বিদায় হজ

‘বিদায় হজের ভাষণ’ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে অমুসলিম লিবারালরা, কম জানা মুসলিম ও বামপন্থিরা। কোন আলেম বিদায় হজের ভাষণ দেখিয়ে মুসলমানকে অন্যের ধর্মের ব্যাপারে শান্ত থাকতে বলে না। এই ভাষণ দেখিয়ে আজ পর্যন্ত কোন আলেম মুসলমানদের কাফের মুশরিকদের ব্যাপারে সহিষ্ণু হতে বলেনি। যদি এই ভাষণে সত্যিই এরকম কোন দিক নির্দেশনা থাকত তাহলে তারা এরকমটা করত। কারণ তারা সত্যিকার অর্থেই আল্লাহ নামের একজনকে ভয় করে এবং বিশ্বাস করে তার কথা না শুনলে বড় বড় আগুনের চুল্লিতে তাদের নিক্ষেপ করা হবে। প্রাচীন গ্রীসে এ্যাপোলো জিউসের মন্দিরে যেভাবে ধার্মীকরা জিউস আর এ্যাপোলের ভয়ে কাঁপত, তাদের কাছে কিছু চেয়ে কান্নাকাটি করত, অবিকল সেই একই রকম রয়ে গেছে ধার্মীকদের মনস্তাত্বিক চরিত্র। কাজেই যদি নুন্যতম মানুষ্যত্ব বা সমগ্র মানবজাতির প্রতি বিদায় হজে কোন শান্তির কথা থাকত তাহলে আলেমরা সেটি বলতেন। তারা খুব ভালো করে জানেন, ইসলাম কোন কাফের মুশরিককে সহ্য করার কথা বলেননি। আসুন দেখি বিদায় হজের বক্তব্যগুলোতে কি বলা হয়েছে।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মেয়ে অরমা দত্ত সম্প্রতি নুসরাত নামের মাদ্রাসা ছাত্রীর গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়ার পর তিনি মানুষকে হযরত মুহাম্মদের বিদায় হজের ভাষণ থেকে শিক্ষা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। একইভাবে সাফা করিমের পরকাল বিশ্বাস না করার বক্তব্য দেয়ার পর তাকে হত্যা ধর্ষণ করার জন্য মুমিনরা আগ্রহ জানালে কেউ কেউ বিদায় হজ থেকে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার শিক্ষা নিতে মুমমিনদের পরামর্শ দিতে দেখলাম। এই ভাষণটি ইসলামের চিচিংফাঁক ঢাকতে সব সময় ব্যবহার করা হয়। অমুসলিম লিবারাল, ‘হুইন্না মুসলমান’ ও বামপন্থিদের খুব পছন্দ বিদায় হজ। অরমা দত্ত বলেছেন, বিদায় হজে তিনটা প্রধান বিষয় মুহাম্মদ(সা) বলে গেছেন। একটা হলো, তুমি কোন নারীর প্রতি অবিচার করবে না। দ্বিতীয়টি হলো, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। সব ধর্মকে সমান মর্যাদা দিবে। তৃতীয়টি হলো, সুদের ব্যাবসা করবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে অরমা দত্ত নিজে এই ভাষণটি পড়েছেন নাকি কোটি কোটি ‘হুইন্না মুসলমানের’ মতই তিনি এসব লোক মুখে শুনেছেন? দেখা যাক বিদায় হজে নারীদের সম্পর্কে কি বলা আছে। এই ভাষণে নারীদের প্রসঙ্গে মুহাম্মদ তার সঙ্গীদের বলেন, (১) স্ত্রীর জন্য স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোন জিনিস অন্য কাউকে দেয়া জায়েজ নয়। এটা কি নারীদের সন্মানিত করেছে নাকি নারীকে পুরুষের অধিনস্থ করে রাখা হলো? একজন নারী সাংসদ হিসেবে তিনি কি নিজেকে পুরুষের অধিনস্ত মনে করেন? স্বামীর অনুমতি ছাড়া যে নারীরা অন্যকে কোন জিনিস দান করার অধিকার না রাখেন তারা কেমন করে আইন প্রণয়ন করবে?

