“দু:খের ধানবীজে বোনা মুজিবের আনন্দ আলো প্রার্থনার গল্প”

(পনেরো আগস্ট জাতির জনকের প্রয়াণ দিবস স্মরণে এ রূপক গল্প উৎসর্গকৃত)
এ রূপক গল্পের লেখক : Jahangir Hossain
আমি যেদিন থেকে স্বর্গদূতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলাম, সেদিন থেকেই মনটা ভাল ছিলনা আমার। কারণ আমাকে মানুষের প্রাকমৃত্যু দূত হিসেবে কর্মপ্রদান করা হয়েছিল। মানে পৃথিবীর সকল মানুষের মৃত্যুর প্রাকমূহূর্তে আমাকে উপস্থিত হতে হয় ঘটনাস্থলে। মৃত্যু যদিও খুব বেদনাদায়ক কিন্তু পৃথিবীর কোটি কোটি শিশু, যুবক, বৃদ্ধের মৃত্যু দেখতে দেখতে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তাই কোন মৃত্যুই আমাকে খুব একটা পীড়া দিতে পারেনি কখনোই।
:
রাতে আকাশে উড়ছিলাম আমি কিছুটা অব্যাহতি পেয়ে। কিন্তু ঢাকা যাওয়ার নির্দেশ পেলাম আমি চেতন-নির্দেশনায়। হ্যাঁ, আজ শেষ রাতের দিকে অনেকগুলো মানুষের মৃত্যু হবে ঢাকার ৩২-নম্বর সড়কে শেখ মুজিবের বাড়িতে! কালবিলম্ব না করে ৩২-নম্বরের মুজিবের বাড়ির ছাদে বসে রইলাম আমি, এক স্বাভাবিক মৃত্যুর কান্না শোনার জন্যে। রাত প্রায় ভোর হলে কালো উর্দি পরা অনেক সেনাসদস্য এলো সেখানে। তারা মৃত্যুর সব রীতিনীতি ভঙ্গ করে দেশের জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে ব্রাশফায়ার করলো সিঁড়িতে। যখন মুজিব তাদের হত্যার অভিপ্রায় টের পেয়ে ট্রয় বীর হেক্টরের মত হুঙ্কার দিয়ে ‘তুই-তুকারি’ করতে থাকলেন, ঘাতক পথভ্রষ্ট সেনা সদস্যদের। আগতরা অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখাতে চাইলো পাহাড়মানব মুজিবকে। কিন্তু তিনি ঘাবড়ালেন বা টললেন না একটুও। ওরা মৃত্যুর সব রীতিনীতি পদদলিত করে, একঝাঁক বুলেট ছুড়লো মুজিবের বুক তাক করে। যুদ্ধে হাজারো শত্রুসৈন্যের দিকে যেমন আক্রমণ করা হয়, তেমন ঋণাত্মকভাবে তারা আক্রমণ করলো বাঙালি জাতির জনক সিংহপুরুষ শেখ মুজিবকে লক্ষ্য করে। মুজিব একজন মানুষ ছিলেন! রক্ত-মাংসের মানুষ! তাই তার বুক যখন হাজারো গুলিতে ঝাঁঝড়া করে বেড়িয়ে গেল সামনের দেয়ালে, তখন পড়ে গেলেন তিনি তার বাড়ির মোজাইকের সিঁড়িতে। যে বাড়িটি তিনি ঋণ করে তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের জাতির পিতা হওয়ার অনেক আগেই সেই পাকিস্তান আমলে!
