নাপিত হরলালের ঘর পোড়ানো হয়নি!

 

যখন গ্রাম্য গঞ্জের অনাবিল মানুষের আনন্দধ্বনি মিলেমিশে একাকার ছিল! যখন নীলাভ সবুজ অপার্থিব ভালবাসায় স্নাত ছিল পুরো গ্রাম! যখন আকাশের কাছাকাছি মেঘেরা এক বিযুক্ত প্রেমময়তায় ভরা ছিল। যখন সমুদ্রের দিনরাত মিলেমিশে একাকার জলকণ্ঠস্বরে ভরে উঠতো আমাদের জীবন! যখন হিন্দু-মুসলমানরা মিলে মিশে একসাথে জারি-সারি গানের আয়োজন করতো, মিলে মিশে বসবাস করতো এক অসাম্প্রদায়িক সমাজে, তখন আমার জন্ম দক্ষিণ বঙ্গের বঙ্গোপসাগর সন্নিহিত এক গ্রামীণ দ্বীপে। আমার বাবা নাপিত পেশাধারী ছিলেন ঐ গ্রামেই। তার সাথে হাতে কলমে চুলকাটার প্রশিক্ষণ নিয়েছি আমি হরলাল শীল। বাবাকে দেখেছি গ্রামের অবস্থাপন্ন কৃষকদের বাড়ি গিয়ে চুল কাটতে। কোন টাকা দিতোনা তারা, বছর শেষে পৌষ মাসে ধান দিতো পারিশ্রমিক হিসেবে। কেবল সাপ্তাহিক বাজারের দিন একটা পিঁড়ি পেতে বাজারের একধারে বসতেন তিনি দরিদ্রদের চুল-দাড়ি কাটতে। যাদের ধান বা জমি ছিলনা, সেসব দরিদ্রতা বাজারে চুল কাটতো নগদ পয়সা দিয়ে। আমি পরিণত হলে বাজারে শহরের মত একটা “সেলুন” করি। যেখানে চেয়ারে বসে চুল কাটার সুযোগ ছিল। প্রথমে দরিদ্ররা, পরবর্তীতে চেয়ারে বসে চুল কাটা শুরু করলো স্থানীয় বিত্তবানরাও।

বাবা বুড়ো হয়েছেন, তাই এখন আর চুল কাটতে পারেন না। সাতাশি বছর বয়স হয়েছে তার। বাড়িতেই থাকেন শুয়ে বসে! যশোরে হিন্দু পাড়ার শীল পরিবারে বিয়ে করেছি আমি প্রায় কুড়ি বছর হলো। আমার কন্যাটি এখন ক্লাস টেনে পড়ে। পনের বছর বয়স হয়েছে তার। ও যখন পেটে, তখন ওর মা দেবী স্বরসতীর পুজো দিতো প্রত্যহ, তাই মেয়েটি আমার দেবীর মতই সুন্দরী হয়েছে! ওর নাম সবিতা রেখেছিল আমার মৃত মা! আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে কন্যাটি। নিরঞ্জন নামের ছেলেটি ছোট আমার। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে সে। স্কুলের ফাঁকে এবং অফ টাইমে আমার সাথে সেলুনে বসে ও। চুল কাটার হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। একদিন ভাল ‘হেয়ার স্টাইলার’ হবে সে, এটা তার স্বপ্ন। আমিও চাই পড়ালখা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াক ছেলেটি আমার। চাই শহরে গিয়ে চাকরি করুক কিংবা ভাল কোন সেলুন দিক ঢাকায়। সংখ্যালঘু হিন্দু হিসেবে গ্রামে নানাবিধ সমস্যা, আর হতাশায় ভুগি আমরা প্রতিনয়ত।

