নবারুণ গাঁয়ের স্বপন আর পুষ্পিতা কাহিনি

একাদশ শ্রেণির পুষ্পিতা তার দু’বান্ধবী কাকন আর ঝর্ণাসহ বাড়ি ফিরতে বেশ দেরী হয়ে গেল। কলেজ থেকে বেশ দুরে নদীতীরে বৈশাখি মেলা দেখতে গিয়েছিল তারা ৩-বান্ধবী কলেজ থেকে একত্রে। সন্ধ্যার প্রাক্কালে বিলের মাঝ বরাবর তারা পা চালালো খুব দ্রুত। যাতে সূর্য ডোবার আগেই অন্তত বিলটা পার হতে পারে নির্বিঘ্নে। কিন্তু বিলের মাঝামাঝি যখন দ্রুতি হাঁটছিল ওরা কোন দিকে না তাকিয়ে। ঠিক তখনই আকস্মিক বিজয় পথ আটকে দাঁড়ালো ওদের। শীষ দিলো, নানাবিধ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী করলো, কুপ্রস্তাব দিতেই ছাড়লো না বিজয়। কাকন আর ঝর্ণা মুখ লাল করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো কিন্তু পুষ্পিতা প্রতিবাদ করলো, পথ থেকে সরে যেতে বললো। বিজয় কিছুই করলোনা। বরং পুষ্পিতার ওড়না ধরে টান দিলো আচমকা। আর এর প্রতিক্রিয়ায় পুষ্পিতা বজ্রপাতের মত কষে দিলো এক চড় একদম বিজয়ের গাল বরাবর। বিজয় বাড়ি পর্যন্ত এসে শাসিয়ে গেলো এর মাসুল দিতে হবে পুষ্পিতাকে একদিন।

কৃষাণ বাবা ও জোয়ান ভাই স্বপনকে খুলে বললো পুষ্পিতা সব ঘটনা। এর একটা প্রতিবাদ না হলে বিজয় আবার ডিসটার্ব করবে পুষ্পিতাকে, এমন ভয়ের কথাও বললো সে বাবা আর ভাইকে। পরদিন বাবা আর ভাই স্বপন চেয়ারম্যানের কাছে খুলে বললো পুরো ঘটনা। চেয়ারম্যান বিচার বসালেন ইউপি কাউন্সিলে প্রকাশ্যে দুদিন পর।

বিজয় এলো তার বাবাসহ বিচার অনুষ্ঠানে। তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বিজয়ের বাবা প্রাক্তন চেয়ারম্যান নিজেই কথা শুরু করলো। পুষ্পিতা নামের এক দরিদ্র কৃষক কন্যা তার একমাত্র ছেলে বিজয়ের নামে এমন অভিযোগ করাতে বেশ রুষ্ট হলেন তিনি। রোষ নিয়ে বললো –

“আমার জওয়ান ছেলে একটা দরিদ্র পরিবারের মেয়ে পুষ্পিতার ওড়না ধরে টান দিয়েছে, এটা পুষ্পিতার সৌভাগ্য নয় কি? এ বয়সে এটা যুবকরা করবে নাতো বুড়ো বয়সে করবে? পুষ্পিতার কি ভাগ্য ভাল নয় যে, বিজয় তাকে রেপ বা অন্য কিছু করেনি? পুষ্পিতা প্রকাশ্যে অভিযোগ করে আমার পরিবারের সুনাম যেভাবে নষ্ট করেছে, তার বিচার চাই আমি চেয়ারম্যান ও সালিশদারদের কাছে”!

চেয়ারম্যানসহ অপর শালিদারগণ পুষ্পিতাকে আরো ভালভাবে চলার পরামর্শ ও এমন হাস্যকর অভিযোগে করাতে উপহাস করলো। তার বাবা আর ভাইকেও সাবধান করলো। কিন্তু প্রকাশ্যে সালিশী সভায় আবারো এ ঘটনার প্রতিবাদ করলো পুষ্পিতা!

পরদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে কাকন আর ঝর্ণার সামনে থেকেই পুষ্পিতাকে তুলে নিলো বিজয় আর তার সঙ্গী পান্ডা-গ্রুপ। সারারাত এক নির্জন বাড়িতে রেখে ধর্ষণ করলো তারা পুষ্পিতাকে পালাক্রমে। এবং শেষ রাতের দিকের হত্যা করলো তারা তাকে ধারালো রামদা দিয়ে। লাশটি ফেলে রাখলো কলেজের পাশের বাগানে।

ভাই স্বপন ঝর্ণা আর কাকনকে সাক্ষী করে FIR করলো থানায়। লাশ সনাক্ত, পোস্টমর্টেম ইত্যাদি সবই করালো পুলিশ কিন্তু বিজয়কে পাওয়া গেলোনা ৩-মাসেও। মোবাইল ট্রাকিং করেও টিকিটি পাওয়া গেলনা বিজয়ের। পুলিশি গোয়েন্দারা তাক রাখলো বিজয়ের বাড়ির দিকে। এক গভীর রাতে চাঁদরমুড়ে ঘরে ঢুকলো বিজয়। খুব ভোরে খবর পেয়ে পুলিশ রেট দিলো বাড়ি। কিন্তু ঘরে ঢুকতে বাঁধা দিতে চাইলো বিজয়ের ক্ষমতাধর বাবা। পুলিশ রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঘরে ঢুকে ইঁদুরের মত টেনে বের করে বিজয়কে। চোখের সামনে গুণধর ছেলেকে ইঁদুরটানা দেখে পুলিশকে খাগড়াছড়ির মত দুর্গম এলাকায় বদলী কিংবা সাসপেন্ড করার মত ভয় দেখায় রাজনৈতিক ক্ষমতাধর বাবা। পুলিশ কিছু তোয়াক্কা না করে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ধর্ষক কাম খুনি বিজয়কে।

কিন্তু থানায় গিয়ে পুলিশকে শাসাতে থাকে বিজয় ক্রমাগত। খুনের কথা অবলীলায় স্বীকার করে দম্ভে চ্যাচাতে থাকে –

“হাই পুলিশ! এক গাছি লোমও ছিঁড়তে পারবে না আমার তুমি। হ্যাঁ, খুন আর সারারাত ধর্ষণ করেছি আমরা। যে রামদা দিয়ে কেটেছি ওর গলা, তাও আমার ঘরের পাশের তেঁতুল গাছের নিচে পোতা আছে। সব আলামত জোগার করলেও, কিছু করতে পারবেনা আমার। দুদিনেই বের হবো আমি বেল-এ”।

সব শুনে গা জ্বলে যায় পুলিশের। চক্ষু লাল করে বললো – “এমন চার্জসিট বানাবো তোর যে, সারা জীবন জেলে চাক্কি পিশতে হবে তোর, যদি ফাঁসি নাও হয়”।

পুলিশ কঠিনতর চার্জসিট দিলো আদালতে। ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষি রইলো ঝর্ণা, কাকন আর মুদি দোকানি সুলতান। সবাই উপস্থিল হলো সাক্ষি দিতে কিন্তু টাইম ক্ষেপণ চলতে থাকলো দিনের পর দিন। বিজয়ের বাবার সন্ত্রাসীরা একদিন উপস্থিত হলো কাকনের বাড়ি। বললো তার মাকে – “তোমরা কি চাও কাকনের অবস্থা পুষ্পিতার মত হোক? যদি চাও তবে সাক্ষি দিতে পাঠাও”।

ঝর্ণার মা বাবাকেও একই কথা বললো বিজয়ের গ্রুপ।

অবশেষে নির্দিষ্ট তারিখে শুনানি শুরু হলে ঝর্ণা, কাকন, মুদি দোকানি সুলতান ৩-জনেই মুখ কালি করে বললো – “পুলিশ জোর করে ভয় দেখিয়ে সাক্ষি বানিয়েছে আমাদের। আমরা কিছুই জানিনা কিভাবে খুন হলো পুষ্পিতা”।

