare
দ্বিতীয় পরিবর্তনটি হয় শেক্সপিয়ারের হাতে । শেক্সপিয়ার Macbeth, Othello এবং Hamlet সহ ৩৭টি নাটক লিখেন, যা শিক্ষিত জনের সাথে সাধারণ কর্মজীবী মানুষরাও দেখতো, এবং দেখার সুযোগ পেতো । নাটকের সংলাপ একটা শ্রেণীর, বিশেষত পেশাজীবী সম্প্রদায়ের ইংরেজি বলার, এবং গদ্য লেখার ঢঙটিকে একদিকে ছড়িয়ে দেয়, আরেকদিকে সাহিত্যিক চিন্তাকে উস্কে দিতে থাকে । ভাষা এবং সাহিত্য হাত ধরার সুযোগ পায় ।
:
তিন] Bible
তৃতীয় পরিবর্তনটি হয় বাইবেলের হাত ধরে । সব বাইবেল নয়, ল্যাটিন ভাষায় লেখা বাইবেলও নয়, ১৬১১ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করা king James Bible ছিল ইংরেজি ভাষাকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসার সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী মুদ্রণ, এ যাবৎ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মুদ্রিত এবং পঠিত বই !
:
ষোলোশো শতাব্দী পর্যন্ত বাইবেল ছিল চার্চের হাতে বন্দি । ল্যাটিন ভাষায় সারা পৃথিবীতেই ক্রিস্টানরা বাইবেল পড়তো । সাধারণ মানুষের পড়ার যেমন সুযোগ ছিলনা, তেমনি বেশিরভাগ ইংরেজই ছিল ইংরেজি পড়তে না পারা অশিক্ষিত । ১৫২২ সালে মার্টিন লুথার ইউরোপে প্রথম জার্মান ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন, যা থেকে খ্রিষ্টানদের প্রোটেস্ট্যান্ট গ্রূপটির জন্ম হয় ।
:
লুথারের অনুসরণে ইংরেজ লেখক William Tyndale ১৫২৫ সালে ইংরেজিতে বাইবেল অনুবাদ করেন প্রথম, যা Tyndale’s Bible নাম ইতিহাসে পরিচিত । ষোলো শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি অষ্টমের সাথে দ্বিতীয় বিবাহ নিয়ে রোমের পোপের দ্বন্দ্ব হয় । ইংল্যান্ড রোমের অত্যাচার থেকে বাঁচতে নিজেরা পাদ্রীদের আলাদা সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউশন তৈরী করে, যা চার্চ অফ ইংল্যান্ড নামে পরিচিত । চার্চ এবং রাজা চাইলেন — তার প্রজারা ল্যাটিনের পরিবর্তে ইংরেজিতে বাইবেল শুনবে এবং পড়বে । কিন্তু টিন্ডালের সাথে রাজা হেনরির দ্বন্দ্ব ছিল, তাই চার্চকে নির্দেশ দিলেন ইংরেজিতে আরেকটি বাইবেল অনুবাদ করতে । কিন্তু চার্চের আনাড়ী পাদ্রীদের খটখটে শুকনো ইংরেজিতে লেখা বাইবেল এবং তার বিভিন্ন অর্থ যেন আরো দুর্বোধ্য এবং দ্বন্দ্ব তৈরি করলো ।
:
রাজা হেনরির পর রানি মেরি এসে আবার সেই বাইবেল নিষিদ্ধ করন। সতেরো শতকের শুরুতে স্কটল্যান্ডের রাজা জেমস ইংল্যান্ড দখল করে পুরো রাজ্যকে এক করতে এক গ্রূপ লেখক, পাদ্রী এবং বিজ্ঞজনদের নিয়ে টিন্ডালের আশিভাগ কপি করে একটি বাইবেল ইংরেজিতে লেখালেন । এই বাইবেলই কিং জেমস বাইবেল নামে পরিচিতি পায় । শুধু অনুবাদ করে নি, শুধু ছাপায় নি, এই বাইবেল ছাড়া ইংল্যান্ডে আর সকল ভাষার বাইবেল পড়া নিষিদ্ধ করলেন । প্রজাদের ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত করে তুলতে সব চার্চে এই বাইবেল পড়াতে নির্দেশ দিলেন, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করলেন, রবিবার বন্ধের দিন ঘোষণা করে সকল মানুষকে চার্চে যেতে নির্দেশ দিলেন । সপ্তাহের একদিন এমন করে চমৎকার ইংরেজিতে লেখা কিং জেমস বাইবেল শুনতে এবং পড়তে পড়তে পরবর্তী একশো বছরে আশি ভাগ অশিক্ষিত ইংরেজরা হয়ে উঠলো আশিভাগ শিক্ষিত জাতি ।
:
এভাবে আঠারো শতকে ছোট্ট একটি দ্বীপে জন্ম নিলো ওই সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে শিক্ষিত ইংরেজ জাতি, ইংরেজি ভাষায় বিশ্ব সাহিত্য এবং ইংরেজি নামক আন্তর্জাতিক ভাষা, যা আজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বকে! প্রথমে ইংল্যান্ড ও পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের কারণে বিশ্বের অন্য যেকোন ভাষার চেয়ে ইংরেজিই বেশি বিস্তার লাভ করেছে। ইংরেজি প্রায় ৫২-টি দেশের জাতীয় বা সরকারি ভাষা। বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারকারি জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশই ইংরেজিভাষি। আধুনিক যোগাযোগে ও বিভিন্ন পেশায় ইংরেজির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে এটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অধীত দ্বিতীয় ভাষা। সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির নতুন নতুন আন্তর্জাতিক পরিভাষার অধিকাংশই ইংরেজি থেকে এসেছে। আমরা প্রায় ৩০-কোটা বাংলা ভাষিক মানুষরা কি এ থেকে শিখতে পারবো কিছু!

You may also like...