প্রাণের সৃষ্টি, বিবর্তনবাদ এবং

বিজ্ঞানের বেশিরভাগ বিষয়ই এত জটিল যে সাধারন মানুষ কেবল তার ফল ভোগ করেই যায়, সেটার সম্পর্কে বিশদ জানার আগ্রহও বোধ করে না। যেমন ধরুন, মোবাইল। বর্তমানে শ্রমিক থেকে কোটিপতি সবাই-ই এ প্রযুক্তিটি ব্যবহার করছেন কিন্তু এর পিছনে যে কতগুলো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সফল প্রয়োগ রয়েছে তা আমাদের চিন্তার বাইরে। বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কে সাধারন মানুষের আগ্রহ না থাকলেও কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব না বুঝেও মানুষের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর তা যদি মানুষের হাজার বছরের বিশ্বাস ও সংস্কারকে ভেঙ্গে দিতে চায় তাহলে তো কথাই নেই। বিবর্তনবাদ এমনই একটি তত্ত্ব, যা আমাদের হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বিশ্বাস ও সংস্কারকে ভেঙে দিয়েছে এবং তাই বেশিরভাগ মানুষ তত্ত্বটি সম্পর্কে না জেনেই কথা বলতে শুরু করেছে। আসলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষ হাজার বছর ধরে মানসিক অন্ধকারের জগতে বাস করে করে অন্ধকারজীবি হয়ে গিয়েছে, অন্ধকারের এই আশ্রয়টি তারা কিছুতেই ছাড়তে নারাজ। দ্বিতীয়ত, রাজনীতি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে এখানে আলোর প্রবেশ রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করা হয়। আমাদের রাজনীতির কাছে মানুষের শিক্ষার প্রয়োজনটা গৌণ, ভোটটাই মুখ্য। তাই বিবর্তনবাদ আমাদের পাঠ্যসূচী থেকে ছাটাই করা হয়েছে; অথবা একগাদা আবর্জনাময় ডিসক্লেইমার (disclaimer-কোনকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকারমূলক বিবৃতি) দিয়ে যেনতেন ভাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।

বিবর্তন একটি ধীর প্রক্রিয়া। লক্ষ-কোটি বছর ধরে পৃথিবীর প্রথম প্রাণী সরল এককোষী জীব বিবর্তিত হতে হতে বর্তমানে মানুষের মত উন্নত চিন্তাশীল প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে। মাস্তিষ্কের গঠন ও পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে বিবর্তন কিন্তু তার ব্যবহার করে চিন্তাশীল হওয়াটা আমাদের শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত। বিবর্তনের ফলে মানুষ দুপায়ে ভর দিয়ে খাড়া মেরুদণ্ডে হাঁটার অধিকারী হয়েছে, দুহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ব্যবহারের মাধ্যমে হাতকে দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ ব্যবহার করতে শিখেছে। এর সাথে মানুষ যখন ভাষার ব্যবহার শিখেছে তখনই কেবল মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবে পরিণত হয়েছে।

যদিও বিবর্তনবাদ প্রাণ সৃষ্টির ওপর আলোচনা করে না তবুও প্রাণ সৃষ্টির ওপর সামান্য আলোকপাত করার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের এ পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। পৃথিবী সৃষ্টির প্রায় ১০০ কোটি বছর পরে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ ঘটে। আরো বিশদভাবে বললে বলতে হয় প্রাণের উপাদান DNA (Deoxyribonucleic acid) গঠিত হয়। ডিএনএ গঠিত হওয়াটাই প্রাণের বিকাশ হতো না যদি না তা বিভাজনক্ষম না হতো। আবার ডিএনএ গঠিত হতো না যদি ডিএনএ গঠিত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত এমাইনো এসিড সৃষ্টি না হতো।