রায়ে বিজয় বেকসুর খালাস পেয়েছে শুনে সারারাত কাঁদলো পুষ্পিতার বান্ধবী ঝর্ণা, কাঁদলো কাকন। শহর থেকে ব্যান্ড-দল এনে সারাদিন সারারাত উৎসব করলো খুনি বিজয়ের পরিবার। পুষ্পিতার ভাই আর বাবাকে হাসি তামাশা করতে থাকলো পথেঘাটে বিজয় আর তার দলের লোকজন।

বোন পুষ্পিতার হত্যাকারীরা কোন শাস্তি না পাওয়াতে দ্রোহি জেদ চাপলো স্বপনের। কৃষক বাবার কষ্টের টাকা নিয়ে সে গোপনে একটা পিস্তল জোগার করলো সবার অগোচরে। ঐ অস্ত্রটা তাকে মারাত্মক সাহসি করে তুললো। গ্রামের সবার কাছে গিয়ে বিজয়ের অপকর্ম, বর্তমান ও ভুতপূর্ব চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নানাবিধ অনৈতিকতা, শোষণ, পুষ্পিতার মত অন্য কোন কন্যা বা স্ত্রীর প্রতি এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে সবাইকে সংগঠিত হতে অনুপ্রাণিত করলো সে ধীরে ধীরে।

মুদি দোকানি সুলতানের দোকানে বিজয় আর তার দল একদিন আক্রমন চালালো সে আর ওদের ভয় করবেনা শুনে। তছনছ করলো দোকানের মালপত্র। খবর পেয়ে স্বপন আর ভয় জয় করা গ্রামের ছেলেরা প্রতি আক্রমন করতে এলো বিজয়কে। দৃঢ়তায় স্বপন বললো – “সুলতানের তছনছ করা সব মালের ক্ষতিপুরণ দিতে হবে তোমায় এক্ষুণি”।

বান্দির ছেলের এমন দৃঢ়তায় তাচ্ছিলে ‘খ্যাক’ করে কাশলো বিজয়। মারতে্ উদ্যত হলো স্বপনকে। এবং কোন কিছু বোঝার আগেই বর্জের মত আকস্মিক বিজয় বাহিনির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সবাই। আধমরা করে পকেট থেকে টাকা নিয়ে যথাযথ ক্ষতিপুরণ দিলো সুলতান মুদিকে। ঘরে ফিরে আহত বিজয় সব খুলে বললো তার সন্ত্রাসী বাবাকে।

সিংহের মত গর্জে উঠলো বাবা ও মা যৌথভাবে ছেলের এ অপমানে। তাৎক্ষণিত ৫-লাঠিয়ালকে পাঠালো গ্রামের কৃষক দরিদ্র ‘চ্যালাদের’ শায়েস্তা করতে। স্বপন ঠান্ডা মাথায় দরিদ্র লাঠিয়ালদের বললো –

“দাদা, তোমরাও এ গ্রামের ছেলে। তোমরা কেন আমাদের সাথে ঐ সন্ত্রাসির পক্ষে লাঠি ধরবে? একদিন তোমাদের কন্যা, বোনদের ওরা ছিঁড়ে খাবে, যেমনটা খেয়েছে আমার বোনকে”!

স্বপনের কথায় আপ্লুত হলো ৫ লাঠিয়াল। তারা নিজ নিজ ঘরে ফিরে গেলো ঐ অপকর্ম বাদ দিয়ে।

স্বপন গ্রামের সবাইকে একথা বোঝাতে সমর্থ হলো যে, চেয়্যারম্যান ও তার সাগরেদদের একঘরে করবে ওরা সবাই। কোন লেনদের করবেনা কেউ তাদের সাথে আর।

