রুব আল খালির দাবেরী, লায়লা আর জাররা কাহিনি [পর্ব : ৩]

(১ম, ২য় পর্ব ইতোপূর্বে প্রকাশিত, যার লিংক নিচে)
:
সম্ভবত জনমানবহীন অন্ধকার একাকী এ বিজন ভূমে ভয়ে ঘুম হতোনা আমার। কিন্তু সকালে নাজরান থেকে রওয়ানা করে কতো ঝক্কি যে গেল আমার ওপর দিয়ে। তাই ক্লান্তি শ্রান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম এ নির্জন মরুঘরে, তা আর মনে নেই এখন। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই সকালে ঘরে এলো দাবেরী। এসেই আমাকে ডাকলো ঘুম থেকে। পাশে কোন টয়লেটও নেই। দাবেরী বললো – “এ চুইয়ে পরা ঝর্ণার জলে হাত মুখ ধুয়ে নাও। আর ‘হাম্মাম’ করতে চাইলে যেতে হবে ঐ পাহাড়ে”। আমার আগেই দাবেরী কিছু পাথর দিয়ে ড্রেন বানাতে থাকলো জমিতে। যাতে জল বাইরে না পড়ে ঠিকমত জমিতে প্রবেশ করে। আমাকেও “হাররাক” বলে হাত লাগাতে বললো তার সাথে। ঘন্টা তিনেক কাজ করলাম আমরা দুজনে। দেখলাম বুড়ো হলেও দাবেরী বেশ কর্মঠ। কোন কাজেই তার কোন শ্রান্তি নেই। ড্রেনের কাজ শেষ হলে দুজনে চললাম এবার ওর বাড়ির দিকে। খেতে হবে কিছু মানে সকালের ব্রেকফাস্ট!
:
ঘন উটের দুধের সাথে যবের আটা বা সুজি দিয়ে ফিরনির মত কি যেন তৈরি করেছে একটা। ক্ষুধা লেগেছে খুব! তাই অত চিন্তা না করে খেয়ে ফেললাম পুরোটা একটানে। দাবেরী অর্ধেকটা খেয়ে বললো – “বাহ! রাজ্জাল তুমি একটা”! আবার উট ছাগল দুম্বা নিয়ে বের হলাম দুজনে। দাবেরীর খামারের কাছে পশুগুলোকে ছেড়ে দিয়ে শশা, আলু তুলতে থাকলাম আমরা। আমাকে একাকি কাজ করতে বলে দাবেরী চলে গেল বাড়ির দিকে। ঘন্টাখানেক পর ফিরে এলো ছ’টা ঝুড়ি আর ছোট মেয়ে ফাতিমাকে নিয়ে। মেয়েটিও কাজ করতে থাকলো আমাদের সাথে। ঝুড়িতে তুলে রাখতে লাগলো শশা আর আলু। দাবেরীকে বললাম – “ফাতিমা কি তোমার ছোট মেয়ে? কয় ছেলে-মেয়ে তোমার”? বেদুঈন কৃষক দাবেরী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো -“নারে বাবা, কোন ছেলে নেই আমার। ফাতিমাসহ চার মেয়ে আমার। ফাতিমাই সবচেয়ে ছোট। বাকি ৩-মেয়ে বড়, ঘরে আছে ওরা”! বললাম – “এখানে স্কুল নেই? পড়ালেখা করেনা তোমার মেয়েরা”? দাবেরী বললো – “না তেমন স্কুল নেই, তবে ভাষা আর কোরান শিক্ষা দেয়ার মত একটা মাদ্রাসা আছে আমাদের একটা বাড়িতে। সেখানে সকাল বিকাল পড়তে যায় আমার চার মেয়েই। দুমেয়ে এখন পড়ায় ওখানে অন্য মেয়েদের”!