:
মানুষের প্রাণ হরণ করা আমার একমাত্র কাজ। তাই কারো মৃত্যুতে কখনো মনে কোন ক্লেদ অনুভব করিনি আমি। একটা অবোধ শিশু যখন গাড়ি চাপায় চ্যাপ্টা হয়ে রক্তাক্ত নিথর হয় তার দেহ! কিংবা কোন কিশোরি যখন ধর্ষিতা হয় ধর্মালয়ে, তখনো সেই কম্পমান দেহ থেকে আত্মা তুলে নিতে বিবেকে বাঁধেনি আমার একটুও কখনো কোনদিন! কারণ এটাকেই আমি স্রষ্টা প্রদত্ত পরম দায়িত্ব বলে মনে করি! কিন্তু আজ যখন বুলেটবিদ্ধ কম্পমান রক্তেভেজা মুজিবকে পরে থাকতে দেখলাম, তারই বাড়ির অন্ধকার রক্তভেজা সিঁড়িতে! তখন এই প্রথম বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম আমি! কেন যেন ইচ্ছে করছিল না আমার, তাঁর দেহ থেকে আত্মাকে বের করে আনতে। তাই সিঁড়ের ওপর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম আমি একাকি। মনে মনে চাইছিলাম, এ্যাম্বুলেন্স ডাকা হোক! তাঁর চিকিৎসা শুরু হোক! বেঁচে থাক সে এ অপূর্ণ জাতির মাঝে আরো কিছুকাল। তাদের একটা পথের দিশা দিয়ে যাক সে! তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, কখনোই তার আত্মাকে বের করবোনা আমি! যতই সে রক্তক্ষরণ কিংবা আঘাতজনিত শ্বাসকষ্টে কষ্ট পাক। কারো মৃত্যুকষ্ট দূর করতে পারিনা আমি! পারলে অবশ্যই তখন মুজিবের মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘব করতাম আমি প্রাণপণে!
:
অনেকক্ষণ সিঁড়িতে পড়ে রইল মুজিবের সজিব যন্ত্রণাকাতর দেহ। যন্ত্রণায় ছটফট করছিল সে একাকি নিজ রক্তভেজা শরীরে। কালো উর্দি পরা সৈনিকরা বেশ কবার মুজিবের দেহ ডিঙ্গিয়ে ওপর-নিচ ওঠানামা করলো তুচ্ছতরভাবে। আরো অনেক ধ্বংসযজ্ঞ চালালো তারা! কিন্তু মুজিবকে হাসপাতালে নেয়ার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করলো না কেউ। শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল রক্তভেজা মুজিবের। এমন একজন মানুষের কষ্টে এই প্রথম নিজেই কষ্ট অনুভব করলাম আমি! যখন মুজিবের শরীরের প্রায় সব রক্তে পুরো সিঁড়ি ভিজিয়ে দিলো! ফুসফুসে শুদ্ধ বাতাস নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল তাঁর, তাই অনন্যপায় হয়ে আত্মাকে গ্রহণ করতে হলো আমাকে! মনে হলো নিজের আত্মাকে যেন টেনে নিলাম আমি যেন নিজের বুকের মাঝেই!
:
কোন মানুষের দেহ থেকে আত্মাকে টেনে নিজ কব্জায় নেয়ার পর ঐ মানুষের শবদেহের আর কোন মূল্য থাকেনা আমাদের কাছে। কিন্তু মৃত মুজিবের দেহকে কেন যেন স্বর্গে নিয়ে যেতে প্রবল তাড়না অনুভব করলাম আমি। ইচ্ছে হলো, তাকে স্বর্গে নিয়ে যাই এখনই। সাহায্য চাইলাম অন্য ৪-দেবদূতের। কিন্তু স্বর্গদেবতারা কোন কাজ করতে পারেনা নিজ ইচ্ছেতে! তাই আমাদের অপারগতার সুযোগে, আমাদের সামনে দিয়েই মুজিবের লাশকে ইতর মানব সৈনিক নামধারীরা তুচ্ছতরভাবে টেনে নিয়ে গেলে তাদের কব্জায়!
:
আমরা ৫-দেবদূত সারাদিন অসহায়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম উড়ে-উড়ে মুজিবকে। আমাদের শক্তি ছিলনা তার দেহকে রক্ষা করি কিংবা সরাসরি নিয়ে যাই স্বর্গে। কিন্তু পরিকল্পনা করি মনে মনে, অবশ্যই স্বর্গের উচ্চমার্গে স্থাপন করবো তার আত্মাকে। অবশেষে একটা জাতির জন্যে জীবনের প্রায় পুরো সময়টা কারাগারে কাটানো মুজিবের আত্মা নিয়ে উপস্থিত হই আমরা স্বর্গদ্বারে। কিন্তু সেখানে পৌঁছার আগেই নরকদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকগুলো বাঙালি পাকপন্থী প্রেতাত্মা। যারা মুজিবের বিরোধীতা করতো সব সময় ধর্মের নামে। এমনকি স্বাধীনতা লাভের পরও মুজিবের নামে তারা নানাবিধ প্রপাগান্ডা ছড়াতো সব সময়। এমনকি হজ্জের মাঠেও ছড়িয়েছিল তারা এ মিথ্যাচার। এদের প্রেতাত্মারাই মুজিবকে টেনে নিতে চাইলো তাদের দিকে। তারা অপব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে মুজিবের বৈশ্বিক জীবন ও তার কর্মকান্ড সম্পর্কে। তারা নিজেদেরকে ধর্মধারীও বলার চেষ্টা করে! অপরিদকে মৃত মুজিবকে বলতে চায় ধর্মবিচ্যুত মানুষ!