বিজয়ের বাবা পরদিন বাজারো এলো নাপিতের দোকানে। কিন্তু নাপিত খুর গুটিয়ে কামাতে অস্বীকৃতি জানালো তাকে। দরিদ্র মাছ বিক্রেতা সুবল বুকে সাহস এনে দৃঢ় চিত্তে বললো – “আপনার কাছে বিক্রি করুম না আর কোন মাছ”। দারুণ অপমানিত হলো দাপুটে অভিজাত প্রাক্তন চেয়ারম্যান। পুরো ঘটনা বুঝতে পারলো বিজয় আর তার বাবা। এবার মরিয়া হলো তারা এসব ছোটলোকদের ‘শিক্ষা’ দিতে! ২-বাপ-পুতে বড় রামদা হাতে চোখ পাকিয়ে বাজারে এসে হুঙ্কার ছাড়লো নাপিত নিরঞ্জন শীলের সেলুনে। ঘটনা আঁচ করতে পেরে বাজারে অপেক্ষামান স্বপন আর তার দরিদ্র মানুষের সাহসী দল মুখোমুখি হলো রামদা সজ্জিত বাপ-পুতের। দা চালানোর আগেই স্বপন পিস্তল তাক করলো বিজয়ের ঘিলু বরাবর। খুন হতে পারে দেখে সবাই নিবৃত্ত হতে বললো স্বপনকে। সেও নিজেকে চেষ্টা করলো নিজেকে কন্ট্রোল করতে।

কিন্তু আকস্মিক রক্ত ঝিলিকের অস্তিত্বময় জীবনের প্রলয়ঙ্কারী বৈশাখী ঝড় হয়ে ঘটনাস্থলে দৌঁড়ে এলো একাদশ পড়ুয়া পুষ্পিতা। সে প্রবল আক্রোশে ট্রিগার চেপে রাখলো যতক্ষণ না ছ’টা গুলি বেড়িয়ে যায় পুরো পিস্তল থেকে। এবং রঙচটা স্মৃতিদগ্ধ সময়ের অপাঙক্তেয় কাব্যের মত উড়তে থাকলো পুষ্পিতা বিজয়ের চারদিকে। মা-বাবার সামনে ছ’টা গুলিতে মাথার খুলি খসে পরা বিজয় লুটিয়ে পড়লো মাটিতে তার রাজকীয় লাম্পট্য জলাঞ্জলি দিয়ে। প্রজ্ঞা আর বোধের আকাঙ্খার সীমানা পেরিয়ে পোড়া কার্বণ আর শিশার বিদগ্ধ গন্ধে স্বপন ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো থানার দিকে।

:পুলিশ সব শুনে স্যালুট করলো স্বপনকে। বললো – “যাও। ওর মা-বাবা আর পান্ডাদের শেষ করে এসো, যাতে এ গ্রামে আর নতুন কোন বিজয় সৃষ্টি না হয়”।

:পুলিশের মনছায়া বলছিল এমন কিছু হোক সিনেমার মত কিন্তু আসলে এমনটা ঘটলো না। স্বপনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করতে হলো পুলিশকে। তবে ‘আইও’ দৃঢ়চিত্তে বললো, “কোর্ট যে কাজটি করেনি, তাই করলে তুমি। তোমাকে মুক্ত করার সর্বোচ্চ আইনি চেষ্টা করবো আমরা”।

:জেলে গেলেো স্বপন। কিন্তু মৃত বোন পুষ্পিতার ভালবাসাময় জীবনের শোভনে সপ্তরঙা ঝকমকে প্রচ্ছদের মত একটা ভাললাগার বোধ ঘিরে রাখলো তাকে। নক্ষত্রখচিত প্রেমময় হৃদয়ের ভালবাসার এক আকাশ ভরা প্রেম নিয়ে, পুষ্পিতা অনুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো স্বপনের পাশে। কৈশোরিক স্মৃতির ধুসর রেলগাড়ির ঝিক্-ঝিক্ শব্দওঙ্কারে বেঁচে রইলো স্বপন, কাকন, ঝর্ণা আর ওদের নবারুণ গাঁ!

You may also like...