প্রাণ সৃষ্টির ব্যাপারে বর্তমানে সর্বজনবিদিত তত্ত্বটির নাম ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব, যাকে আদি স্যুপ তত্ত্বও (Primordial Soup) বলা হয়। যা মূলত প্রাণের রাসায়নিক উপপত্তিকে ব্যাখ্যা করে। রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ওপারিন ১৯২৭ সালে প্রাণের রাসায়নিক উৎপত্তি নিয়ে প্রথম বই লেখেন যা বর্ধিত আকারে ১৯৩৮ সালে ‘The Origin Of Life’ নামে প্রকাশিত হয়। প্রায় একই সময়ে বিজ্ঞানী হালডেন ওপারিনের কাজের ব্যাপারে কিছু না জেনেই প্রাণের রাসায়নিক উৎপত্তি নিয়ে আরেকটি বই লেখেন। যদিও তাদের দুজনের আগেই বিবর্তনবাদের জনক ডারউইন প্রায় একইরকম ধারনা দিয়ে গিয়েছেন তার বন্ধু জোসেফ হুকারকে লেখা এক চিঠিতে। হুকারকে লেখা চিঠিতে ডারউইন লিখেছিলেন, “একটা ছোট উষ্ণ পুকুরে বিভিন্ন ধরণের অ্যামোনিয়া, ফসফরিক লবন, আলো, তাপ, তড়িত সবকিছু মিশে প্রোটিন যৌগ উৎপন্ন হয়েছে।“

সাড়ে চারশ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবী ছিল প্রচণ্ড গরম, তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৫০০০-৬০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তখন বায়ুমণ্ডলে কোন মুক্ত অক্সিজেন ছিল না। আকাশ আর পৃথিবী ছিল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, নাইট্রোজেন, মিথেন, অ্যামোনিয়ার মত বিষাক্ত গ্যাসে পূর্ণ। সাথে ছিল জলীয় বাষ্প এবং কিছু খনিজ পদার্থ। পরে পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ তাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে আর সূর্যের মহাকর্ষের টানে অধিকাংশ প্রাথমিক গ্যাসগুলো উড়ে চলে যায়। অক্সিজেনের পুরোটুকু বিভিন্নি ধরণের পরমানুর সাথে মিলে নানা ধরনের অক্সাইড তৈরি করে। কার্বনও বিভিন্ন ধাতুর সাথে যুক্ত হয়ে তৈরি করে নানা ধরনের মেটাল কার্বাইড। তৈরি হয় ধীরে ধীরে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, সিলিকন-ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড আর সামান্য পরিমানে হাইড্রোজেন, মিথেন, কার্বন-মনো-অক্সাইড ও হাইড্রোফ্লোরিক এসিড ইত্যাদি। বায়ুমণ্ডলের বাইরে কোন ওজোন স্তর না থাকায় সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি খুব সহজেই পৃথিবীতে এসে পৌঁছাত। এর সাথে এক্স রশ্মি, গামা রশ্মি, কস্মিক রশ্মিগুলোর বিকিরণ, আর সেই সাথে বৈদ্যুতিক বিকিরণও ছিল আজকের দিনের চেয়ে বহুগুণে বেশি। ওপারিন এবং হালডেনের মতে এমন একটি প্রাণহীন পরিবেশে একটা সময় এসব গ্যাসের ওপর উচ্চশক্তির বিবিরণের প্রভাবে নানা ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্তের উদ্ভব হয়। এগুলো পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যে বিক্রিয়ার মাধ্যমে আরো জটিল জৈব পদার্থ উৎপন্ন করে। এগুলো থেকেই পরবর্তীতে ঝিল্লী তৈরি হয়। ঝিল্লিবদ্ধ এসব জৈব পদার্থ বা প্রোটিনয়েড ক্রমে ক্রমে এনজাইম ধারণ করতে থাকে আর বিপাক ক্রিয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। এটি একসময় এর মধ্যকার বংশগতির সংকেত দিয়ে নিজের প্রতিকৃতি (replication) তৈরি করতে ও পরিব্যক্তি (mutation) ঘটাতে সক্ষম হয়। এবাবেই একটা সময় তৈরি হয় প্রথম আদি ও সরল জীবনের। তবে এ স্তরে জীবন ছিল অকোষীয়; পরে তা থেকে কোষীয় জীবের উদ্ভব হয়। এ তত্ত্বটির মূল নির্যাসটি হল অজৈবজনি (abiogenesis)- অর্থাৎ, অজৈব জড় থেকে জীবের উৎপত্তির নিদর্শক।

