সৌদি আরবে আমার “শিরোচ্ছেদ” এর অর্ডার হয়েছিল !

সুশিক্ষিত উচ্চাকাঙ্খী আমার মায়ের ইচ্ছে ছিল আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা এ জাতীয় উন্নত কেন দেশের নাগরিক হই আমি। কিন্তু বার বার ফিরে আসি তার আঁচলতলে আমি। আমার ইঞ্জিনিয়ার মেজোভাই ১৯৭৭-সন থেকেই জেদ্দার কিং আ: আজিজ ভার্সিটির “কুলিয়াতুল হান্দেসা” মানে ফ্যাকাল্টি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কর্মরত ছিলেন। মা তাকে নির্দেশ দিলেন, “বাংলাদেশ থেকে যেহেতু কানাডার ভিসা পাওয়া বেশ জটিল। তাই আমাকে সৌদি নিয়ে, সেখান থেকে যেন কোন সৌদির মাধ্যমে কানাডা পাঠানো হয়”।
:
১৯৮৭ সনে ঢাকা ভার্সিটির বাংলার মাস্টার্স শেষপর্ব এবং ১৯৯০-সনে ঢাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে “এমএড” পরীক্ষা দিয়েই আমি চলে যাই জেদ্দা। উদ্দেশ্য জেদ্দা থাকা নয়, সেখান থেকে কানাডা পাড়ি দেয়া। “মোহাম্মদ ওসমান আল-শায়ের” নামে এক ব্যবসায়ী সৌদির সাথে মেজোভাইর একটা চুক্তি হয়। ১০,০০০ রিয়ালের বিনিময়ে, সে তার সেক্রেটারী বানিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে কানাডা ও ওখানে ছেড়ে চলে আসবে সে। ১৯৯০-সনে জেদ্দা পৌঁছেই “কিউরিসিটি”-বসত একদিন জেদ্দার বাংলাদেশ দূতাবাসে যাই আমি। সেখানে গিয়ে দেখি, দূতাবাস পরিচালিত ঢাকা বোর্ড অন্তর্ভুক্ত বাংলাদাশ দূতাবাস স্কুলকে কলেজে উন্নীত করা হয়েছে ও কলেজ শাখায় একজন করে “প্রভাষক” নেয়া হবে। জাস্ট ফান কিংবা “কি হয় দেখি” হিসেবে সেখানে “ইন্টারভিউ” দেই আমি। এবং আমাকে বাংলা “প্রভাষক” হিসেবে ঐ স্কুল কাম কলেজে নিয়োগ প্রদান করা হয়। শুনে ভাই বলেন, “কদিন ক্লাস কর এখানে, যতদিন ঐ সৌদি তোকে কানাডা নিয়ে না যায়”!
:
ব্যবসায়ী “মোহাম্মদ ওসমান আল-শায়ের” ছিল তায়েফের একজন গায়ক ও লোককবি। সাধারণত এ ধরণের কবিমনা লোকদের মন-মানসিকতা উদার হয়। তার ইলেকট্রনিক্স ব্যবসা ছিল চীন ও তাইওয়ানের সাথে। “এলসি” খুলে সে প্রায় প্রতিমাসে কোটি টাকার মালামাল আমদানী করতো চীন-তাইওয়ান থেকে। কিন্তু সে ইংরেজি জানতোনা বা “এলসি খোলা” ইত্যাদি বুঝতোনা। একদিন আমাকে প্রস্তাব দিলো, আমি যদি তার সাথে নিয়মিত চীন-তাইওয়ান যাই ও তার ব্যবসার কাজে তাকে সহযোগিতা করি, তবে তিনি তার ব্যবসার লাভের অর্ধেক আমায় দেবেন। মানে পুঁজি তার, আর মেধা ও দাপ্তরিক কাজ আমার। দূতাবাস পরিচালিত কলেজে তখন মাত্র দুটো শাখা ছিল। একটা