ইসলামের স্বর্ণযুগ

“ইসলামের স্বর্ণযুগ” – কথাটা শুনলেই মুসলিমদের মধ্যে একটা আহলাদে গদগদ গর্বিত ভাব চলে আসে। এই “স্বর্ণযুগ” আসলে কোন সময়টাকে বলা যায়? ৬২২ সালে মদিনায় প্রথম ইসলামি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা ও ইসলামি শক্তির উত্থানের সময় থেকে মূলতঃ এই স্বর্ণযুগের শুরু হিসেবে ধরা হয়। আর ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের দ্বারা বাগদাদ অবরোধের সময়কে এর শেষ হিসেবে ধরা হয়। ১৪৯২ সালে ইবেরিয়ান উপদ্বীপের আন্দালুসে খ্রিষ্টান রিকনকোয়েস্টার ফলে গ্রানাডা আমিরাতের পতনকেও অনেকে এর সমাপ্তিকাল হিসেবে গণ্য করেন।

নানান ধরনের আগ্রাসী তৎপরতা, যুদ্ধবিগ্রহ আর ব্যাপক রক্তপাতের মাধ্যমে ইসলামের বিস্তারের ইতিহাস সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে বলার চেষ্টা করা হয়, মুসলিম ধর্ম প্রচারকদের শান্তিপূর্ণ দাওয়াত, তাদের চারিত্রিক গুনাবলী আর ইসলামের রীতিনীতিতে মুগ্ধ হয়ে মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে চলে এসেছে, যা বহুলাংশে ভিত্তিহীন।

সত্যিকার অর্থে ইসলাম ধর্মের গর্ব করার মত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয় আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের (৭৮৬-৮০৯) সময়। সেসময় বাগদাদে বাইতুল হিকমাহর প্রতিষ্ঠার ফলে জ্ঞানচর্চার প্রভূত সুযোগ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ফাতেমীয় যুগে (৯০৯-১১৭১) মিশর সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং উত্তর আফ্রিকা, সিসিলি, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, আফ্রিকার লোহিত সাগর উপকূল, তিহামা, হেজাজ ও ইয়েমেন এর অন্তর্গত ছিল। এই যুগে মুসলিম বিশ্বের রাজধানী শহর বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডো‌বা বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বাণিজ্য ও শিক্ষার বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। আরবরা তাদের অধিকৃত অঞ্চলের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিল। হারিয়ে যেতে থাকা অনেক ধ্রুপদি রচনা আরবি ও ফারসিতে অনূদিত হয়। আরো পরে এগুলো তুর্কি, হিব্রু ও ল্যাটিনে অনূদিত হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিক, রোমান, পারসিয়ান, ভারতীয়, চৈনিক, মিশরীয় ও ফিনিশিয় সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান তারা পর্যালোচনা করেন যা তাদের অগ্রগতিতে অবদান রাখে।

কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষা আর জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং জ্ঞান অর্জনের উপর জোর দেয়া হয়েছে। তৎকালিন মুসলমানদের জ্ঞানঅর্জন, বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও শিক্ষালাভে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা হিসেবে মুসলমানদের এ ধর্মীয় মূল্যবোধ যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল। এর তবে, মূল কারন ছিল, কোরান-হাদিসে উল্লিখিত জ্ঞানচর্চা বলতে সেসময় তারা কোরান-হাদিসে লুক্কায়িত জ্ঞানবিজ্ঞানকে না বুঝে, বিভিন্ন দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানকেই বুঝতেন। কোরান ও হাদিস ঘেটে জ্ঞানবিজ্ঞানের অনুসন্ধানে তারা বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করেননি।

তৎকালিন ইসলামি সাম্রাজ্য জ্ঞানী-পন্ডিতদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষক ছিল। সকল খরচ রাষ্ট্র বহন করতো। সে সময়ের ট্রান্সেলেশন মুভমেণ্ট বা তরজমা সংস্থার তরজমা করার কাজে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় হতো। হুনাইন ইবনে ইসহাক-এর মতো বড় বড় জ্ঞানীবর্গ ও তর্জমাকারকদের বেতনের পরিমাণ ছিল আজকালকার পেশাদার এথলেটদের বেতনের মতো। আব্বাসীয় যুগে আল মনসুর ইরাকের বাগদাদ শহরে ‘দ্য হাউস অফ উইজডম’ নামে একটি বৃহৎ পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত করেন।

