হাওড়া স্টেশন ও দরিয়াদৌলতের অবিনাশের শেষ দেখা

চেন্নাই যেতে হাওড়া স্টেশনে ঢুকলাম “তৎকালে” টিকেট কাটতে। বিদেশী হিসেবে বাংলাদেশী পাসপোর্ট দিতে হলো টিকেট কাউন্টারে। কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা আমার পাসপোর্ট নাড়াচাড়া করলেন বেশ কিছুক্ষণ। বিশাল লাইনের অনেক মানুষ এমন সময় ক্ষেপণে বিরক্ত হলো কমবেশী সবাই। কেউবা চিৎকার করে বললো, “এতোক্ষণ কি ঘুমোচ্ছেন দাদা? খেজুরে আলাপ বাদ দেন”! কিন্তু টিকেট বিক্রেতা টিকেট দেয়ার কাঁচের ফোঁকড় দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়েই রইলেন আমার দিকে পলক না ফেলে। মিনিট খানেক এভাবে থাকার পর বললেন – “দাদা, আপনার ডাক নাম কি মাতু”? “হ্যা” বলার পরই বললেন, আপনি কি দরিয়াদৌলত স্কুলে পড়তেন ১৯৪৭ সনে? মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” বলাতেই কাউন্টার ছেড়ে লোকটি দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমায়। আমি বিস্মিত হয়ে কিছু বলার আগেই সে বললো “আমি অবিনাশ! তোর বাল্যবন্ধু আর ক্লাসমেট! চিনতে পারলি না আমায়”!
:
হ্যা, গাঁয়ের মানুষ হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার “দরিয়াদৌলত” গ্রামে বসতি ছিল আমাদের। মা সখ করে আমার নাম রেখেছিল “মাতু” কিন্তু আমার দেড় বছর বয়সেই মারা যান মা আমাকে ছেড়ে! আমাদের গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট দুটো নদী ছিল। পূব দিকের নদীটার নাম তিতাস, আর পশ্চিম দিকেরটার নাম ছিল ঢোলভাঙ্গা, যা গিয়ে মিশেছিল স্রোতঘন মেঘনার ঘোলাজলে। তখন গাঁয়ে অনেক হিন্দুর বসতি ছিল। অবিনাশ আর আমি গাঁয়ের ভাঙা বেড়ার দরিয়াদৌলত স্কুলে পড়তাম প্রাইমারিতে। ওর পুরো নাম ছিল “অম্বিকা চরণ দাস”! বাবার নাম স্মৃতি রঞ্জন দাস! কিন্তু আকস্মিক ১৯৪৭-সালের দেশভাগের সময় অবিনাশের পরিবার এক রাতে গ্রাম ছাড়লো আমাদের সবার অগোচরে। শুনেছি, যাওয়ার আগে গোপনে কোন মুসলমানের কাছে নাকি বাড়িসহ জমি বিক্রি করে গিয়েছিল ওর বাবা খুবই জলের দামে। আমার খেলার সাথী কৈশোরিক প্রেমজবন্ধু অবিনাশকে অনেকদিন খুঁজেছি আমি! কিন্তু কোথাও পাইনি ওর খোঁজ। সবাই বলতো, প্রাণের মায়ায় আর সুখদ্বীপের সন্ধানে ওরা ভারতে পালিয়ে গেছে।
:
বাংলাদেশের এক মুসলমান যাত্রীকে ব্যস্ত হাওড়ার টিকেট কাউন্টার ফেলে নিজ দায়িত্ব ভুলে, এমন আবেগঘন জড়িয়ে ধরার দিকে তাকিয়ে রইলো হাওড়া স্টেশনের হাজারো মানুষ। আমার কৈশোরিক হারানো বন্ধুকে এভাবে পেয়ে বিদগ্ধ বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা পাঠে দুজনেই কাঁদতে থাকি, একে অপরকে জড়িয়ে। পাশে দাড়ানো আমার স্ত্রীর চোখও ভিজে ওঠে এ দৃশ্যে। লাইনে দাড়ানো সকল যাত্রীরা ভুলে যায় তাদের টিকেট কেনার কথা। কজন যাত্রী কাছে এসে মমতায় পিঠে হাত রাখে আমাদের! প্রিয়তর জীবনের ভজন সন্ন্যাসিনীর সুখ স্মৃতি আঁকড়ে ধরে কৈশোরির জীবনকাব্যের পাতা কুড়োনির আনন্দময়তার কথা বলে যাই দুজনে একে অন্যের বুকে বুক লাগিয়ে। অবিনাশ জানতে চায় আমাদের সেই গ্রাম, নদী, নৌকো, ধানক্ষেত আর মহিষ চাষীদের কথা। কিন্তু এতোদিনের জমে থাকা কষ্টবৃক্ষের শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনির উড়ে যাওয়া শব্দ ছাড়া কিছুই যেন বলতে পারিনা আমি হাওড়ার এ লাল ইটের প্রাগৈতিহাসিক স্টেশন ভবনে। অবিনাশ আবার বলে, এখনো আমার মনে আছে ভূমিহীন উদ্বাস্তু কিষাণ কালুমিয়ার রাত জেগে সারিন্দা বাজিয়ে জ্যৈষ্ঠ-বোশেখের জীবনঘন তৃপ্তির গান গাওয়ার কথা!
