রবীন্দ্রনাথের চিঠি…
এনাকে চিনতে পারছেন? উনি বিশ্বসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গত ২৫শে বৈশাখ যার জন্মদিন ছিল!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পত্রসমূহ বাংলা সাহিত্যকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। কবি তাঁর জীবনের গভীরতম ভাষ্য ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে উল্লেখ করেছেন। তিনি জীবনে যে পরিমাণ চিঠি লিখেছেন তা আর কোনো সাহিত্যিক লেখেননি। তাঁর চিঠি কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। প্রধান দু’টি শ্রেণী হচ্ছে আত্মউদঘাটনমূলক পত্র এবং প্রয়োজন নির্ভর পত্র। তিনি এক জীবনে যে চিঠি লিখেছেন ছাপালে দশ হাজার পৃষ্ঠার বই হবে। স্বাভাবিকভাবেই পাঠকমাত্র প্রশ্ন করবেন তা হলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় কতগুলো চিঠি লিখেছিলেন? এই চিঠির পরিমাণ পাঁচ হাজারেরও বেশি। চিঠিগুলো তিনি লিখেছিলেন পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে। বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করা প্রায় ৪ হাজার চিঠি মুদ্রিত হয়েছে সাময়িক পত্র-পত্রিকায়। এই চিঠিগুলো তিনি লিখেছিলেন ৩২০ জনকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু চিঠি লিখতে নয়, পেতেও ভালোবাসতেন। তিনি সম্ভবত কখনও ভাবেননি তাঁর চিঠিগুলো পত্রিকার পাতায় ছাপা হবে অথবা বই আকারে প্রকাশ পাবে। তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ সদ্য তরুণ বয়সেই পাওয়া যায়। ফলে সে সময় চিঠির প্রাপকরা বুঝে ফেলেছিলেন বাংলাসাহিত্যের উজ্জ্বল রবি’র আলোর ঝলকানি। তাই তাঁরা চিঠিগুলো যত্নসহকারে রেখেছিলেন। চিঠিতেই প্রকৃত আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ যাঁদের কাছে চিঠি লিখেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন : নির্মলকুমারী মহলানবিশ, আন্নদাশঙ্কর রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (কথাসাহিত্যিক), প্রমথ চৌধুরী, দীনেশচন্দ্র সেন, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নন্দগোপাল সেনগুপ্ত, নন্দলাল বসু, নেপালচন্দ্র রায়, নির্ঝরিনী দেবী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (রবীন্দ্র জীবনীকার), প্রতিমা দেবী, প্রিয়নাথ সেন, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিধুশেখর শাস্ত্রী, বুদ্ধদেব বসু, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, মীরা দেবী, মৃণালিনী দেবী, মৈত্রেয়ী দেবী, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শান্তা দেবী, শীশচন্দ্র মজুমদার, সুধাকান্ত রায় চৌধুরী, স্বর্ণ কুমারী দেবী এবং ইন্দিরা দেবী।
চিঠির জন্য কবির ব্যাকুলতার তীব্রতা প্রকাশ পেয়েছে ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘পত্রের প্রত্যাশা’ কবিতায়। এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, চিঠি কই, কই চিঠি। ‘চিঠি’ নামে কবিতাটি আছে ‘পূরবী’তে। ‘পত্র’ শিরোনামেও তাঁর কয়েকটি কবিতা আছে বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে। স্বামীর দুর্লভ কয়েকটি চিঠি স্ত্রী অমূল্য সম্পদের মতো সযতনে সংগোপনে রেখেছিলেন। কবির ‘স্মরণ’ কাব্যের একটি কবিতায় এ ঘটনাও ফুটে উঠেছে। এখানে কি কবি স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর কথাই বলেছেন? কেননা মৃণালিনী দেবীকে কবি যে চিঠিগুলো লিখেছিলেন সেগুলো তিনি সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠিগুলো অবিষ্কার করেন। ‘স্মরণ’-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন :
‘দেখিলাম খানকায় পুরাতন চিঠি
স্নেহমুগ্ধ জীবনের চিহ্ন দু’চারটি
স্মৃতির খেলনা-কটি বহু যত্ন করে
গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলেন যারে…
জগতের কারো নয়, তবু তারা আছে
তাদের যেমন তব রেখেছিলে স্নেহে
তোমাকে তেমনি আজ রাখেনি কি কেহ?’