:
ছটা ঝুড়ি ভর্তি হওয়ার আগেই অদূরে দেখা যায় বড় তিন মেয়েকে বোরকা পরিহিত। ফাতিমা তার বাবাকে বলে যে, তার বোনরা এসেছে। ঐ অদূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আমি পরপুরুষ বলে সামনে আসছে না সঙ্কোচে কিংবা এলাকার রীতি বলে। ৩-জনের জন্য ৩টা ঝুড়ি রেডি করতে বলে দাবেরী। সে ও আমি দুটো বড় ঝুড়ি নিয়ে যাই অপেক্ষমান মেয়েদের কাছে। দাবেরী একটা তার এক মেয়ের মাথায় তুলে দেয়। বাকিটা নিয়ে আমি অপেক্ষা করতে থাকি। অন্য মেয়েটি হাতের ইশারায় কাছে ডাকে আমাকে। তার মাথায় তুলে দেই আমি বাকিটা। বাকি মেয়েটির জন্য আরেকটা আলুর ঝুড়ি নিয়ে আসি আমি। তার মাথায় সেটা তুলে দেয়ার সময় বোরকা ফাঁক করে দেখে সে আমাকে এক নজর। চেহারায় মুচকি হাসি দেখি তার! মেয়েরা ঝুড়ি মাথায় চলে গেলে বাকি কাজ করতে থাকি আমরা। জোহরের নামাজের আগেই আমরা ৩-জনে ৩-ঝুড়ি শশা আর আলু নিয়ে পা বাড়াই ওর বাড়ির দিকে।
:
নামাজ শেষ হলে মসজিদের সামনে সকল শশা আর আলুর ঝুড়ি নিয়ে বসে যাই দাবেরী আর আমি। “তালাত রিয়াল” তালাত রিয়াল বলে ডাক দেয় দাবেরী। আমাকেও ডাকতে বলে তার সাথে। আমি সুর করে বলতে থাকি “তালাত রিয়াল কিলো”, তালাত রিয়াল কিলো! তাজা শশা আর আলু বিক্রি হতে বেশি সময় লাগেনা আমাদের। কেউ নগদ টাকায় কিনে, কেউবা বাকিতে। এই ছোট্ট জনপদে প্রায় সবাই পরিচিত দাবেরীর। নতুন যারা আমাকে চেনেনা, তাদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয় দাবেরী আমাকে। নবাগত আমাকে দেখে অনেকেই পুলকিত হয়। কেউ রফিক, কেউ সাদিক, কেউবা হিন্দি আমেল বলে ডাক দেয় আমাকে। তবে মোটামুটি আরবি জানি দেখে খুশি হয় সকলে।
:
দুপুরে আবার ঐ ছেঁড়া কার্পেটে বসেছি খাবার খেতে। ঘরের ছাদে দুটো সবুজ তিনকোণা পতাকা দেখে জানতে চাই দাবেরীর কাছে এ পতাকার রহস্য। দাবেরী হেসে বলে – “আমার বড় দুমেয়ের বয়স এখন বিশ বছরের বেশী। ঘরে বিশ বছরের বড় মেয়েকে বিয়ে দেয়া জরুরী আমাদের সমাজে। তাই কারো ঘরে কোন মেয়ের বয়স বিশ বা বেশী হলে ঐ ঘরে পতাকা টানিয়ে দিতে হয়। যাতে প্রতিবশীরা বুঝতে পারে এ ঘরে বিবাহযোগ্যা বড় মেয়ে আছে”। আমি হেসে বললাম – “তো বিয়ে দিচ্ছোনা কেন তোমার মেয়েদের”। তোমারতো ৩-মেয়েই বড় দেখলাম! দাবেরী বললো – “হ্যা ছোটটার বয়স ১০, তারপরেরটা ১৮, শেষের দুটোর ২০ আর ২২”! “কিন্তু বিয়ে দিচ্ছো না কেন”? আবার প্রশ্ন করলাম দাবেরীকে। সে বললো – “আমাদের বনু ইয়াম গোত্রে পুরুষ খুব কম। এ বস্তিতে পুরুষ ৩০০-এর মত কিন্তু মহিলা প্রায় ৫০০-এর কাছাকাছি! বিয়ে দিতে পারি সতীনের ঘরে। কিন্তু আমার মেয়েরা অন্য স্ত্রী আছে, এমন পুরুষের সাথে বিয়ে বসতে রাজি না! আমার নিজেরও এক স্ত্রী! যদিও এখানের অনেকেরই ৩/৪ জন স্ত্রী। সম্ভব্ত আমি ছাড়া সবার একাধিক স্ত্রী আছে এ বসতিতে। আমিও পছন্দ করিনা সতীনের ঘরে মেয়ের বিয়ে হোক”! কথা শুনে শ্রদ্ধায় মাথা অবনত করলাম এ অশিক্ষিত কৃষক বেদুঈন দাবেরীর প্রতি।
:
খাওয়া শেষে বললাম – “তোমরা অন্য গোত্রে মেয়ে বিয়ে দিতে পারোনা? যেমন নিকটবর্তী রুব আল খালির বনু আল-মুররাহ, আল-আসহা, বানু-হাসআ বা বানু-হামদান গোত্রে”? দাবেরী অবলীলায় বললো – “আমরা কোন যুদ্ধে অংশ নেইনি বলে, অন্য গোত্রগুলো ভীরু, কাপুরুষ, নিচু গোত্র মনে করে আমাদের। এ গোত্রের মেয়ে বিয়ে করলে সন্তান ‘কাপুরুষ’ হবে মনে করে তারা! তাই আমাদের বস্তি থেকে কোন মেয়ে বিয়ে করেনা তারা কিংবা আমাদের এখানে তাদের কোন মেয়েকেও বিয়ে দেয়না”! কথাগুলো বলার সময় এক বুনো বিষণ্নতা আঁকড়ে ধরলো দাবেরী যেন! আমি বেদনাক্লিষ্ট চোখে তাকিয়ে রইলাম এ বেদুঈন অসহায় বুড়োর দিকে!
[পরের পর্ব কাল]

You may also like...