আমাদের গাঁয়ে নাপিত, ধোপা, মাছধরা হিন্দু জলদাসদের অন্তত একশ পরিবার ছিল। যার অধিকাংশ পরিবার ছিল নিতান্তই দরিদ্র। সবাই পরিশ্রম করে কোন রকমে জীবন নির্বাহ করতো। তিন গ্রাম দূরের ধনী গৃহস্থ হিন্দু দত্তদের বাহির বাড়িতে পুজামন্ডপ ছিল একদিন। সেখানে আমাদের গাঁয়ের সকল দরিদ্র হিন্দুরা যেতাম পুজো দিতে। কিন্তু নদী ভাঙনে প্রথমে দত্তদের বাড়ি ও পরবর্তীতে আমাদের গ্রামও বিলিন হলে, সব হিন্দু পরিবারগুলো যে দিকে পারে নানাভাবে চলে যান। আমাদের প্রতিবেশী অন্তত ২৪-ঘরের মাত্র তিনটে ঘর এখন টিকে আছে। শুনেছি বাকিরা সবাই নাকি ভারতে চলে গেছে নানাবিধ উপায়ে। এখন যে তিনটি পরিবার আছে সরকারি বেরী বাঁধে, তার দুটো নাপিত আর একটি ধোপা পরিবার। একজনে বাজারে লন্ড্রী চালায়। আমিসহ ২-পরিবার মানুষের চুল কেটে যাই পুরো বছর। এলাকার সকল মানুষ মুসলমান। তারা কখনো সরাসরি অত্যাচার করেনা আমাদের। বাবরী মসজিদ বা অন্য নানাবিধ ইস্যুতে কখনো আমাদের ঘর ভাঙেনি বা আগুন দেয়নি এ গাঁয়ের মুসলমানরা। সে হিসেবে কিছুটা ভাগ্যবান বৈকি আমরা! যেখানে শুনছি ২০০১-এর নির্বাচনের পর বরিশালের গৌরনদীর অনেক হিন্দু বাড়িতে নাকি আগুন দেয়া হয়েছিল। অনেক যুবতি হিন্দু মেয়েকে নাকি ধর্ষণ করেছে গৌরনদী, কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা ইত্যাদি এলাকায়!

একদিন কন্যা সবিতা এসে তার মাকে বললো – পাঠ্য ‘হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইটি একদিনও স্কুলে পড়ানো হয়নি তাকে। কিন্তু বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষায় একশ মার্কের পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে তাকে। ধর্ম টিচারকে তার একটা ‘টেস্ট’ পরীক্ষা’ নিতে অনুরোধ করলে ভ্রু কুচকে সে বললো – “নাউজু বিল্লাহ, আমি মুসলমান হয়ে তোদের কাফেরী হিন্দু ধর্মের বই ধরবো? আমারে জাহান্নামে নিতে চাস তুই”? কি আর করা! বিনা পড়ানোতে, বিনা টেস্টে পড়ে যেতে বললাম মেয়েটিকে। ছেলে নিরঞ্জনকেও বললাম একই কথা। একদিন সবিতার কান্না দেখে তার মার কাছে জানতে চাইলাম কারণ। আমার স্ত্রী বললো – “বাজারের চা দোকানী সুলেমান মোল্লা প্রেমপত্র দিয়েছে সবিতাকে। সবিতা তা ফিরিয়ে দিলে, খারাপ অশ্লীল কথা বলেছে তাকে। এ নিয়ে নিরঞ্জন প্রতিবাদ করলে, নিরঞ্জনকে ঘুষি দিয়েছে সুলেমান”! দুপুরে মোল্লা বাড়ি গিয়ে সুলেমানের বাবার কাছে গিয়ে বললাম তার ছেলের কুকর্মের কথা। কিন্তু পিতা ছেলের কোন দোষ না ধরে বললো – “ব্যাটা, তোমরা তো মালাউন। একটা মালাউনের মাইয়ারে বিয়া করতে চাইছে আমার পোলা, এইডা তোমার ভাগ্য না? মুসলমানের বউ হইয়া ভাল থাকপে না তোমার মাইয়া”? বখাটে ছেলের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে উল্টো বিপদে পড়লাম আমি!