(২)হে মানবমন্ডলী! তোমাদের উপর তোমাদের নারীদের অধিকার রয়েছে এবং তাদের উপরও তোমাদের সুনির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। স্ত্রীদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখবে এবং তাদের জন্য খাদ্য ও বস্ত্রের সংস্থান করবে। তোমরা যাদেরকে পছন্দ করনা তাদেরকে তারা যেন বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে এবং কোনরূপ বেহায়াপনায় লিপ্ত না হয়।… এগুলো হচ্ছে দাসীবাদীদের প্রতি মনিবের ভালো ব্যবহার করার মত ব্যাপার। স্বামী যাদের পছন্দ করবে না স্ত্রীও তাদের পছন্দ করবে না। এখানে নারীর স্বাধীন সত্ত্বাটা কোথায় স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে? কেমন করে এই ভাষণে নারীদের সন্মানিত করা হলো?

এরপর থাকে ‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। সব ধর্মকে সমান মর্যাদা দিবে’। এরকম কিছু বিদায় হজে মুহাম্মদ বলেছিলেন কিনা সেটি এখন চেক করা দরকার। মুহাম্মদ তার জীবনের শেষ হজে গিয়ে আরাফাতের ময়দানে ভক্তদের উদ্দেশ্যে ভাষণে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘তোমরা কিন্তু দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করিও না। কারন তোমাদের পূর্বেও মানুষকে এসব কারনে ধ্বংস কোরে দেয়া হয়েছে’। এই “দ্বীন’ মানে হচ্ছে ইসলাম। এই ইসলাম নিয়ে কোন রকম বাড়াবাড়ি করতে মানা করা হয়েছে। কি সে বাড়াবাড়ি? এটা হচ্ছে ইসলামের মধ্যে কুরাইশ, আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে চাপা অসন্তোষ। কুরাইশরা আত্মসমর্পন করার পর তাদের হাতেই কাবাঘরের চাবি তুলে দেয়া হয়েছিলো। এতে বাকীদের মন:ক্ষুণ্ণ হবার যথেষ্ঠ কারণ ছিলো। কারণ যারা এতদিন চরম বিরোধীতা করেছিলো তাদেরকেই কাবাঘর ও হজের দায়িত্ব কেন দেয়া হলো? এই অসন্তোষ মুহাম্মদ জা্নতেন বলেই ভাষণে প্রথমে তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশী সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে আল্লাহ’কে বেশী ভয় করে চলে। সুতরাং কোন আরব যেমন অন্য কোন অনারব বা আজমী ব্যক্তির তুলনায় মোটেও শ্রেষ্ঠ নয়, তেমনি কোন অনারব বা আজমী ব্যক্তিও কোন আরব ব্যক্তির তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়। কালো ব্যক্তিও সাদা ব্যক্তির তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়, তেমনি সাদা ব্যক্তিও কালো ব্যক্তির তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়। হাঁ, মর্যাদা ও সম্মানের যদি কোন মাপকাঠি থাকে, তবে তা হলো একজন ব্যক্তির তাকওয়া বা পরহেজগারী’।

খুবই উদার কথাবার্তা মনে হলেও এখানে কেবল মুসলমানরাই গোণ্য হবে কারণ তাদের জাতপাতহীনতার উর্ধে উঠে সবাইকে মুসলমান হতে হবে। এখানে মুসলমানকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। হোক সে হাবসি বা আরব বা অনারব। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করায় এখন সবাই সমান। তারাই শ্রেষ্ঠ। কাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? কাফের, মুশরিক ইহুদী নাসারা পৌত্তলিকদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। মুহাম্মদের বংশ কুরাইশ হওয়ায় কুরাইশরা বেশি মাতব্বরী করায় ক্ষুব্ধ ছিলো অন্যান্য গোত্র ও বংশপতিরা। এ কারণে ভাষণে কুরাইশদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছিলো, হে কুরাইশগণ! আল্লাহ্ মিথ্যা অহংকার-অহমিকা নির্মূল করে দিয়েছেন। সুতরাং বাপ-দাদার কীর্তি-কাহিনী নিয়ে অহংকার করার আর কোন অবকাশ নাই।

