রুব আল খালির দাবেরী, লায়লা আর জাররা কাহিনি [পর্ব : ৫, শেষ পর্ব]

৪-বোনের সবচেয়ে বড়বোন লায়লাকে বিয়ে করে এবার ঘরে থাকার অধিকার হলো আমার! দাবেরীর ছেলের মত সব কিছু সামলাতে হয় আমাকে। টাকা পয়সাও অনেক সময় আমার কাছেই থাকে। কিন্তু আমার মাথার ওপর বড় দেনা। কমপক্ষে কুড়িটা উট বা ১০০-ছাগলের মূল্য পরিশোধ করতে হবে আমাকে এ বাড়িতে কাজ করে। ১২০০-রিয়াল আমার মাসিক বেতন। একটা উটের দাম ৬/৭-হাজার রিয়াল। মানে কুড়িটা উটের দাম শোধ করতে আমাকে অন্তত ৬/৭ বছর কাজ করতে হবে এ বাড়িতে বিনা বেতনে। দেশে মাকে বলে এসেছিলাম, দুমাস সৌদি আরব ঘুরে চলে আসবো আমি দেশে। এখন সেখানে গত হয়েছে প্রায় ৭/৮ মাস। রুব আল খালির ‘ফিররাহ’ বসতি একটা বিচ্ছিন্ন এলাকা বলে, আসার পর থেকে মায়ের সাথে না ফোনে কথা বলতে পেরেছি, না তাকে লিখতে পেরেছি কোন পত্র। এ কমাস পুরোই অন্ধকারে ছিলাম আমি বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু এ সমাজ কি আমাদের! এদের রীতি নীতি কি বাঙালির? আসলে পুরোই ভীন্নতর এক বেদুঈন সমাজে ফেঁসে গেছি আমি। এখানে আমি মারা গেলেও আমার লাশটা দেখতে পাবেনা আমার মা-বাবা, ভাইবোন কিংবো কোন স্বজন। এমনকি জানবেওনা তারা কোথায় কিভাবে মারা গেলাম আমি। অতএব মনস্থির করলাম, মায়ের কাছে ফিরে যাবো আমি!
:
এ ফিররাহ এলাকা থেকে শহরে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। প্রায় ঘন্টাদুয়েক পাহাড়ি পথে হাঁটলে ‘দার ফিররাহ’র রাস্তায় কদাচিৎ মেলে বেদুঈনদের দুয়েকটি “দাব্বাব” গাড়ি। সেখানে যেতে হাঁটতে হবে প্রায় ১০/১২ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ। ওখানে তাৎক্ষণিক দাব্বাব গাড়ি নাও মিলতে পারে। মিললে ৩/৪-ঘন্টায় পৌঁছা যাবে আস-সারওয়া সড়ক পথের জংশনে। ঐ পথেই পাওয়া যাবে নাজরান যাওয়ার বাস বা ট্যাক্সি। চিন্তায় সারারাত নির্ঘুম কাটালাম আমি। ফজরের আজান হলে, ঘুম থেকে উঠতে হয় সব পুরুষদের। আমাকেও উঠতে হলো লায়লার বিছানা ছেড়ে। কুয়ো থেকে জল তুললাম নিজের জন্য, তুললাম শ্বশুর দাবেরীর জন্য। নামাজ শেষ হলে তখনো বেশ অন্ধকার। ঘরে না গিয়ে হাঁটা শুরু করলাম ‘দার-ফিররাহর’ দিকে। বানু-ইয়াম গোত্রের মানুষেরা তখনো অনেকে হয়তো ঘুমে। ধরা পড়লে আমাকে হত্যা করতে পারে তারা বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে! খুব দ্রুত হাঁটাতে দেড় ঘন্টাতেই পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত স্থানে। কিন্তু না কোন দাব্বাব নেই এখানে। কিন্তু একাকি এ জনপদে দাঁড়িয়ে থাকবো? যদি বানু-ইয়াম গোত্রের কেউ দেখে ফেলে আমাকে? ফিরে যাবো আবার দাবেরীর বাড়ি? কিন্তু আমারতো মায়ের কাছে ফিরে যেতে হবে! আমি কি এ গোত্রের মানুষ! এ দেশের কেউ আমি!
