রুব আল খালির দাবেরী, লায়লা আর জাররা কাহিনি [পর্ব : ১]
:
ঢাকা থেকে নাজরান ঘুরতে এসেছি আজ সপ্তাহখানেক হলো। এখনো ফিরে যাচ্ছিনা দেশে। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি আমি এখানে। সৌদি আরবের বিখ্যাত মরুভূমি ‘রুব আল খালি’ ও এর জনবসতি ঘুরে দেখা। শুনেছি এ বিশাল উষ্ণ মরুভূমিতে আল-মুররাহ, আল-আসহা, বানু-ইয়াম, বানু-হাসআ ও বানু-হামদান গোত্রের মরুচারী বেদুঈন লোকজন বাস করে। যারা খুব একটা শহরে যায়না কখনো। উট, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা প্রতিপালন করে তারা মূলত মরুদ্যান এলাকায় এখনো সেই ১৪০০ বছর আগেকার মতই যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত। পুরো ভ্রাম্যমান বেদুইন জীবন তাদের। তবে এরা নাকি খুব অতিথি পরায়ণ। সাধারণত বহিরাগত কেউ কোন অনৈতিক কাজ না করলে, কখনো অস্ত্র ধরেনা তাদের ওপর। বরং বিপদে আশ্রয় দেয়, যে কোন মুসলিম বহিরাগতকে। নন-মুসলিমদের সম্পর্কে এদের ধারণা খুব নেতিবাচক। তাদের হত্যা করতেও তারা কখনো পিছপা হয়না। এ নরহত্যা পাপ বলেও নাকি গণ্য হয়না এ যাযাবর সমাজে!
:
সৌদি ইয়েমেন বর্ডারের নিকটবর্তী মরু বসতি আল-ফিররাহ যেতে উঠে বসলাম বেদুঈন পরিচালিত আমাদের দেশের পিকআপ টাইপ “দাব্বাব” গাড়িতে একভোরে। যারা ১০০-সৌদি রিয়ালে পৌঁছে দেবে আমাকে দার আল-ফিররাহর কাছাকাছি। মূল ফিররাহ যেতে মরু পাহাড়ি পথ ধরে আরো হাঁটতে হবে প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার। যেখানে বসবাস করে মূলত বানু-ইয়াম গোত্রের সাত আটশ মানুষ। আল-ফিররাহ এলাকাটি পুরনো লালচে পাথুরে পাহাড়ের মাঝে। তিন দিকে পাহাড় ঘেরা এলাকাটির মাঝের নিম্ন ভূমিতে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ক্ষীণ জলের ঝর্ণাধারা। যাতে সৃষ্টি হয়েছে কয়েকটি খেজুর গাছ ও বাবলাজাতীয় কাটাগুল্ম জাতীয় মরুবৃক্ষ। এ জলধারাকে কেন্দ্র করে মূলত গড়ে উঠেছে আল-ফিররাহ বসতি, যেখানে বসবাস করছে বানু-ইয়াম গোত্রের হাজার খানেক আদিম বেদুঈন উপজাতির লোকজন।
:
খোলা দাব্বাব গাড়িতে যাওয়ার পথেই পরিচয় হলো স্থানীয় বেদুঈন আল-দাবেরী আল ইয়ামীর সাথে। সে তার উৎপাদিত খেজুর বিক্রি করতে গিয়েছিল, দূরবর্তী জনবসতি আল-কাইয়ামে। এখন ফিরছে সে তার নিজস্ব ফিররাহ বসতিতে। আমি মোটামুটি আরবি জানি, তাই দাবেরীর কাছে জানতে চাইলাম ফিররাহ যাবো কিভাবে? সে হেসে জানতে চাইলো – সেখানে কেন যাবো আমি? মিথ্যে বললাম একটু। “কাজের সন্ধ্যানে এসেছি। শুনলাম ফিররাহ এলাকায় মানুষ খুব কম। সেখানে নাকি কাজ পাওয়া যায়। তাই কাজ করতে এসেছি। দরিদ্র শ্রমিক আমি বাংলাদেশের”! গাড়ি এসে থামলো আমাদের এক পাহাড়ের পাদদেশে। সেখান থেকে হেঁটে পাহাড়ি পথ ধরে যেতে হবে ফিররাহতে। দাবেরী ঐ এলাকারই বাসিন্দা। তাই তার ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে থাকলাম আমি। সাথে ফিররাহ এলাকার আরো দুজন বেদুঈন। পথ চলতে চলতে আমি মুসলিম কিনা জানতে চাইলো দাবেরী। বাংলাদেশি মুসলিম আমি শুনে কোরানের দুয়েকটি সুরা পড়তে বললো আমায়। আলহামদু ও সুরা ইখলাস মুখস্ত বললাম এক মিনিটে। শুনে দাবেরী বার বার বলতে থাকলো – “মারহাবা, মারহাবা”! শেষে বললো – তার বেশ কটি উট, দুম্বা আর ছাগল আছে। একটা মাজরাহ (কৃষি জমি) ও আছে তার। তাতে আমি কাজ করবো কিনা? আমি বললাম – “বেতন কত দেবে তুমি? থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করবে কে”? বুড়ো দাবেরী পাকা দাঁড়িতে হাত দিয়ে বললো – “বারশো রিয়াল বেতন দেবে আমাকে। থাকা খাওয়াও তার”। আরো জানালো – “আগে একজন “হিন্দি” (ইন্ডিয়ান) ছিল তার কাজে। কিন্তু সেই যে গেল ছৃটিতে গেল এক মাসের কথা বলে, আর ফিরে এলো না সে”!