বিদায় হজের যে লাইনগুলি নিয়ে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য করা হয় তার অন্যতম হলো, ‘হে মানবমন্ডলী! তোমাদের রক্ত, ধন-সম্পদ ও ইজ্জত পরস্পরের জন্য চিরস্থায়ীভাবে হারাম করা হলো। আজকের এই দিন এই পবিত্র মাস বিশেষভাবে এই শহরে অবস্থান কালে তোমরা যেভাবে এর গুরুত্ব দিয়ে থাক- এসব বিষয়ের গুরুত্বও ঠিক তদ্রুপ। তোমাদের সকলকেই আল্লাহ্’র দরবারে হাজির হতে হবে এবং তিনি তোমাদের কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন’। এখানে “হে মানমন্ডলী” বলতে সমগ্র মানব জাতিকে বুঝানো হয়েছে ধরে নিলে আপনি বোকার স্বর্গে বসে আছেন। এখানে মানবমন্ডলী মানে কেবলই মুসলমানরা। অমুসলিমরা মানুষের ক্যাটাগরিতে পড়ে না কারণ তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। এটা সপক্ষে দলিল হচ্ছে ভাষণে এরপরই বলা হয়েছে, “হে মানবমন্ডলী! একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমের দ্বীনি ভাই। মুসলিমগণ পরস্পর ভাই-ভাই”।

একদম পরিস্কার মানবমন্ডলী বলতে এখানে মুসলমানকেই বুঝানো হয়েছে। কারণ মুহাম্মদ এই হজের পর এক বছরের মত বেঁচে ছিলেন। তিনি অসুস্থ অবস্থায় তার অন্তিম ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন এভাবে, ‘ইহুদী ও নাসারাদের আরব থেকে বের করে দেব, এখানে মুসলিম ছাড়া কেউ থাকবে না (আবুদাউদ-৩০২০)। হযরত ওমর নবীর এই ওছিয়ত পূরণ করতে নাজরান ও ফিদকের ইহুদীদের আরব ভূমি থেকে বের করে দেন (আবুদাউদ-৩০২৪)।

বিদায় হজে মুহাম্মদ বলেন, ‘অন্ধকার জাহেলিয়্যাতের সকল নাম-নিশানা আমি পদতলে নিক্ষিপ্ত করেছি’।…আমি তোমাদের মাঝে এমনই দু’টি বস্তু রেখে যাচ্ছি, যতদিন তোমরা তা মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। বস্তু দু’টি হচ্ছে আল্লাহ্’র কিতাব আল-কুরআন ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত। আর হ্যাঁ, তোমরা কিন্তু দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করিও না। কারন তোমাদের পূর্বেও মানুষকে এসব কারণে ধ্বংস কোরে দেয়া হয়েছে’।

কুরআন হাদিসকে যদি মুসলমানরা আকড়ে থাকে তাহলে অরমা দত্তরা কি এদেশে থাকতে পারবেন? তার বাবা ধরীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিলেন ইসলামিক ও মুসলমানের দেশ হওয়া সত্ত্বেও। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলার করার দাবী তিনিই প্রথম ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ হওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছিলো। একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সেটা সুদে আসলে বুঝিয়ে দিয়েছিলো। তারই কন্যা হয়ে অরমা দত্ত মদিনা সনদের কথা বলেন। বিদায় হজের দোহাই দেন! তাদের যখন সেক্যুলারিজমের কথা বলা দরকার, তারা তখন একজন ধর্মীয় নেতার বিদায় হজের রেফারেন্স টানেন যিনি কিনা তার অনুসারীদের কুরআন হাদিসের দড়ি শক্ত করে ধরে থাকতে বলেছেন! যিনি ‘জাহেলিয়া যুগের সব কিছু পদনত’ করাকে গর্বিতভাবে ভাষণে বলেন সেই ভাষণ থেকে অরমা দত্ত মুসলমানদের শিক্ষা নিতে বলেন। মক্কা বিজয়ের পর কুরাইশদের একটাও মন্দির মূর্তি মুহাম্মদ আস্ত রাখেননি। খালিদ বিন ওয়ালিদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সমস্ত মূর্তি ধ্বংস করে দিতে। যিনি আরব ব-দ্বীপ থেকে সমস্ত ইহুদী বের করে দেয়ার কথা বলেন তিনি আজ শান্তির দূত! অরমা দত্তরা কি এদেশের তাদের নেক্স জেনারেশনদের থাকার কথা চিন্তা করেন? নাকি নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন?

ধন্যবাদ

You may also like...