এরই প্রভাবে মুসলিমরা জ্ঞানের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা গ্রিক, পারস্য, ভারতীয়, চীনা, মিশরের সভ্যতার প্রাচীন জ্ঞানের বইগুলো আরবী ও পরে তুর্কিতে অনুবাদ করেন। উমাইয়া ও আব্বাসিয়া খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকোতায় গ্রিক দার্শনিকদের কাজগুলো এবং বিজ্ঞানের প্রাচীন জ্ঞানগুলোকে সিরিয়ো ভাষা অনুবাদ করান যা পরে আরবিতে অনুদিত হয়। তারা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন দর্শন, বিজ্ঞান এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহ দেখান। একটা লম্বা সময় ধরে আব্বাসিয় খলিফাদের চিকিৎসকরা ছিলেন আসারিয়ান খ্রিস্টান। এদের মধ্যে বেশিভাগ খ্যাতনামা খ্রিস্টান চিকিৎসক ছিলেন বুখতিশু বংশের। আব্বাসিয় আমলে লিখিত পান্ডুলিপির জন্যে কাগজের নতুনভাবে ব্যবহার বই রচনা ও জ্ঞান চর্চাকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।

তবে সবকিছু ছাড়িয়ে, সেযুগে মুসলিমদের অগ্রগতির সবচেয়ে বড় কারনটি ছিল, সেযুগের সবচেয়ে বড় বড় মনীষীদের মধ্যে মুক্তচিন্তা, তুলনামূলক ধর্মতত্ব, বিভিন্ন দর্শনের চর্চা ছিল উন্মুক্ত। আর এই চর্চায় শাসকগোষ্ঠী কোনরকম বিধিনিষেধ আরোপ করতেন না। ইবনে সিনা, আল-কিন্দি, আল-খাওয়ারিজমীসহ যেসব মনীষীর নাম নিয়ে মুসলিমরা সুযোগ পেলেই গর্বে বুক ফোলাতে থাকেন, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন মুক্তচিন্তার চর্চাকারী।

ইসলামের স্বর্ণযুগের সমাপ্তির কারণ হিসেবে মুসলিমরা বলে থাকে, ধর্মীয় অনুশাসন আর বিধিনিষেধ থেকে দূরে সরে আসাই নাকি ইসলামের স্বর্ণযুগের সমাপ্তি ঘটিয়েছে। কোরান হাদিস আর নবীর সুন্নতি শিক্ষা ভুলে যাওয়ার কারণেই নাকি মুসলমানদের এই অধঃপতন। আজকের দিনে দাড়িয়ে অনেক মোল্লাকে হইচই করতে শোনা যায় – ইসলামি আইন চাই, শরীয়া আইনের বাস্তবায়ন চাই, আল্লাহর শাসন চাই, ইত্যাদি বলে গলা ফাটাতে। তাদের ভাবটা এরকম, শরীয়া আইন কার্যকর করার মধ্য দিয়েই সারা পৃথিবীর সব অশান্তি দূর হয়ে যাবে।

আশ্চর্যের বিষয়, এরকম একজন গলাফাটানো মোল্লার মাধ্যমেই ইসলামের স্বর্ণযুগের সমাপ্তির সূচনা হয়েছিল। এর সূচনা করেছিলেন ইমাম গাজ্জালী নামের এক গোড়া মুসলিম। বিখ্যাত মনীষীদের খ্যাতি আর জ্ঞানের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না বুঝতে পেরে তিনিই প্রথম প্রতিবাদী হয়ে মূর্খ মুসলমানদেরকে খেপিয়ে তুলতে শুরু করেন তার কুযুক্তি আর গোড়ামীপূর্ণ বই আর বাণী লিখে, বক্তৃতা দিয়ে। কোরান আর নবীর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে বকিসব জ্ঞান ও দর্শন চর্চাকে শিরক, ধর্মবিরোধী কাজ, কুফরি, ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে সেযুগের মনীষীদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চায় বাঁধা দেয়া হয়। অনেকের উপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ। তাদের লেখা বইপুস্তকের পান্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর এরই ফলশ্রুতিতে মুসলিমদের মধ্যে তৈরী হয় জ্ঞানবিমূখতা। সেই অন্ধকারে নিমজ্জিত মুসলিম জাহান আজও তলিয়ে যাচ্ছে গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারে। আর মোল্লার দল আজও চিৎকার করে কোরান আর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে ইসলামকে জাগিয়ে তুলতে চাচ্ছে, নারীশিক্ষাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে প্রকাশ্যে। আর একটা দল কোরানের শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে জিহাদি জোশে কাফের নিধনে ব্যাস্ত।