:
কিন্তু প্রধান স্বর্গরক্ষকের নির্দেশে মুজিবের পুরো লাইফট্রাক তথা পাপ-পূণ্যের স্কান করে সেখানে তেমন কোন পাপই খুঁজে পায়না স্বর্গীয় “হিসেবে ক্লার্ক” গণ। বরং জাতির জন্যে তার অবদান, জেল-জুলুম, সর্বোপরি অন্যায়ভাবে তাকে হত্যার কারণে তার হিসেবের খাতায় পাপের পরিমাণ “শূন্য” দেখা যায়। তারা অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নিষ্কলুষ পাপ-পূণ্যের হিসেবে প্রদর্শন করে প্রধান স্বর্গরক্ষকের নিকট। এবং তাই উপর থেকে নির্দেশিত হয়, বাংলাদেশ প্রেমিক মুজিবের জন্যে তার প্রাপ্ত স্বর্গ পরিবেশকে যেন পরিপূর্ণভাবে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও আবহে সজ্জিত করা হয় তখনই! কারণ এ লোকটি আমৃত্য ভালবেসে গেছেন বাংলাদেশের মানুষ আর এর প্রকৃতিকে! সুতরাং তার স্বর্গ হবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক আবহে!
:
মুজিবের আত্মা সমর্পণের পর আবার আমাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে বলা হয়। ঐ একই কাজ! মানে প্রাকমৃত্যুর ব্যক্তিদের থেকে তাদের আত্মাকে হরণ করে স্বর্গালোকে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এ কাজ আমার আর ভাল লাগলোনা। ঈশ্বরকে সানুনয়ে বলি, অব্যাহতি দিতে আমাকে। ঈশ্বর জানতে চাইলো আমার কাছে এর কারণ। এই প্রথম ঈশ্বরকে করুণ নিবিড়তায় বললাম –
“পৃথিবী একটা সুন্দর যায়গা। যেখানে ধান-কাউনের ক্ষেতে ঘাস-ফড়িঙয়েরা মরাবাতাসে খুঁজে ফেরে জীবনের কুলকিনারা। রহস্যময়ী রাতজাগা জোনাকি কন্যারা হাতছানি দেয় পৃথিবীর অন্ধকার বন-বাদাড়ে। সেখানে ভালবাসার প্রেমজ শরীরের কত না অপরূপ খিলান! আর বুকের ভালবাসার গম্বুজেরা ভেসে থাকে মানুষের হৃদয়ে। সেখানে আকাশ নক্ষত্রের পথ ছেড়ে, জলধির পথ খুঁজে ফেরে কতনা মানুষ নক্ষত্র সড়ক পথে। সেসব প্রেমজ মানুষের প্রেমভালবাসা ধ্বংসমত্ত অন্ধকার ফালি-ফালি করে কেটে, তা বিনাশ করতে পারবো না আমি হে ঈশ্বর!‍ ক্লান্ত রাতের ঝরা শিশিরের হাজারো কণ্ঠের ট্রাজিক গানের মধ্যে, মুজিবের আত্মাকে টানতে হয়েছে আমাকে। তাঁর জীবিত দুকন্যা তখন যেন অনাথ পৃথিবীর বুকে জেগে থাকে টাইটানহীন বুড়ো মৃত এক আকাশ। ছিন্ন প্রেমের পলাতক জীবনের আলো-ছায়ায় খুঁজে মরা বোধহীন বধির হয়ে এ কাজ করতে পারবো না আমি আর”!
 
 
ঈশ্বর বললেন – “কত কোটি মানুষের প্রাণহরণ করেছো তুমি! তাতে তোমার বোধ আর চৈতন্যে কোন ঘাত লাগেনি! কেবল মুজিবের মৃত্যুর পরই এ চেতনা কেন জাগ্রত হলো তোমার”?