:
এখানের পাহাড়গুলো এখনো ততটা উষ্ণ হয়নি। ক্রমে উত্তাপ বাড়বে ১০/১১-টার দিকে। একটা পাথরের ওপর উঠে বসে রইলাম চারদিকে চোখ রেখে। একদিকে বানু-ইয়াম গোত্রের বসতি। অন্যদিকে আস-সারওয়া যাওয়ার পাথুরে পথ। প্লান করলাম – যদি বানু-ইয়াম গোত্রের কেউ আসে আমার খোঁজে, তখন পালিয়ে থাকবো একটা গুহার মধ্যে। বড় পাথরের ফাঁকে একটা গুহাও ঠিক করে রাখলাম আমি। ঘন্টা তিন বসার পর দূরে দেখলাম একটা “দাব্বাব” আসছে কজন যাত্রী নিয়ে। ইস! ঐ গাড়িতে যদি বানু-ইয়াম গোত্রের কেউ আসে! যারা চিনে ফেলতে পারে আমাকে! তাহলেতো ধরা পড়ে যাবো আমি! তাই দাব্বাবের সামনে গেলাম না আমি। একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ! ৩-জন লোক নামলো দাব্বাব থেকে। ভাগ্য ভাল আমার, তারা ফিররাহর দিকে নয়। হাঁটা ধরলো ধূসর পাহাড়ি পথে বানু হামদান জনপদের দিকে! বেদুঈন ড্রাইভার সম্ভবত প্রাকৃতিক কাজ করতে গেছে একটু দূরে! আমি দিয়ে দাঁড়ালাম তার গাড়ির সামনে। ড্রাইভার ফিরে এসে বললো – “কই যাবো আমি? কোত্থেকে এসেছি”। “ফিররাহ থেকে এসেছি। ওখানে কাজ করি। আস-সারওয়া যাবো”! বললাম তাকে আমি! সিগারেট ধরিয়ে গাড়ি ছাড়লো ড্রাইভার। বুকে সাহস ফিরে এলো আমার! এবার হয়তো আস-সারওয়া যেতে পারবো আমি এ গাড়িতেই!
:
আস-সারওয়া পৌঁছতে বেলা সাড়ে বারোটা বাজলো আমার। খুব ক্ষিধে পেয়েছে। কিছু খাওয়া দরকার। কিন্তু এখানে থাকা নিরাপদ মনে হলোনা আমার। যদি দাবেরী বা তার গোত্রের কেউ খুঁজতে আসে আমায় এই আস-সারওয়ায়? এখন নিশ্চয়ই ওরা বুঝতে পেরেছে আমি পালিয়েছি, দাবেরীর ক্ষেত আর পশুর পাল আর স্ত্রী লায়লাকে ফেলে। যতটা না লায়লার জন্য মন খারাপ হলো, তারচেয়ে বেশী মন খারাপ করলো আমার বুড়ো সহজ সরল দাবেরীর জন্য। আহা! বড় ভাল মানুষ লোকটি। পারলে এ জনপদ থেকে দাবেরী, লায়লা আর ওদের পুরো পরিবারকে নিয়ে যেতাম বাংলাদেশে! সেখানে ঢাকায় আধুনিক ফ্ল্যাট আছে আমার। গ্রামে আছে ৪-একরের বাগ-বাগিচার সুন্দর বাড়ি। কিন্তু সৌদি বেদুঈদ বানু-ইয়াম গোত্রের এ লোকেরা কি আমার কথাতে যাবে তাদের পূর্বপুরুষের বসতি ছেড়ে! নানাবিধ চিন্তনে মন উদাস হতে থাকলো আমার। আসলে আমার মনটা খুব নরম। তাই দেশের জন্য যেমন মন কাঁদছে, তেমনি কাঁদছে দাবেরী আর তার কন্যা লায়লার জন্যে। ইস! তৃতীয় কন্যা জাররা আমাকে পেতে কি কান্নাই না কাঁদলো! আমার বিয়ের দিন, কিছুই মুখে দিলোনা সে! ৩-দিন পর মুখে প্রথম খাবার তুললো চঞ্চল এ অভিমানী মেয়েটি। আহারে! মানুষের মন কত কিছুই না চায় এ জগতে! জাররা যদি আমার সাথে পালিয়ে যেতো বাংলাদেশে! যেমন কপিলা পালিয়েছিল কুবেরের সাথে ময়না দ্বীপে। আসলে বাস্তবে যা পাওয়া যায়না তাও চায় মানুষের এ অশান্ত মন!
