ক্রিস্টাল প্রাসাদে এক রাতের ডিনার ও ৫-টি মানুষের চোখের জল

গতরাতে একটা নিমন্ত্রণ ছিল আমার ডিনারের! ঢাকার অভিজাত বারিধারার ততোধিক অভিজাত ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মি. তৌফিক হাসান গত বছর কেনা নতুন মার্সিডিজ পাঠালো আমায় নিতে। গাড়ি পাঠানোর প্রস্তাবে হেসে বললাম – “বাবা থাক! আমার কমদামি টয়োটাতেই চলে আসি আমি নিজেই ড্রাইভ করে, ড্রাইভার পাঠাতে হবেনা কষ্ট করে “! কিন্তু তৌফিক নাছোড়বান্দা! অবশেষে, তার নতুন আরামদায়ক মার্সিডিসেই যেতে হলো আমাকে। গাড়িতে উঠতে ও নামতে দুবারই স্যালুট করলো ড্রাইভার আমায়। আমি দরজা খোলার আগেই প্রশিক্ষিত ড্রাইভার দৌঁড়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে স্যালুট করলো তৃতীয় বার আমাকে।
:
নামতেই তৌফিক হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে লিফট টিপে তাতে ওঠালো আমায়। ৮-তলার ফ্ল্যাটে ঢুকে মনে হলো, যেন কোন রাজপ্রাসাদে ঢুকলাম। ঢাকাতে এতো অভিজাত ফ্ল্যাট আছে, আগে জানতাম না আমি। অস্ট্রেলিয়াতে পড়ুয়া ওর ২-কন্যা এসেছে দেশে ছুৃটিতে। তাদের সাথে ডিনারের দাওয়াত আমার। আগে তৌফিকের গুলশানের ভাড়া ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম আমি বেশ কবার। কিন্তু নিজের কেনা এ ফ্ল্যাট যে এতো রিচ, তা মনে করিনি আমি কখনো। ক্রিস্টালের ডাইনিং টেবিল ও তার ক্রিস্টাল কাঁচের চেয়ারগুলোতে বসতে ভয় লাগছিল আমার, যেন তা ভেঙে পড়বে। কিন্তু তৌফিকের কন্যারা হেসে জানালো – “আঙ্কেল ভয় পাচ্ছেন কেন? এগুলো অস্ট্রেলিয়ার তৈরি। অনেক দামি, কখনো ভাঙবে না! এ টেবিলের ক্রিস্টাল সেটেরই কফি কাপ আছে আঙ্কেল, তাতে ডিনারশেষে কফি খাবো সবাই”!
:
খাবারের অনেক আইটেম। সবগুলোর নামও জানিনা আমি। গ্রামে মার হাতের পাটশাক, কুমড়ো আর বথুয়া শাক খেয়ে বড় হয়ে, জীবনের এ পরিণত বয়সে শহুরে হয়েছি আমি। এখনো খেসারিডাল ভর্তা, আম-ডাল, পাট-শাক আমার প্রিয় খাবার। কিন্তু তারপরো তৌফিক আর ওর স্ত্রী-কন্যার চাপাচাপিতে হাই ক্লোলেস্টোরেলযুক্ত ৫০০-গ্রামের বড় একটা গলদা চিংড়ি খওয়া শুরু করতে হলো আমায়! খাবার টেবিলেই এক ফাঁকে তৌফিকের ছোটমেয়ে লিলিথ বললো, “Uncle, Could I ask a question”? হেসে বললাম – “বলো লিলিথ, বাংলাতেই বলো”! লিলিথ বললো – “বুঝতে পারছি না আংকেল, ড্যাড আপনাকে কেন এতো অনার করে? গত বছর কেনা মার্সিডিসে সাধারণত আমাদেরও চড়তে দেয়না সে। ওটা বলতে গেলে, গ্যারাজেই থাকে বিদেশি বড় বায়ারদের জন্যে। কিন্তু আমাদের একান্ত পারিবারিক এ ডিনারে বাইরের গেস্ট কেবল আপনি। ড্যাড নিচে নেমে লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন আপনাকে রিসিভ করতে। তাই আমরা দুবোন আর মা জানতে চাইছি, ড্যাডের সাথে আপনার রিলেশনটা কি”!