ছসাত বছর আগে নদীতে বাড়িটা ভাঙার সময় বাড়ির সাথে ত্রিশ শতক ধানী জমিও ছিল বাবার। এখন পলিমাটির চর জেগেছে ওপারে। সেখানে বোরো ধানের চাষ শুরু হয়েছে। আমাদের মোট চল্লিশ শতক জমির উত্তর দিকে শফি দেওয়ানের জমি। প্রায় চার পাঁচ হাত আমার জমির মধ্যে ঢুকে ধান লাগিয়েছে সে। পুর্ব দিকে শফিকুল্লাহ গাজী আল ধরেছে অন্তত দুই ফুট আমার জমির ভেতরে ঢুকে। দক্ষিণ আর পশ্চিমে যাদের জমি, তারা ঢুকতে দিচ্ছেনা আমাকে তাদের জমিতে। তারা দুজনেই সঠিক সীমানা ধরে নিজ নিজ জমিতে চাষ করছে। অন্যে আমার জমি দখল করেছে বলে তারা কি তাদের জমি ছেড়ে দেবে? একদিন বাজারের মসজিদের ইমাম এলো সুন্নতি স্টাইলে ‘মোচ’ ছাটতে সেলুনে আমার। এসেই ঝাঁঝাঁলো সুরে বললো “তোদের খামোখা নোমো-চাড়াল-মালাউন বলি আমরা”!? বিনীতভাবে চোখ তুলে জানতে চাই কি অইলো ইমাম সাব? তিনি মেজাজ গরম করে বললেন – “দেখ, গরুর মাংস বিক্রি করছে বলে বাপ-বেটাকে পিটাইয়া খুন করছে ইন্ডিয়ায় হিন্দুরা। এখন তোগো কি করতে হয় ক তো”? ভয়ে ভয়ে বললাম – “আমরা এখানের গরিব নাপিত, আমরা কি দোষ করলাম ইমাম সাব”? ইন্ডিয়ার ঐসব লোক কি করলো তা ক্যামনে কমু আমরা?” দয়ালু ইমাম মেজাজ খারাপ বলে পয়সা না দিয়েই চলে গেলেন। ভয়ে আর টাকা চাওয়ার সাহস পেলাম না আমি।

এক রাতে বাবা মারা গেলেন দীর্ঘদিন রোগে ভুগে। এলাকায় হিন্দু পুরুষ কেবল আমি আর ছেলে নিরঞ্জন। প্রতিবেশী বাবুল শীল আর বাজারের তরুণ কামিনি ধোপা গোাপালগঞ্জের ওড়াকান্দি গেছে মতুয়াদের মেলা দেখতে। বাবাকে চিতায় তোলা, দাহ করা কিছুটা জটিল হলো আমি আর নিরঞ্জনের জন্য। প্রতিবেশী মুসলমান যুবক তসলিম আর কোরবান মজুরী খাটে এখানে-ওখানে দৈনিক ৩০০-টাকা হিসেবে। তাদের দুজনকে ঠিক করলাম নগদ ৬০০ টাকায়। তারা চিতার কাঠ চিড়ে আমাদের বাপ-বেটাকে সাহায্য করবেন বাবার দাহ-কর্মে। কোন আপত্তি না করেই ওরা কাজে লেগে গেলো আমাদের সাথে দাহ কর্মের কাঠ চেড়ায়। কিন্তু খবর গেলো ইমাম সাব আব্দুর রহমানের কাছে। তিনি এসে চোখ পাকিয়ে বললেন – “তোমার সাহসতো কম না। মানুষ পোড়ানোর মত জঘন্য পাপ কামে নিয়োগ করছো মোসলমান তছলিম আর কোরবানকে? নিজেদের পরকালতো নাই, অন্যের পরকালও শেষ করতে চাও?” হুজুরের ধমকে মুসলমান ২-যুবক পালিয়ে গেল বিলের ভেতর দিয়ে। আমি আর ছেলে নিরঞ্জন দাঁড়িয়ে রইলাম বাবার মৃতদেহের পাশে নির্বাক হয়ে।