:
আমার সাথে জিনিসপত্র ছিলনা কিছুই। এক কাপড়ে বেড়িয়ে এসেছি আমি। ওখানে গিয়েছিলামও প্রায় খালি হাতেই। নাজরান একটা পরিচিত বাঙালি ডাক্তার পরিবার ছিল। যারা প্রায় ১৮-বছর যাবত থাকে ওখানে। ৮-মাস আগে ওদের আমন্ত্রণেই আমি এসেছিলাম এখানে। ফেসবুকে পরিচয় আমার ঐ পরিবারের সঙ্গে। ভীষণ ভক্ত তারা আমার লেখার। ৬/৭ দিন ছিলাম ওদের বাসাতে আমি। তারপর “একটু ঘুরে আসি” বলে আকস্মিক চলে যাই ‘রুব আল খালির আল-ফিররাহ’ বসতিতে! যাওয়ার আগে একটা ব্যাগ রেখে যাই ঐ ডাক্তার পরিবারের বাসাতে। ঐ ব্যাগে ক্রেডিট কার্ড, পাসপোর্টসহ নানাবিধ জিনিসপত্র ছিল আমার! হাসপাতালের ডিউটি শেষ করে ওরা জাস্ট ঘরে ঢুকেছে, এমন সময় আকস্মিক দরজায় নক করলাম আমি। দীর্ঘ ৭/৮ মাস পর দরজার সামনে বেদুইন পোশাক পরা আমাকে দেখে আকাশ থেকে পড়লো ওরা। বিয়ে ইত্যাদির কথা গোপন রেখে, কেবল বেদুঈন সমাজে ৮-মাস বসবাসের কথা শুনে ভাষাজ্ঞান হারালো দুই স্বামী-স্ত্রী। ওয়াশরুমে ঢুকে ঘন্টাখানেক জল ছাড়লাম পুরো শরীরে। একটা লুঙ্গী ধার নিলাম ডাক্তার শাহরিয়ারের। রাতে সার্ট প্যান্ট কিনলাম নাজরান ‘সুক আল হালওয়াইনে’ গিয়ে। দুদিন পর ফ্লাইট পেলাম আমিরাত এয়ারে। সরাসরি নাজরান থেকে দুবাই। দুবাই থেকে ঢাকা ট্রানজিটে ইকের এ-৩০০ বিশাল ডানার ফ্লাইট!
:
নাজরান থেকে বিমান উড়ছে দুবাইর দিকে। আহা বিমানটা কি রুব আল খালির আল ফিররাহ’র বানু ইয়াম বসতির ওপর দিয়ে যাচ্ছে! ইস! একবার যদি দেখতে পেতাম বুড়ো দাবেরী, তার বড় মেয়ে লায়লা কিংবা সেজো কন্যা জাররাকে। তারা কেমন করছে এখন? লায়লা কি কাঁদছে আমার জন্যে! বুড়ো দাবেরী কি সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিশাপ দিচ্ছে আমাকে? তাকে কি শাস্তি দেবে গোত্রপ্রধান আল ঘামদি? জাররা আমাকে পায়নি বলে সে কি খুশী হয়েছে আমার অন্তর্ধানে? নাকি আমাকে না দেখে আত্মহত্যা করবে সে! আহারে কি বিচিত্র জগত, এর মানুষ আর মানুষের মানবিকতা! পৃথিবীর কত সমাজ! আর কত সপ্তচিন্তনের তার মানুষ! কোন দূরের দাবেরী আর তার কন্যা লায়লা কিংবা জাররা! ওরা কি ওদের উটগুলোর দুধ দোহন করছে এখন! লায়লা ভাল দুধ দোহাতে পারে। আমার অভাবে সে কি বিক্রি করতে যাবে নিজেই দুধ রুটির দোকানের কাছে! ওর পরিবার আর সমাজ কি ওকে ‘অপয়া’ বলে গালি দেবে, আমি ফেলে চলে আসাতে!
:
এসব চিন্তনে কখন আমিরাত এয়ারবাস চলে আসে দুবাইর কাছাকাছি। ফ্লাইটের সব লাইটগুলো জ্বলে ওঠে একসাথে। বিমানবালারা সিটবেল্ট বাঁধতে বলেন সবাইকে। কিন্তু আমার এসব কথা কিছুই কানে ঢোকেনা। সারাপথ আচ্ছন্ন করে রাখে বুড়ো বেদুঈন দাবেরী, তার কন্যা লায়লা এবং চঞ্চল হরিণি জাররা। ওদের ঠেলে বিমানের সরু পথে যেন বের হতে পারিনা আমি! সব প্যাসেঞ্জার নেমে যায়, কেবল বিমানের দুসিটের মাঝে যেন আটকে থাকি আমি! কি এক অমোঘ নিয়ন্ত্রণে আমাকে আগলে রাখে দাবেরী, লায়লা আর জাররা নামের চঞ্চল মেয়েটি!
[পাঁচ পর্বে সমাপ্ত]

You may also like...