ওপারিন-হালডিন তত্ত্বের প্রমাণ এখন যে কোন কলেজ ল্যাবরেটরীতেও করা হয়। আমাদের কৃষকরা যে ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন এটাও একটি জৈব যৌগ যা অজৈব পদার্থ দিয়ে তৈরি। প্রকৃতিতে জৈব যৌগ না হয় তৈরি হল, কিন্তু তাতে প্রাণ সঞ্চার হবে কীভাবে?’ এমন প্রশ্নের সমাধান আসল ২০১০ সালের ২০ মে। বিজ্ঞানী ক্রেগ ভেন্টর কৃত্রিম প্রাণ সৃষ্টির মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের প্রতি ছোড়া সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটিরও জবাব দিলেন। এ বিষয়ে বিশদ জানতে ইন্টারনেটে ‘Artificial Life/Synthetic Life’ লিখে সার্চ দিয়ে পড়ে নিতে পারেন। বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের লেখাটি পাবেন এখানেঃ https://blog.mukto-mona.com/2010/05/21/7253/

অজৈব পদার্থ থেকে জৈব যৌগ তথা প্রাণ সৃষ্টির উপাদান সৃষ্টি হওয়াকে বলে অজৈবজনি (Abiogenesis) এবং অজৈবজনির মাধ্যমে সৃষ্ট প্রাণের মাধ্যমে প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়াটির নাম জৈবজনি (Biogenesis)। প্রাকৃতিক অজৈবজনি ঘটার পর প্রাণীর আদি অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থায় উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়াটিই বিবর্তনবাদ।

বিবর্তন বা জৈববিবর্তন হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জীবদেহের জেনেটিক কোডে পরিবর্তনের মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব। জিন হলো জীবকোষের ক্রোমোসোমে অবস্থিত ডিএনএ নামক একটি বিশেষ অনুর অভ্যন্তরস্থ একটি বিশেষ কোড। প্রাণীর বৈশিষ্ট্যসমূহকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়; অর্জিত এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। অর্জিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেগুলো যেটা জন্মের পর আমরা আমাদের পরিবেশ থেকে দেখে-শুনে শিখে অর্জন করি। আর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা পেয়ে থাকি বাবা-মার কাছ থেকে আমাদের জন্মের পূর্বেই, ভ্রুণগঠনের সময়। আর বাবা-মার এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের কাছে বয়ে নিয়ে আসে জিন।

দুটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তন ঘটে থাকে। মিউটেশন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন। ভ্রুণ তৈরির সময়ে যে ডিএনএ রেপ্লিকেশন ঘটে তাতে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অবিকল প্রতিকৃতি তৈরী হয়। কিন্তু প্রকৃতিতে কোন জটিল প্রক্রিয়াই নির্ভুল নয়। যখন ভুল ঘটে তখন জীবের জিন পরিবর্তিত হয়। আর এই পরিবর্তিত জিন প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়। এই প্রক্রিয়ার নামই মিউটেশন। মিউটেশন প্রক্রিয়ার কারণে উত্তরসূরী প্রজন্ম পূর্বসূরীদের চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যধারী জিন বাহক হতে পারে। মিউটেশনের কারণে একই প্রজাতির কয়েকটি প্রকরণ তৈরী হয়। এর মধ্যে কিছু প্রকরণ থাকবে প্রকৃতির সাথে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী, আর কিছু হতে পারে অনুপযুক্ত। অনুপযুক্ত প্রকরণগুলো বিলুপ্ত হবে, যার কারণে তার জিনগুলো হারিয়ে যাবে এবং উপযুক্ত প্রকরণগুলোর জিনগুলো টিকে যাবে। ভৌগোলিক ভাবে বিচ্ছিন্ন একই প্রজাতির দুটি পপুলেশনের মধ্যে মিউটেশন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে পার্থক্য ক্রমশ বেড়েই চলে। এভাবে একসময় তাদের মধ্যে এত বেশি পার্থক্যের সৃষ্টি হয় যে তারা দুই গ্রুপের মধ্যে প্রজননের মাধ্যমে প্রজননক্ষম সন্তান ধারণে অক্ষম হয়ে পরে। এভাবেই নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়।

এত অল্প পরিসরে একইসাথে প্রাণের সৃষ্টি ও বিবর্তন নিয়ে লেখা কষ্টকর। বিবর্তনবাদ নিয়ে কিছু বিতর্ক তথা ভ্রান্তিকর প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে শেষ করছি।