মেয়েদের, একটা ছেলেদের। তাতে দৈনিক মাত্র দুটো ক্লাস নিতে হতো আমার। মানে দুপুর ১-টার মধ্যেই আমি ফ্রি হয়ে যেতাম। কখনো সখ করে দশম শ্রেণিতেও ক্লাস নিতাম আমি বাংলার। কানাডা যাওয়ার প্লান বাদ দিয়ে “মোহাম্মদ ওসমান আল-শায়ের”এর সাথে বিকেলে তার অফিসে নিয়মিত বসতে থাকলাম। রোজার মাস এলে কলেজ বন্ধ হয়ে গেলো, দেড় মাসের জন্য। এই সময় সৌদি আল শায়েরের সাথে প্রোগ্রাম হলো চীন-তাইওয়ান যাবো আমরা দুজনে।
:
কিন্তু বাংলাদেশের পাসপোর্টে তখন লেখা থাকতো “ইসরাইল ও তাইওয়ান যাওয়া বারণ”। জেদ্দা তাইওয়ান এ্যামবেশী থেকে বাংলাদেশ পাসপোর্ট দেখেই তা ছুড়ে ফেলে দিলো দূতাবাস কাউন্টারের মহিলা। সৌদি আল শায়ের তা তার তাইপের ব্যবসায়িক পার্টনারকে জানালে, সে তাইপের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের “বিশেষ পার্মিশান” নিয়ে তা পাঠালো জেদ্দার তাইওয়ান দূতাবাসে। এবার চীন আর তাইওয়ান দুদেশের ভিসাই পেলাম আমি। ১৯৯১-সনে এই প্রথম আমার চীন তাইওয়ান যাওয়া। ব্যবসা বেশ জমে গেলো সৌদির সাথে। মাসে আমার ব্যবসায়িক আয় ৫/৬ লাখ টাকা, আর কলেজ থেকে বেতন ও বিভিন্ন দায়িত্বের ভাতাসহ সাকুল্যে পাই প্রায় লাখ খানেকের মত। কন্যা ছোট নাবিলাসহ তার মাকে নিয়ে যাই জেদ্দা। নাবিলাকে ভর্তি করাই আমাদেরই স্কুলে ক্লাস টু-তে।
:
দূতাবাস পরিচালিত স্কুল-কলেজের শিক্ষক হিসেবে জেদ্দা কমিউনিটির আওয়ামী পরিবারের লোকজনের সাথে খুব সখ্যতা গড়ে ওঠে আমার। ৩-টা আওয়ামী সংগঠন ছিল তখন জেদ্দা। কিং ফাহাদ হাসপাতালের ড. মতিউর রহমানের “(ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ, যাকে তারা আওয়ামীলীগ বলতো, ঘাটাইলের ৯ম সংসদের MP হয়ে মারা যান তিনি কবছর আগে), চট্টগ্রামের সোনা আলীর (বঙ্গবন্ধু পরিষদ) এবং কিং ফাহাদ হাসপাতালের ডা: আলমের (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ)। ৩-জনেই তাদের দলে টানতে চাইতো আমায় আমার কর্মদক্ষতার কারণে। আমার অজান্তে বিভিন্ন পদে তাদের কমিটিতে তারা রেখে দিতো আমার নাম! তাদের “বার্ষিকী” ইত্যাদি সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছিলাম বেশ কবার আমি। কিন্তু ঘটনাক্রমে প্রায় ২৭-লাখ সৌদি প্রবাসীর যে সকল ছেলে-মেয়ে দূতাবাস স্কুল-কলেজে পড়তো, তাদের অধিকাংশ পরিবার ছিল জামাতি কিংবা জামাত-ঘেষা। এর মধ্যে আওয়ামী ৩-সংগঠনের পরামর্শে কলেজ কর্তৃপক্ষ, মানে দূতাবাস থেকে আমাকে দায়িত্ব প্রদান করে “কলেজ বার্ষিকী” প্রকাশনা ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক “আলোকচিত্র” ও “কুইজ প্রতিযোগিতা” আয়োজনের। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও মুক্তচিন্তক মানুষ হিসেবে ক্লাসে অবলীলায় বাংলাদেশ, এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তানের ভূমিকা, ৭১-এ সোভিয়েত ভূমিকা, আমেরিকান ৭ম নৌবহর প্রেরণ, পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশী রাজাকার আলবদর আলসামস ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করি আমি ক্লাসে। এই প্রথম প্রকাশিত কলেজ বার্ষিকীতেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক নানাবিধ লেখা অন্তুর্ভুক্ত করি। বঙ্গবন্ধু বিষয়ক “কুইজ” প্রতিযোগিতার জন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক ছোট বই বাংলাদেশ থেকে নিয়ে তার ফটোকপি করে, তা সকল শিক্ষার্থীর মাঝে ফ্রি বিতরণ করি পড়ার জন্য।
:
আমার পুরো কাজে জেদ্দার আওয়ামী পরিবার হাততালি তথা “বাহবা দেয়” এবং ১৯৯৭-সনে এসকল কর্মকান্ডের জন্য “জেদ্দা কনসুলেট” আমাকে “সম্মানসূচক পুরস্কার” প্রদান করে (যার প্রত্যয়ন সংযুক্ত হলো)। কিন্তু জামাতিরা বসে থাকেনা চুপচাপ। তারা নিয়মিত আমার সকল কর্মকান্ড “গভীর পর্যবেক্ষণ” করতে থাকে ও ক্লাসে আমি কখন কি-কি বলি, তা তাদের ছেলে-মেয়েদের থেকে সংগ্রহ করে নিয়মিত। উল্লেখ্য, ১৯৭১-৭২ সনে জামাতি বড়-বড় রাজাকার, আলবদর-রা পাকিস্তানি পাসপোর্টে সৌদি আরবে গিয়ে “কমিউনিস্ট নাস্তিক বাংলাদেশে” তাদের দূরবস্থার কথা তুলে ধরে ওবং সৌদি সরকার এমন অন্তত ২০০০-বাংলাদেশ বিরোধীকে, তখনই সৌদি নাগরিকত্ব প্রদান করে। তারা সৌদি সরকারি বড়-বড় পদে দখল করে। রেডিও জেদ্দা, রাবেতা, ওয়ামি, সৌদি শরিয়াহ ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ে মাদ্রাসায় পড়ুয়া ও আরবি জানার কারণে জামাতি এসব লোক বড় পোস্টে চাকরি পেয়ে যায়। এরাই মূলত সৌদি সরকারের সাথে লবিং করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে সৌদিকে বিরত রাখে এবং বাংলাদেশ বিরোধী “প্রপাগান্ডা” চালাতে থাকে। এখনো জামাতের মূল শক্তি ও অর্থ জোগানদাতা হচ্ছে ঐ সৌদি গ্রুপ। উল্লেখ্য, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরক্ষণেই ১৬ আগষ্ট ১৯৭৫ সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সেটাও হয়েছিল ঐ জামাতি লবিস্টদের কারণে!