জিহাদি মুমিন মুসলমান তো বটেই, একদল মডারেট মুসলিমও মাঝে মাঝে মিনমিন করে বলে, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম আজও মার খাচ্ছে মার্কিন ইজরায়েলী বাহিনীর কাছে। সেটা নিয়ে কেউ কিছু বলছেনা কেন? এটা বলে তারা মূলতঃ জিহাদি মুসলিমদের কার্যকলাপকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দেয়ার একটা অপচেষ্টা করেন মাত্র। মার্কিন-ইজরায়েলী সামরাস্ত্রের বিরুদ্ধে কালো পতাকা হাতে ঘোড়ায় চড়ে তীর ধনুক আর তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধে যেমন জয়লাভ করা যাবেনা কোনদিনই, তেমনি বেসামরিক লোকজনের মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে কোনদিন স্বর্গের টিকেট পাওয়া যাবেনা। আরব রাজা-বাদশারা যেখানে মার্কিন – ইজরায়েলী তোষামোদ আর ভোগবিলাসে জীবন কাটাচ্ছে, সেখানে কোরান-হাদিস-সুন্নাহর শাসনব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্ন দেখতে দেখতে মুসলিমদের বিলুপ্ত হওয়া সময়ের ব্যপার।

ইসলামের স্বর্ণযুগের সমাপ্তির আসল ইতিহাস আর কারণগুলো যেদিন মুসলমানরা বুঝবে, আর তা থেকে শিক্ষা নিয়ে নব্য গাজ্জালীদেরকে থামাবে, সেদিন ইসলামের স্বর্ণযুগ হয়তো আবার আসবেনা, কিন্তু বিশ্বের অন্য দেশগুলির মানুষেরা তাদেরকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করবে। আর তা না পারলে মুসলিমরা মুসলিমও হতে পারবেনা, মানুষ হিসেবেও বিবেচনার বাইরে থাকবে।

সংক্ষেপে যদি ইসলামের স্বর্ণযুগের সমাপ্তির কারণ এবং আজকের যুগেও মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ে থাকার কারণ জানতে হয়, তা হচ্ছে –

১. বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না চাওয়া।
২. নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে অতিরিক্ত গর্ব বোধ করা।
৩. কোরান হাদিসকে জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎস মনে করে আধুনিক শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া।
৪. কোরান-হাদিসের বিধিনিষেধকে আইনকানুন ও সংবিধানের সাথে গুলিয়ে ফেলা।

আর মুসলিমদের অত্যাচারিত হওয়া নিয়ে বিন্দুমাত্র সমবেদনা প্রকাশ করার ধর্মীয় ভিত্তি বা কারণ নেই। কারণ, তাদের জীবনের উদ্দেশ্য তো পার্থিব উন্নতি বা শান্তি না। তাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য পরকালের পুরষ্কার। যারা মুসলিমদের অত্যাচারিত হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাদের জানা উচিৎ, এবিষয়ে মানুষের সহমর্মিতা কামনা না করে তারা যেন তাদের আল্লাহর কাছেই বেশী বেশী প্রার্থনা করেন, অথবা, তাদের দূর্গতিকে আল্লাহর ঈমাণী পরীক্ষা মনে করে ধৈর্য ধরে মৃত্যূর অপেক্ষা করেন। মুসলিমরা যেমন মনে করে, ধর্মান্তরিত না হলে বিধর্মীদের বাঁচার অধিকার নেই, তেমনি বিধর্মীদেরও সমান অধিকার আছে, পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ করার জন্য মুসলিমদের বিলুপ্তি কামনা করার।

শুধুমাত্র তাহলেই হয়তো পৃথিবীতে শান্তির স্বর্ণযুগ আসতে পারে।

শুভ্রনীল বহ্মচারী

You may also like...