১. বিবর্তনবাদ শুধুই একটি তত্ত্ব, এর মধ্যে কোন বাস্তবতা নেই।

সাধারন অল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে জাকির নায়েক পর্যন্ত এ বাক্যটি বলে থাকে। সাধারন মানুষ যা বলে তা ভুল কেননা তারা বিবর্তনবাদও জানে না, তত্ত্ব ও বাস্তবতার পার্থক্য সম্পর্কেও জানে না। কিন্তু জাকির নায়েকের মত লোক তত্ত্ব (Theory) ও বাস্তবতা (Fact) এর পার্থক্য জেনেও এটা বলে থাকেন। সেটাকে ভুল না বলে মিথ্যা বলাই যুক্তিসংগত। কোন পর্যবেক্ষণ যখন বারংবার বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয় তখন তাকে বাস্তবতা (Fact) বলে ধরে নেয়া হয় এবং তত্ত্ব হচ্ছে এই বাস্তবতা কীভাবে ঘটছে সেই প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা। একটা উদাহরণ দিয়ে তত্ত্ব ও বাস্তবতার পার্থক্য দিচ্ছি। আপেল মাটিতে পড়ে এটা হচ্ছে বাস্তবতা এবং আপেল যে মহাকর্ষের টানে মাটিতে পড়ছে সেটা হলো নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব। জাকির নায়েক আরো বলে থাকেন যে বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিবর্তন নিয়ে সন্দিহান। কিন্তু এটা আদৌ সত্য নয়। বর্তমান সময়ের কোন জীববিজ্ঞানীই জীবের বিবর্তন নিয়ে সন্দিহান নয়, বিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ে অল্প কিছু বিজ্ঞানীর দ্বিমত রয়েছে। জাকির নায়েক এ বিষয়টিও বুঝতে ভুল করেছেন অথবা জেনে শুনেও মানুষকে ভুল বুঝানোর জন্য মিথ্যা বলছেন। জাকির নায়েকের বিবর্তন বিষয়ক জ্ঞান যে প্রায় শূণ্যের কোঠায় তা দেখতে পারেন এখানে। http://www.sachalayatan.com/shikkhanobish/21894

২. দু-চারটি আংশিক ফসিল বা হাড়গোড় পেয়েই বিজ্ঞানীরা বিবর্তনের স্বপক্ষে বড় বড় সিদ্ধান্ত টানেন।

বিজ্ঞানের সাথে যাদের খুব গভীর সম্পর্ক নেই তারাই বিজ্ঞান সম্পর্কে এমন কথা বলতে পারেন। বিজ্ঞানীরা ধর্মতাত্ত্বিকদের মত তিলকে তাল করে প্রচার করতে পারেন না, মূলত বিজ্ঞান প্রচারেরই বিষয় নয়। অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তথ্য, উপাত্তের ভিত্তিতেই কোন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ডারউইন বিবর্তনবাদ নিয়ে যখন বই লেখেন তখন তার হাতে এ তত্ত্ব প্রমাণ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত (জীবাশ্ম) ছিল না। তাই বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরাই সেটা গ্রহণ করেন নি। বর্তমানে বিবর্তনবাদ প্রমাণ করার জন্য বিবর্তনের মধ্যবর্তী অবস্থার জীবাশ্মসহ এত বেশি জীবাশ্ম রয়েছে যে এ কথা কোন জীববিজ্ঞানীর কাছে বললে বক্তা বিজ্ঞানীর কাছে একটি হাস্যকর বস্তুতে পরিণত হবেন।

৩. বানর থেকে মানুষের উদ্ভব ঘটলে এখনো বানরগুলো পৃথিবীতে রয়ে গেল কী করে?