:
মূলত আমি দরিদ্র বা শ্রমিক নই। এখানে একাকি এসেছি রুক্ষ মরু এলাকার সংগ্রামী মানুষ, তাদের জীবনাচার, আর এর খাস গ্রামীণ সৌদি মানুষজনের জীবনধারা দেখতে। তাই একটা নিরাপদ আশ্রয়, আর থাকা খাওয়া দরকার আমার কদিনের জন্যে। তাই সম্মতি জানালাম দাবেরীর প্রস্তাবে। “মবরুক” বলে দাবেরী হাত মেলালো আমার সাথে। মবরুক মানে স্বাগতম তা জানতাম আমি। বুঝলাম এরা খুব সহজ সরল মানুষ, কোন কুটিলতা বোঝেনা গ্রামীণ এ মরু মানুষগুলো। ঘন্টা দুয়েক বালুময় পাথুরে পথ হেঁটে দাবেরীর সাথে ফিররাহ বসতিতে পৌঁছলাম ক্লান্ত পায়ে। গরমে এখানে প্রচন্ড এখন! গায়ে ফোসকা পরার মত অবস্থা। ৪৫-৫০ ডিগ্রির মত তাপমাত্রা হবে নিশ্চিত। তাই হেঁটে দুজনেই বেশ ক্লান্ত আমরা। গোটা পঞ্চাশেক খেজুর গাছের ছায়ায় বসতি গড়েছে এখানের মানুষেরা। সর্বোচ্চ একশ ঘর থাকতে পারে এ বসতিতে। একটা ছোট মসজিদও দেখলাম। ওপরে চাঁদখচিত একটা মিনার। তবে কাঁচা হাতের নির্মাণ এ বাড়ি আর মসজিদ। সম্ভবত গ্রাম্য বেদুঈনদের নির্মাণ এমনই হয়। দাবেরী আমাকে ঘরের বাইরে বসতে দিয়ে ভেতরে গিয়ে পানি আনলো। কিন্তু তেমন ঠান্ডা নয়। বিদ্যুৎ নেই এ রুরাল এলাকায়। তাই নিশ্চয়ই ফ্রিজও নেই। অনেকটা গরম পানির মত পানি খেলাম দুজনে। এর মধ্যে আজান হলো গ্রামীণ মসজিদে। দাবেরী বললো – “নামাজ পড়বে না”? দূরবর্তী বেদুঈন মুসলমানদের মাঝে এসেছি। তাই ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়িয়ে বললাম – “অবশ্যই। আমি মুসলিম বললাম না”! কিন্তু অজু করতে পানি তুলতে হবে কুয়ো থেকে। রশি লাগানো ভারী স্টিলের বালতি কুপে ফেলে, টেনে তুলতে হয় জল। এ জলেই চলে নাওয়া খাওয়া সব কর্ম এখানে। তাই করলাম। আমার তোলা জলে দাবেরী আর আমি অজু করলাম একসাথে। গাঁয়ের মসজিদে ঢুকলাম যোহরের নামাজ পড়তে।
[পরের পর্ব কাল]
সাম্প্রতিক মন্তব্য