:
ধীর লয়ে বললাম, তোমার ড্যাডকে জিজ্ঞেস করো। সে-ই ভাল বলতে পারবে কি সম্পর্ক তার সাথে আমার। তৌফিকের দিকে তাকিয়ে বললাম, বাবা তুমি বলো, তোমার কন্যার জবাব। তৌফিক কথা বলতে গিয়ে মনে হলো, ওর চোয়াল খুব শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কেমন আড়ষ্ঠ কণ্ঠ তার। গলায় পানি ঢেলে বললো, আমি বলতে পারবো না স্যার, আপনি বলুন! আমার চোখে জল এসেছে দেখুন! সত্যি বলতে পারবো না আমি!
:
সরকারি চাকুরে হিসেবে আমি তখন চট্টগ্রামে কয়লা পরিদপ্তরে “কোল কন্ট্রোলার” হিসেবে কর্মরত। একদিন দুপুর বেলা পিওন জানালো, আমার জেলার একটা ছেলে খুব অনুরোধ করছে, আমার সাথে দেখা করতে চায়। লাঞ্চ টাইমে ফ্রি ছিলাম, তাই ভেতরে এলো ছেলেটি। নাম বললো সে তার মিঠু। তার মোদ্দা কথা, ৩-বছর আগে এসএসসি পাস করার পর পড়ালেখার আর সামর্থ নেই তার দরিদ্র পরিবারের। তাই চাকুরির সন্ধানে গত মাসে চট্টগ্রাম এসে অনেক ঘোরাঘুরি করেও, কাজের কোন সংস্থান করতে পারেনি। ৩-দিন থেকে হাতে কোন টাকা পয়সাও নেই। পোর্টভবনের বারান্দায় কাটছে রাতটা বলতে গেলে না খেয়েই। একটা পিওনের চাকুরি চায় সে আমার দপ্তরে। কিন্তু সরকারি দপ্তর আমার। চাইলেই কাউকে চাকুরি দিতে পারিনা আমি। পোস্ট খালি থাকতে হবে। মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। নিয়োগ বোর্ড করতে হবে। বেতনভাতা বরাদ্দ! কতনা আমলাতান্ত্রিক ব্যাপার!
:
খাবার নিয়ে পিওন ঢুকলো ভেতরে। আমার বলার পরও মিঠু কিছুতেই আমার টেবিলে আমার সাথে লাঞ্চ করবেনা। অভুক্ত মিঠুর দিকে চেয়ে বললাম, লাঞ্চ করতে করতে আলাপ করবো কিভাবে চাকুরি হতে পারে তোমার। এবার বাসা থেকে আনা লাঞ্চ ভাগ করে খেলাম মিঠুর সাথে আমি। বললাম, মিঠু আমাদের অফিসে ১০,০০০ কয়লা তোলার “বেলচা” কিনবো আমরা। তার কোটেশন আছে নোটিশ বোর্ডে। তুমি কি এ বেলচা সাপ্লাই দিতে পারবে? মিঠু বললো, স্যার বেলচা কি জিনিস আমি জানিনা। কই পাবো? কিভাবে দেব? আমার হাতে কোনও টাকাও নেই। এসব কাজেতো টাকা আর অভিজ্ঞতা লাগে স্যার! স্যাম্পলের রাখা একটা “বেলচা” আনলো পিওন সগির। মিঠু দেখে বললো, স্যার এগুলো তো কামার দিয়ে বানাতে হবে। প্রতিটাতে অন্তত এক/দেড়শো টাকা খরচ হবে মনে হয়। আমি বললাম, ঠিক বলেছো। আমরা এগুলো ২০০-৩০০ টাকা করে কিনতে পারি। তবে তুমি যদি পুরনো ড্রাম কিনে তা কেটে বেলচার বডি ও রড কিনে তা কেটে হাতল বানাও, তাতে আমার মনে হয় প্রতিপিস ৫০-টাকাতে তুমি বানাতে পারবে। তখন জিনিসপত্র খুব সস্তা ছিল। ওর হাতে ৫০-টাকা দিয়ে বললাম, তুমি পতেঙ্গা পুরনো ড্রাম বিক্রির দোকানে গিয়ে দেখো, অকেজো ড্রাম কত দামে কেনা যায়!