কদিন পর বাজার সংলগ্ন স্কুল মাঠে শুরু হলো বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল। সারাদিন রাত ব্যাপী ৩-দিনের এ মাহফিলে অনেক বক্তা আনা হলো দেশের নানা স্থান থেকে। ওয়াজের একটা মাইক লাগানো হলো আমার সেলুনের চালে। অন্যটি কামিনি ধোপার ঘরের খুটির সাথে! সারাদিন রাত ওয়াজে নানাবিধ কথা শুনতে থাকলাম আমরা। এক বক্তা হিন্দুদের কেন “মালাউন” বলা হয় তার চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিলেন। অধিকাংশ পড়ালেখা না জানা শ্রোতারা হাততালি দিয়ে উপভোগ করলেন মালাউনের ব্যাখ্যা। মানুষ পোড়ানো কত জঘন্য অপরাধ তার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিলেন বাজারের ইমাম সাহেব নিজে। তিনিই এ ওয়াজের উদ্যোক্তা। চিতায় তুলে ‘দাহ’ থেকেই হিন্দুদের ‘জাহান্নাম’ শুরু বলে মন্তব্য করলেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে কিছুদিন আগে আমার বাবার দাহ-কাজে মুসলমান যুবকের অংশগ্রহণ কত বড় জঘন্য অপকার্য তারও ব্যাখ্যা দিলেন তিনি। ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙা, গরু বহনকারী মুসলমানদের অহরহ হত্যার নানাবিধ ঘটনার বর্ণনা করলেন তিনি ফিরিস্তি সহকারে। অথচ বাংলাদেশে আমরা হিন্দুরা কতইনা ভাল আছি মুসলমানদের দয়ায় তাও বললেন তিনি। বাংলাদেশের মুসলমানরা অনেক ভাল বলে হিন্দুদের থেকে ‘জিজিয়া কর’ আদায় করছে না। আবার জাকাতও দেয়না হিন্দুরা। মানে আল্লাহকে তারা ২-দিকেই ঠকাচ্ছে। সকল দর্শক শ্রোতা ইমাম সাহেব এমন গরম বক্তব্যে “আল্লাহ আকবর” ধ্বনি তুলে আকাশ বাতাস মুখরিত করলো।

৩-দিন ব্যাপী ওয়াজে এমনসব কথা শুনে আমার কন্যা, নাবালক পুত্র আর স্ত্রীর মুখ শুকিয়ে গেল। স্ত্রী বললো – “তার চেয়ে চলো ভারতে চইলা যাই”! নিজের জেগে ওঠা ৪০-শতক জমির মাত্র ৩২-শতক এখন আমার দখলে, বাকিটা দুই প্রতিবেশী জোর দখল করে খাচ্ছে। তা বিক্রির জন্য ওপারে কথা বলতে গেলাম সাত্তার মল্লিকের সাথে। দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বুড়ো সাত্তার মল্লিক বললেন – “কি মিয়া! জমি বেচবা ক্যান? ইন্ডিয়া চইলা যাইবা নি”? বললাম – “না চাচা। প্রায় ৮ শতক ঠ্যালাঠেলি কইরা দখল কইরা রাখছে শফি দেওয়ান আর শফিকুল্লাহ গাজী। আপনে কিনলে তারা আর দখলে রাখবার পারবো না। তা ছাড়া বাজারের নিকট জমি কিনা একটা ঘর তুলবার চাই”! ৪০-শতক জমির দাম কমপক্ষে ৪০-হাজার টাকা চরের বাজার দরে। কিন্তু ২০-হাজার টাকার বেশী দিতে সম্মত হলেন না সাত্তার মল্লিক। পানের পিক ফেলে বললেন – “মালাউনের জমি কিনলে অনেক ঝামেলা। ৩/৪ জনের কাছে বিক্রি কইরা গোপনে ইন্ডিয়া পলাইয়া যায়। তাই রেকর্ড পর্চা ঠিক করতে ঝামেলা হয় শেষে। বিশ হাজার টাকা দাম পাইবা তুমি! মুসলমানের জমি অইলে দাম বাড়াইয়া দিতাম আমি! আমি পরকালের ভয় করি। মানুষরে ঠকাইনা”!