কবির পত্রসম্ভার যে কালস্রোতে হারিয়ে যাবার নয় তার প্রমাণ মেলে লোকান্তরিত স্ত্রীর প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই জিজ্ঞাসায়। তার চিঠি আমাদের বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। স্বামী রবীন্দ্রনাথ স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে সুখে-দুঃখে মেশানো দাম্পত্য জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে। সুখপাঠ্য এসব চিঠি একগুচ্ছ দলিল। ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিসমূহে কবিজীবনের গভীরতম ভাষ্য ফুটে উঠেছে। এইসব চিঠিই ‘ছিন্নপত্রাবলী’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ সর্বাধিক চিঠি লিখেছেন নির্মলকুমারী মহলানবিশকে। ১৯২৫ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত চিঠি লিখেছিলেন প্রায় পাঁচশ। এই চিঠিগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত্য সৃষ্টির এক অসামান্য নিদর্শন। ব্যক্তি এখানে তুচ্ছ বা গৌণ – সৃষ্টিকর্মই উজ্জ্বল এখানে। নির্মলকুমারীকে লেখা চিঠি থেকে ৬৪টি চিঠি নিয়ে সংকলিত হয়েছে ‘পথে ও পথের প্রান্তে’ বই। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘তাঁর চিঠি হল ভিড়ের আড়ালে অন্তরঙ্গ মানুষের সঙ্গে আলাপ প্রতিলাপ তা সর্বসাধারণের সাহিত্য দরবারে উপস্থাপিত করবার নয়’। যদিও এ কথা থেকে তিনি পরে সরে এসেছিলেন।
ভিড়ের আড়ালে অন্তরঙ্গজনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ যে সাহিত্য তার প্রমাণ কবির ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে লেখা ছিন্নপত্রাবলী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে ইন্দিরা দেবীকে চিঠি লিখেছিলেন শিলাইদহ থেকে। এই চিঠির প্রতিটি শব্দ এবং বাক্যে কবির সাহিত্য সৃষ্টির অসাধারণ দক্ষতা লক্ষ্য করা যায়।
‘আমি প্রায়ই মনে করি, এই তারাময় আকাশের নীচে আবার কি কখনও জন্মগ্রহণ করব? যদি করি, আর কি কখনও এমন প্রশান্ত সন্ধ্যাবেলায় এই নিস্তব্ধ গোরাই নদীটির উপর বাংলাদেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে জলিবোটের উপর বিছানা পেতে থাকতে পাব? হয়তো আর কোন জন্মে এমন একটি সন্ধ্যাবেলা আর কখনো ফিরে পাব না। তখন কোথায় দৃশ্যপরিবর্তন হবে। আর কিরকম মন নিয়েই বা জন্মাব। এমন সন্ধ্যা হয়তো অনেক পেতেও পারি, কিন্তু সে সন্ধ্যা এমন নিস্তব্ধভাবে তার সমস্ত কেশপাশ ছড়িয়ে দিয়ে আমার বুকের উপর এত সুগভীর ভালোবাসার সঙ্গে পড়ে থাকবে না। আমি কি এমন মানুষটি তখন থাকব? আশ্চর্য এই আমার সবচেয়ে বড় ভয় হয় পাছে আমি য়ুরোপ গিয়ে জন্মগ্রহণ করি।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৫ সালের ১৮ জুলাই শিলাইদহ থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন : ‘রথী, শিলাইদহে এসেছি।… অনেকদিন পরে জলের ধারা ও সবুজ মাঠের সংশ্রব ও নির্জন পেয়ে আমি যেন নিজের সত্যকে আবার ফিরে পেয়েছি। এখানেই সুদীর্ঘকাল থাকতে ইচ্ছা করছে। নিভৃত প্রকৃতির হাতে সুশ্রুষা আমার পক্ষে একান্ত দরকার – সে জন্যই জীবনের ও সংসারের সমস্ত জঞ্জাল ছিন্ন করে ফেলে সুদূরে পালাবার জন্যে আমার মন এত ছটফট করছিল।’
রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, দেশ-বিদেশের ভ্রমণ প্রসঙ্গ ছাড়াও পাওয়া যায় ঈশ্বর প্রসঙ্গ ও আধ্যাত্মিক ভাবনা। আছে তার কাব্য, গল্প, উপন্যাস রচনার কথা। আছে নিজের আঁকা ছবির কথা, নববর্ষের কথা, ধর্মচিন্তার বিষয়, জমিদারীর কথা, জন্মদিনের কথা, নারী প্রসঙ্গ ও স্ত্রী স্বাধীনতার কথা, পল্লী উন্নয়ন প্রসঙ্গ, পল্লী বাংলার কথা, সাময়িক পত্র-পত্রিকা ও তিনি যে সব বই পড়েছেন তার কথা, সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের কথা, সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্য সমালোচনার কথা, বিশ্বভারতীর কথা, শান্তিনিকেতনের উৎসব অনুষ্ঠানের কথা, মানবধর্মের কথা, কবি কালিদাসের কথা, রাজনীতি-সমাজনীতির কথা, শিক্ষা ও পঠন পাঠনের কথা, ইংরেজ কবিদের কথা, সংগীত প্রসঙ্গ, শিলাইদহের প্রসঙ্গ, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কথা এবং রামায়ণ মাহাভারতের কথা।
চার বছর বয়স থেকে আশি বছর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছেন। প্রথম চিঠি তিনি লিখেছিলেন বাবাকে। জমিদারী সেরেস্তার কর্মচারী মহানন্দ বাবু’র কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ চেয়ে নিয়ে ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ বাবা দেবেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখতেন। প্রথম দু’একটি চিঠি বাবার হস্তগত হলেও পরের বহু চিঠি পৌঁছোয়নি। কারণ সেরেস্তার কর্মচারীরা শিশু রবীন্দ্রনাথের এই লেখা পত্রের প্রতি শেষ পর্যন্ত তেমন আগ্রহ দেখাননি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে বাবাকে প্রথম চিঠি লেখার অভিজ্ঞতার কথা এভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘বেশ মনে আছে, আমাদের ছেলেবেলায় কোনো এক সময় গবরমেন্টের চিরন্তন জুজু রাশিয়া কর্তৃক ভারত আক্রমণের আশঙ্কা লোকের মুখে আলোচিত হইতেছিল। … এইজন্য মার মনে অত্যন্ত উদ্বেগ উপস্থিত হইয়াছিল। বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই কেহ তাঁহার এই উৎকণ্ঠা সমর্থন করেন নাই। মা সেই কারণে পরিণত বয়স্ক দলের সহায়তা লাভের চেষ্টায় হতাশ হইয়া শেষকালে এই বালকের আশ্রয় করিলেন। আমাকে বলিলেন, ‘রাশিয়ানদের খবর দিয়া কর্তাকে একখানা চিঠি লেখো তো’। মাতার উদ্বেগ বহন করিয়া পিতার কাছে সেই আমার প্রথম চিঠি। কেমন করিয়া পাঠ লিখিতে হয়, কী করিতে হয় কিছুই জানি না। দফতর খানায় মহানন্দ মুনশির শরণাপন্ন হইলাম।… এই চিঠির উত্তর পাইয়াছিলাম। তাহাতে পিতা লিখিয়াছেন, ভয় করিবার কোনো কারণ নাই, রাশিয়ানকে তিনি স্বয়ং তাড়াইয়া দিবেন।’
রবীন্দ্রনাথ শেষ চিঠি লিখেছিলেন পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে ১৯৪১ সালের ৩০ জুলাই ৭টি বাক্যের ওই চিঠিতে তিনি লেখেন : ‘তোমাকে নিজের হাতে কিছু লিখতে পারিনে বলে কিছুতে লিখতে রুচি হয় না।’ স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে তিনি লিখেছিলেন : ‘ভাই ছুটি বড় হোক্ ছোট হোক্ মন্দ হোক্ একটা করে চিঠি আমাকে রোজ লেখ না কেন? ডাকের সময় চিঠি না পেলে ভারি খালি ঠেকে।’ প্রতিদিন চিঠি পাবার আশায় তিনি ডাক বাক্সের দিকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। বালিকা বন্ধু রানুকে লিখেছেন : ‘মনে করছিলুম কাল তোমার চিঠি পাব। কালই পাওয়া উচিত ছিল। পোস্ট অফিসে কালই নিশ্চয় এসেছিল, কিন্তু পোস্টমাস্টারের অসুখ করচে বলে পশ্চিমের ডাক কাল আমাদের দেয়নি, আজ সকালে দিয়ে গেছে।’
চিঠি, ডাকঘর এবং ডাক কর্মচারী নিয়ে তাঁর লেখা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। ডাকবাবু, ডাক হরকরা, ডাকপিয়ন, ডাকঘর, চিঠি, লেফাফা, ডাক বাক্স, ইত্যাদি তাঁর কবিতা, নাটকে, কথাসাহিত্যে বারবার এসেছে। ‘পোস্টমাস্টার’ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প।
ধন্যবাদ
সাম্প্রতিক মন্তব্য