:
৫-টায় অফিস থেকে বের হওয়ার আগেই মিঠু এসে জানালো, পুরনো অকেজো ড্রাম ৮০/৯০-টাকা করে প্রতিটি কেনা যায়। এমন একটা ড্রামে অন্তত ২০-টা “বেলচা” বানানো যাবে। অফিসের গাড়িতে মিঠুসহ অকেজো ড্রাম আর হাতলের টুকরো রডের দোকানে গিয়ে রাত ৮-টার মধ্যে এক দোকানিকে পেলাম যে, ৮০-টাকা হিসেবে ৫০০ ড্রাম ও ৪-টাকা সের হিসেবে টুকরো ব্যবহৃত রড দেবে। যার দাম সাকুল্যে ৪৮,০০০ টাকা। আমার কাছে এতো টাকা তখন ছিলনা। মাত্র ১৮,০০০ টাকার মত ছিল ঘরে-বাইরে। বাকি ৩৫,০০০ টাকা ধার করতে হলো নানাভাবে নানাকষ্টে আমাকে। অচেনা মিঠু যেন টাকা নিয়ে পালিয়ে না যায়, তাই মিঠুর হাতে নগদ কোন টাকা দিলামনা আমি। সে কেবল সব মাল নিয়ে ৩/৪ জন কামারের সহযোগিতায় রাতদিন কাজ করে বেলচা বানাতে লাগলো। রাতে ঘুমাতো সে ঐ মালপত্রের মধ্যে, যাতে মাল চুরি না হয়। প্রতি পিস ২২০ টাকা হিসেবে ১০,০০০ পিস “বেলচা” সাপ্লাইয়ে দুই লাখ কুড়ি হাজার টাকা পেল মিঠু। লেবারসহ সব কাজে ওর ১-লাখের মত খরচ হলো।
:
বিল পাওয়ার পর আমার সব ঋণ পরিশোধ করলো মিঠু। তারপর লাভ হিসেবে হাতে থাকলো ১ লাখ ৬-হাজার টাকা। যা আমার টেবিলে রাখলো সে। আমি হেসে বললাম, লাভের এ টাকার অর্ধেক তো আমার প্রাপ্য, পুঁজি দেয়ার কারণে তাইনা? মিঠু বললো, অবশ্যই স্যার! সে ৫৩,০০০ টাকা আলাদা করে আমাকে দিয়ে বললো, স্যার এটা আপনার পূঁজির লাভ অর্ধেক। আমি তা ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি অনেক পরিশ্রমি আর সৎ। তাই ধারদেনা করার পরও তুমি কাজটা করতে পারলে, তাতেই আমি খুশি। লাভ লাগবে না আমার। কিন্তু মিঠু নাছোড়বান্দা। লাভ আমাকে নিতেই হবে। তাই হেসে মিঠুকে বললাম, ওকে তোমার টাকার সাথে এই ৫৩,০০০ টাকাও রাখো। ওটা যৌথ ব্যবসার পুঁজি!