আমি কাতর স্বরে বললাম – “নিষ্কলুষ এ মানুষটাকে প্রথমে তিলেতিলে দগ্ধ করেছিল পাকিস্তানি শাসকরা ধর্মের নামে। তাঁর স্বজাতির রাজাকার শ্রেণিভুক্তরা কতনা অপকথা প্রচার করেছিল তার নামে! এমনকি স্বাধীনতার পরও মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি একদন্ড! তার দেশের বামপন্থী লোকজন! অথচ জাতি আর দেশটার জন্যে কত অবদানই না ছিল তাঁর! সেই মানুষটার এমন অপঘাত মৃত্যুতে আত্মাহরণ ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি আমি! তাই অব্যাহতি দিন আমাকে এ কাজ থেকে ঈশ্বর”!
ঈশ্বর রূঢ়চোখে তাকালেন আমার দিকে। তখন আবার সাহসে ভর দিয়ে বললাম – “না আমাকে আপনি মুক্তি দিন প্রভু! হাজার মানবের শ্রেষ্ঠ যে মানব, নিজের সুখের জন্য নয়, পরের জন্য যিনি জীবন যৌবন সব উৎসর্গ করেছেন! আয়ু থাকতেও যাকে একদল ঘৃণ্য চক্রান্তকারীর হাতে প্রাণ দিতে হলো তার নিজ ঘরেই! তার আত্মা আনতে গিয়ে আমার হাত কেঁপে উঠেছিল বারবার! অন্তর কেঁদে উঠেছিল! নিজেকে বড়ই অপরাধি মনে হচ্ছিল আমার!”
:
আমার এমনসব কথা শুনে এই প্রথম ঈশ্বর তাকালেন মুজিবের আত্মার দিকে। একজন ক্ষমতাধর রূঢ় ঈশ্বরের চেহারায় এই প্রথম মানবীয় ভাষাহীন মুখ আর তাতে নিঃশব্দ পাথুরে কান্নার শব্দের মত একটা আওয়াজ করলেন তিনি! জলে ভেজা ঠনঠনে মাটিতে কেতকীর গন্ধেভরা জোনাকির আলো জ্বলার মত জ্বলে উঠলো ঈশ্বরের চোখ। ভরা ভাদ্রের অমাবশ্যা রাতের অন্ধকার আকাশের বুনো তারাদের মত চিকচিক করে তিনি তাকালেন আমার দিকে! কালান্তরিত জীবনের দিনগত পাপক্ষয়ের মূঢ়তায় ভরা মুজিব আত্মার সাথে তার দেহজ সমন্বয় করতে বললেন আমাকে! মধুমতির বুনোবাতাসে দোলায়িত বিকলন জীবনের পদে পদে দু:খগাঁথার পদাবলী গায়ে জড়ানো মুজিব দেহকে তাৎক্ষণিক নিয়ে আসি আমি স্বর্গসিঁড়িতে!
:
তখন স্বর্গদ্বারের সব দৌবারিকগণ আনন্দের এক রক্তজবা সূর্যালোকে ভেসে ভেসে মেঘপুর্ণ ধবল পর্বত শিখরে আরোহণ করতে থাকে ক্রমধারায়! খুশির বন্যায় বজ্রনিনাদের মত আনন্দ হুঙ্কার তোলে উলূক রাত্রির স্বর্গের মেঘমালা আর দূরাকাশের তারারা! ১৫-আগস্টের দু:খরক্তে ভেজা কালরাতের বিষাক্ত কৃতান্তনগরের কষ্টগল্প ভুলে যায় সব স্বর্গ প্রহরিরা! বৃষ্টিবাতাসে গন্ধময় ধবল পাহাড়ের নিস্তব্দ কোমল নিরেট গভীরতায় ভরা সুখ পরিবেশে। এক দেহের সঙ্গে আত্মার সম্মিলন ঘটে ঈশ্বরের ইঙ্গিতে তখন! এ অযাচিত দৃশ্যে আকাশ দেবতারা তাদের হৃদয়ছানা হৃদয়ের গভীর গহ্বরে খুঁজতে থাকে বাংলাদেশ নামক এক পরিজায়ি হলদে পাখিকে! তখন ঈশ্বরের সামনে চেতনাপ্রাপ্ত সাম্যবাদী সমাজের বণিক-সভ্যতার ভূমিজপুত্র মুজিব মাথাতুলে দাঁড়িয়ে বলে – “স্বর্গসুখ চাইনা ঈশ্বর! অপ্সরি চাইনা কখনো! দু:খের ধানবীজে বোনা আমার বাঙালি জাতিকে একটু সুখ, মুক্তি আর আনন্দ আলো দাও”!
 
 

You may also like...