:
এসব ব্যথাতুর কাব্যিক জীবন ছান্দিকতায় হাওড়ার ঘন মানুষের মাঝে উত্তরাধুনিক ভালবাসার বৃষ্টিপাতে ভিজতে থাকি আমরা দুজনে অনেকক্ষণ! ভিজতে থাকে ওখানের হাজারো যাত্রী! মানবিক ভালবাসার পরাবাস্তব আষাঢ়ী বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কুয়োয় বসতি গড়া বর্ষাতি ব্যাঙের মত দুজনে হাতড়াতে থাকি সেই পুরনো মানবিক দিনগুলোর কথা! যা বাউল কবি আব্দুল করিম বলে গেছেন তার সে দিনের কথা গানে। হাওড়ার অগণিত ক্লান্তিকর মানুষের ধূসর নীলিমায় দাড়িয়ে জল ঝরাই দুজনের শুকনো চোখ থেকে ক্রমাগত। তারপরো ফিরে আসি ওর হাতের ছোঁয়া ভরা ট্রেনের টিকেট নিয়ে, মারকুইজ স্ট্রিটের হোটেল কক্ষে!
:
ঢাকায় ফেরার পরও অনেকদিন যোগাযোগ ছিল অবিনাশের সাথে আমার। ও আসবে একবার ঢাকা আমার ফ্ল্যাটে। তারপর দুজনে একসাথে যাবো সেই “দরিয়াদৌলত” গাঁয়ে! যেখানে এখনো ঐ নামেই আছে আমাদের সেই স্কুল। একদিন চিঠি লিখেছিলো, একবার নিজ চোখে গ্রামের মাটি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার বাসনা! কিন্তু তারপর খবর এলো মারাত্মক “হার্ট এটাকে” আক্রান্ত হয়ে শয্যা নিয়েছে অবিনাশ। সেই চিঠি পড়ে আমি কেঁদেছিলাম খুব! আমার কান্নার সাথে যোগ দিয়েছিল আমার তরুণি কন্যা শারমীনও। যে এখন আমেরিকার টেক্সাসে থাকে স্বামীর সাথে। শারমীন মোমেন বললে, কেউবা চিনতেও পারবেন আমার কন্যাকে! বয়সের ভারে ন্যূজ ক্লান্ত আমি! নাহলে আবার কলকাতা যেতাম অবিনাশের খোঁজে!
:
জানিনা বন্ধু অবিনাশ এখন বেঁচে আছে কিনা। এখনো আমি প্রাত্যহিক অগ্নিদগ্ধ পৌরাণিক পুস্তকের ভস্মিত ছাইয়ের মত উড়ে যাই সেইসব প্রেমজ বাতাসে, যে বুনো বাতাসে উড়ে বেড়াতাম আমি, অবিনাশ আর আমরা সকলে। এসব সাদাকালো আর নীলাভ জীবন কোলাজ মনে করে হু-হু করে কেঁদে ওঠে মনটা। হারিয়ে যাওয়া স্কুল, মাঠ, নদী আর গাঁয়ের অবচেতনের কদম ফুলের ঘ্রাণের মাঝে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে আবার অবিনাশকে নিয়ে। কিন্তু তা কেবল স্বাপ্নিক পলকহীন তাকিয়ে থাকা অলীক জলের শিহরণে যেন! মাতাল ঋতৃিক মধুময়তার সেসব পুরনো স্মৃতিদগ্ধ জীবনের আয়নায় আর মুখ দেখা হয়না আমাদের! অস্তিত্বের তন্তুজালে আটকে যায় যেন সেই পুরনো দিনের প্রেমজ রূপোলি ইলিশ! মহাজাগতিক যুক্তির অন্ত:সার শূন্যতার স্নিগ্ধতায় ভরা আমাদের সে দিনগুলো হারিয়ে ফেলেছি আমরা। যা হাওড়ার বিশাল প্লাটফর্মে খেলা করেছিল একদিন দুচারটে উঁচু প্রেমজ রোদবৃষ্টির মতো। কিন্তু তা আর মেলেনি পাখা দুবন্ধুর স্বর্গগামী সিঁড়ি বেয়ে হাওড়া থেকে বাংলাদেশের সেই প্রেমঘন “দরিয়াদৌলত”র লোকজ গাঁয়ে!

You may also like...