বিবর্তন সম্পর্কে এই প্রশ্নটিই সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। সামান্যতম বিবর্তন-জ্ঞান থাকলেও কেউ এমন প্রশ্ন করবে না। বিবর্তনবাদ কখনোই বলেনি যে বানর থেকে মানুষের উদ্ভব ঘটেছে। বিবর্তনবাদ বলছে মানুষ এবং বানরসহ অন্যান্য বনমানুষগুলো অনেক অনেককাল আগে একই পূর্বপুরুষ হতে উদ্ভুত হয়ে বিবর্তিত হয়ে আলাদা আলাদা প্রজাতির ধারা তৈরি করেছে। ব্যাপারটাকে একটা গাছের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। একই গাছের বিভিন্ন ডালে বিভিন্ন প্রজাতি অবস্থান করছে। মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি ডালে রয়েছে শিম্পাঞ্জি। শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের জিনোমের ৯৯% মিল রয়েছে। মানুষসহ সকল প্রাইমেটদের (Primate) একই পূর্ব পুরুষ ছিল আজ থেকে ১.৪ কোটি বছর পূর্বে। ঐ পূর্ব পুরুষ থেকে গরিলার বিবর্তন ঘটে ৯০ লক্ষ বছর পূর্বে এবং শিম্পাঞ্জি ও মানুষের বিবর্তন ঘটে ৬০ লক্ষ বছর পূর্বে। একসময় মানুষেরও অনেকগুলো প্রজাতি ছিল। বর্তমানের সব মানুষই Homo Sapiens. অন্য প্রজাতিগুলো হারিয়ে গিয়েছে।

বিজ্ঞানের প্রতি আমাদের ভীতি ও অনাগ্রহ খুব স্পষ্ট। দেখা যায় যে- আমাদের স্কুলগুলোতে কেবল মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরই বিজ্ঞানে ভর্তি করানো হয়, ছাত্র-অভিভাবকদের বুঝানো হয় যে বিজ্ঞান খুব কঠিন বিষয়। বিজ্ঞানের অনেক বিষয়ই বেশ জটিল, তবে বর্তমানে আবদুল্লাহ আল মুতী, জাফর ইকবালসহ বর্তমান প্রজন্মের অনেক তরুণ বিজ্ঞান লেখকই বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলোকে সহজভাবে উপস্থাপন করে বাংলা ভাষায় বই লিখছেন, যা দিয়ে সহজেই বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো জানা যেতে পারে। জটিল বিষয়গুলো কেবল বিজ্ঞানীরাই জানুক, ওটা জানা আমার দরকারই বা কী! আমরা সহজভাবে বিজ্ঞানের পাঠ নিতে পারি। আপনার শিশুকে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করতে আপনার নিজেরই এ শিক্ষার দরকার আছে। আপনার শিশুটি যদি জিজ্ঞেস করে যে গাছের পাতা সবুজ কেন? বা দিন-রাত হয় কেন? তার উত্তরে কি আপনি বলবেন যে আমি বিজ্ঞানে পড়িনি তো, তাই জানি না? আপনি কোন বিভাগে পড়েছেন সেটা বিষয় নয়, বর্তমানে যিনি লেখা পড়তে পারেন তিনিই বিজ্ঞান শিখে নিতে পারেন। জিন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। শিশুবেলা থেকে সকল শিশুকে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারলে আমাদের দেশে আরো এমন বড় বড় বিজ্ঞানীর সৃষ্টি হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে আমাদের শিশুরা শিশুবেলায়ই পরিবার ও বিদ্যালয় থেকে ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানের নামে এমনসব অপবিজ্ঞান শিখে যে তারপর তার মাথায় বিজ্ঞান ঢুঁকানো এক দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আশাবাদী মন তবুও স্বপ্ন দেখে- আমাদের রাজনীতিবিদদের ভোটের চেয়ে দেশের প্রতি সুমতি হবে, শীঘ্রই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হবে এবং জীববিজ্ঞানের সিলেবাসে বিবর্তনবাদও আবার ফিরে আসবে।

প্রবন্ধটি লিখতে ইন্টারনেট থেকে নেয়া কিছু তথ্য বাদেও যেসকল বইয়ের সাহায্য নেয়া হয়েছে।

১. বিবর্তনের পথ ধরে (২০০৭)-বন্যা আহমেদ, অবসর প্রকাশনা সংস্থা। মুক্তমনা ইবুক Web Address:  https://mukto-mona.com/Articles/bonna/book/

২. মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭), ড. অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমদ, অবসর প্রকাশনা সংস্থা মুক্তমনা ইবুক Web Address: https://mukto-mona.com/Articles/life/

৩. ডারউইনঃ একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা ও ভাবনা (২০১১), সম্পাদনাঃ অনন্ত বিজয় দাস, অবসর প্রকাশনা সংস্থা।

৪. বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২), সম্পাদকঃ ড. অভিজিৎ রায়, শহীদুল ইসলাম ও ফরিদ আহমদ, চারদিক প্রকাশনী।

ধন্যবাদ

রতন কে সমাদ্দার

You may also like...