বেশ কজনের কাছে চুল কাটার টাকা বাকি ছিল। যথাসময়ে তা তুলতে পারলাম না। জমি বিক্রির কুড়ি হাজার টাকাসহ ঘরে মোট বিয়াল্লিশ হাজার টাকা হাতে এখন। অবশেষে ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম স্ত্রী কন্যা আর পুত্রের মুখের দিকে চেয়ে। অন্ধকার রাতে বিলের মাঝে গিয়ে ফোনে কথা বললাম বারাসাতের কালিকাপুর বসবাসকারী কাকাতো ভাই মহেষের সাথে। মহেষ অভয় দিলো আমাকে। বর্ডারে সে লাইনঘাট করে জানাবে বলে আশ্বাস দিলো। অমাবশ্যার দুদিন আগে এক ঘোর অন্ধকার রাতে ঘর ছাড়লাম আমি পুরো পরিবারসহ। বাজারের সেলুন যেমন আছে তেমনি অবস্থায় ঝাঁপ বন্ধ করে, রান্নাঘরে ভাতের পাতিলে ভাত তরকারি রেখে, ঘরের বাতি জ্বালিয়ে অত্যন্ত সঙ্গোপনে “ছিটু মাঝির” ট্রলারে উঠলাম আমরা। মুসলমান ছিটু মাঝি আমার প্রতিবেশী ভাল মানুষ। আমাদের রাতে পলায়নের কথা কাউকে বলবেনা বলে কথা দিলো সে আমাকে। তিনশ টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রাতের অন্ধকারে লাহারহাট ফেরিঘাটে নিয়ে যাবে আমাদের। সেখান থেকে স্থানীয় গাড়িতে বরিশাল শহরে যাবো আমরা। বরিশাল নথুল্লাবাদ থেকে চাকলাদার পরিবহণে বেনাপোল বন্দরে নিয়ে যাবে দালালদের একজন। তারপর দক্ষিণ চড়ইগাছি সীমান্ত দিয়ে রাতের অন্ধকারে দালালের মাধ্যমে ঢুকবো আমরা ভারতে। এ জন্য দালাল গ্রুপকে দিতে হবে চার জনে কুড়ি হাজার টাকা। এ কুড়ি হাজারের একটা অংশ পাবে বাংলাদেশের বিজিবি, অপর অংশ ভারতের বিএসএফ ও দালালরা। টাকা ছাড়া বর্ডার পার হতে গেলে গুলি করে ভারতের ‘বিএসএফ’। কিন্তু টাকা পেলে তখন নাকি তারা মুখ ঘুরিয়ে থাকে অন্যদিকে।

রাত ১১-টার দিকে ইঞ্জিন চালিত ট্রলার স্টার্ট দিলো প্রতিবেশী ছিটু মাঝি! স্ত্রী, কন্যা, ছেলে আর চারটে বোচকা নিয়ে বসে আছি আমরা ট্রলারের ভেতরে। ঐ বোচকায় জরুরী কাপড় চোপড় নিয়েছি আমাদের। সাথে কিছু খাবার। বাকি সব রেখে এসেছি পুরো ঘরে যেমনটা ছিল। এমনকি চুলকাটার কাঁচি চিড়ুনীও সেলুনে রেখে এসেছি নিজে। ট্রলার নদীর মাঝ নদীতে চলে যাচ্ছে। বাঁধের উপর বানানো আমাদের কুঁড়েঘরের আলো তখনো দেখা যাচ্ছে অষ্পষ্ট আলোয়। সবাই তাকিয়ে রয়েছে ফেলে আসা ঘরের দিকে। কিন্তু অন্ধকারে কারো ভেজা চোখ কেউ দেখতে পাচ্ছি না আমরা! কেবল অন্ধকারে অনুভব করছি সমুদ্র সন্ন্যাসী সৈকত কাঁকড়ার মতোন এক দম বন্ধ করা যন্ত্রণা! নতুন জেগে ওঠা চরের বালুর অপসৃয়মানতায় মতো আমাদের চিবুকে নুন, গালে নুন, ওষ্ঠাধর যেন নুনে স্থবির হয়ে থাকে অনেকক্ষণ! কন্যা সবিতার কণ্ঠে শুনি সদ্য ভেজা বধির খাতার মাঝে শুয়ে থাকা শঙ্খ, কড়ি আর সৈন্ধবলবণের ক্রন্দন! এক সময় দম বন্ধ হওয়া প্রাণতায় ঘুমের মাঝে যেন সমুদ্রের সকাতর প্রেমময়তা উতলে উঠে আমাদের চার জনের জীবনে! ক্ষীণ চাঁদ ডুবে যায় এক সময়! ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছিটু মাঝি বলে – “দাদা, লাহারহাট চাইলা আইছি। তাড়াতাড়ি নামেন। আলো ফোটার আগেই ঘাটে ফিরা যামু আমি”! অন্ধকারে চারটে মানুষ একমুঠো জোনাকীর আলো হাতে নিয়ে নেমে যাই ট্রলার থেকে। এবার আমাদের উঠতে হবে ভটভটি গাড়িতে। ফেলে আসা জলটুঙি পাহাড় হয়ে সামনে দাঁড়ায় আমার বাজারের সেলুন, তার ভাঙা চেয়ার আর গ্রামীণ কুঁড়েঘর! যেখানে হয়তো প্রদীপ জ্বলছে এখনো! এ যেন মানব জীবনের বেঁচে থাকার আরেক রূপান্তরকামী সুবর্ণরেখা!

 

You may also like...