:
এ সময়ে শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ লাগার কারণে গার্মেন্টস ব্যবসা চলে এলো একচেটিয়া বাংলাদেশে। মিঠু প্রথমে পোশাক কারখানায় স্টিকার, বোতাম, জিপার, কার্টুন সাপ্লাই দেয়া শুরু করলো। আমি তখন অবসরে। একদিন আমার ঢাকার বাসাতে এসে বললো, স্যার, মীরপুরে একটা পুরনো ভবন ভাড়া নিয়ে তাতে পোশাক কারখানা করবো। সাব-কন্ট্রাকে কাজ করলে ভাল লাভ হবে। সেই শুরু ১০টা পুরনো সেলাই মেশিন কিনে। ক্রমে ব্যবসার উন্নতির পর ইপিজেডসহ মিঠুর গার্মেন্টস কারখানা এখন ১২-টা। ইউরোপের সব দেশে যায় তার পোশাক। ৬০০০ এর মত নারী শ্রমিক কাজ করে মিঠুর কারখানায়। আমার ৫৩,০০০ টাকার পুঁজির কারণে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রয়োজনে সে আমাকে প্রায় ২৩-লাখ টাকা দিয়েছে। কিন্তু এখনো সে বলছে, ৫৩,০০০ নাকি এখনো পাওনা আছে আমার। জানো মিঠু কার নাম? তোমার বাবা তৌফিক হাসানের!
:
মিঠুর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখে জলের বন্যা। এ ভালবাসার গল্পে লিলিথ, চপলা আর ওর মা কেউই আর খেতে পারেনা কিছুই। ওরা ৩-জনেই কি মিঠুর মতই কাঁদছে? এসময় নিয়নের আঁধো-আলোয় এ প্রাসাদকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এক মৃত নগরী মনে হয় আমার! মনে হয় পুরো ঘরটিতে যেন বিসর্জনের বাদ্য বাজছে করুণ এসরাজের সুরে! যার প্রধান বাদক আমি এবং আমিই! মানুষ আর মাকড়সার ভালবাসার এ জাল বুননে, এ বাড়ির চিলেকোঠায় এক জালচক্র বুনে গেছি আমি যেন আজ! মিঠু আর তার ৩-রমণীর দিকে তাকিয়ে আবার মনে হয়, মানুষও জাল বোনে ভালবাসার কিংবা ষড়যন্ত্রের! মাকড়সার জালে ধরা পরে পতঙ্গ কিংবা কখনো ছিঁড়ে জালের বিনুনি। তারপরো মানুষের জালে মানুষ ধরা পড়েই কিংবা ছিঁড়ে যায় তার হৃদতন্ত্রী কখনো কখনো! আমাদের আর কারো ডিনার করা হয়না এ বাড়িতে আর। সবাই সবকিছু ভুলে যায় প্রাগৈতিহাসিক অচলা মুদ্রার মত। চলে যেতে চাই আমি এ গুমোট ভালবাসার প্রাসাদ থেকে! মিঠু আর তার কন্যারা একবারো বলেনা আমায়, “কফি খেয়ে যাবেন না আঙ্কেল ক্রিস্টাল কাপে”! সবাই ভুলে যায় সব কিছু অহল্যার পাথর মূর্তির মতো।
:
এবার নিজেকে মাঠের কোণে বেড়ে ওঠা এক বিষন্ন এতিম ছাতিম গাছের মত মনে করে পা বাড়াই আমি দরজার দিকে। কিন্তু মিঠু পরিবার মৃত নগরীর বাসিন্দাদের মত কেবল বিমূঢ় হয়ে চেয়ে থাকে বরফে ঢাকা মাছের ধূসর চোখে! লিফটের বোতাম চাপলে চেয়ে দেখি মিঠু, লিলিথ, চপলা আর ওর মা পা-ছুঁয়ে সালাম করছে আমায়! ওদের ৪-জনের তপ্ত চোখের জলে কি আমার পা ভিজে যাবে! মানুষের চোখে এত জল কোত্থেকে আসে আষাঢ়ী বর্ষার মত! লিফটের দরজা খুললেও কিছুই দেখিনা আমি! সব ঝাপসা কেন এমন! আমার আশি বছরের এ বুড়ো শুকনো চোখে এতো জল এলো কিভাবে এত বছর পর! যা রোধ করতে পারিনা আমি কিছুতেই এ ক্রিস্টাল প্রাসাদে!
 

You may also like...