এই শক্তিশালী জামাতি গ্রুপ আমার ব্যাপারটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং আমি দূতাবাস স্কুলে-কলেজে থাকলে, তাদের ছেলেমেয়েদের “ব্রেন-ওয়াশ” করে “কমিউনিস্ট তথা বাংলাদেশ প্রেমিক” বানিয়ে ফেলবো, এ চিন্তনে তারা তাদের সংগঠনের মাধ্যমে গোপনে আমার বিরুদ্ধে “ইসলাম বিরোধী ব্যক্তি” হিসেবে সৌদি শরিয়াহ তথা “যথাযথ স্থানে” অভিযোগ দায়ের করে। আমি দূতাবাস পরিচালিত কলেজে কাজ করলেও, আমার “স্পনসর” তথা “কফিল” ছিল সৌদি “মোহাম্মদ ওসমান আল-শায়ের” নামের ঐ কবি। মানে আমি দূতাবসের ভিসাধারী ছিলামনা। জামাতি শক্তিশালী গ্রুপ লবিং করে ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগ তুলে, ন্যুনতম ৪-জন পুরুষ সাক্ষী আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে, অত্যন্ত গোপনে আমার “শিরোচ্ছেদের অর্ডার” করে ফেলে। কিন্তু ঐ জামাতি গ্রুপের একলোক “টিচার হিসেবে আমাকে যোগ্য ও ভাল মানুষ” মনে করতো। রাজনৈতিক কারণে তিনি আমাকে ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিতে চাইলেও, আমার “শিরোচ্ছেদ হোক” এটা জামাতি হলেও সে কামনা করতোনা। তাই বিষয়টা তিনি শেষ মুহূর্তে গোপনে আমার ভাইকে জানিয়ে দেন। সবশুনে আমরা সাহায্য প্রার্থনা করি, আমার ব্যবসায়িক পার্টনার আরবি লোকজ কবি “মোহাম্মদ ওসমান আল-শায়ের”এর। শিরোচ্ছেদের চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আমার “ফাইল” তখনো সৌদি বাদশার কাছে যায়নি। ঠিক সেই মুহূর্তে “মোহাম্মদ ওসমান আল-শায়ের” এক সৌদি ক্ষমতাধর প্রিন্সকে বুঝিয়ে বলেন যে, “আমি একজন খুব ভাল মুসলমান, তার সাথে নিয়মিত নামাজ পড়ি, হজ্জ ওমরাহ করেছি এবং আমার বিরুদ্ধে এটা হচ্ছে, বাংলাদেশের “নিকৃষ্ট রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র”! ঐ প্রিন্স সৌদির কথা বিশ্বাস করে ও সম্ভবত ব্যাপারটা বুঝতে পারেন কিন্তু যেহেতু “ওপর মহল” থেকে আমার “শাস্তি ঘোষিত হয়েছে”, তাই তা একদম বাতিলের বদলে তা “লঘু” করে, তিনি আমাকে “শিরোচ্ছেদের বদলে” “ডিপোর্টেশন আদেশ” করাতে সমর্থ হন। যাকে আরবিতে বলে “খুরুজ আল আউদা” মানে “চিরদিনের জন্য বহিস্কার”। উল্লেখ্য, জেদ্দায় জামাতিরা আরবি ভাষা ও কোরান বোঝার একটা “নৈশ কোচিং” পরিচালনা করতো নাজলায়। কোরান বোঝা ও আরবি ভাষা শিক্ষার জন্য আমি ঐ কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে প্রায় ৫/৬ মাস ক্লাস করেছিলাম। আমার উপকার হতে পারে মনে করে, আমার ভাই ঐ কোচিং পরিচালককে, এমন একটা “প্রত্যয়নপত্র” আরবিতে দিতে বলেন যে, “আমি সেখানে ভর্তি হয়ে কোরান ও আরবি ভাষা অধ্যয়ণ করেছি”। কিন্তু জামাতি ঐ লোক এমন কোন প্রত্যয়ন দিতে অস্বীকার করে। মানে তারা চাইছিলো আমার “শিরোচ্ছেদ” হয়ে যাক। এ ঘটনাকাল ১৯৯৯ সনের।
:
শিরোচ্ছেদের অর্ডারকে “দেশ থেকে বহিস্কারে” নামিয়ে আনার পর একদিন ক্লাসচলাকালীন সময়ে আমার ক্লাসের সামনে এসে সৌদি পুলিশ আমাকে ডাক দেয় “তাআল” বলে। আমি তাদের অনুসরণ করি। তখন স্কুলের ক্লাসে আমার কন্যা নাবিলা ও কলেজের সামনের রাস্তায় আমার “নিশান সানি” গাড়ি পার্ক করা, আর আমার স্ত্রী আমার নাজলার বাসায় একা। সৌদি পুলিশ তাদের গাড়িতে বসিয়ে সরাসরি আমাকে জেদ্দা এয়ারপোর্টের রানওয়েতে নিয়ে আসে। তারা আরবিতে বলে যে, “তুমি একজন “মোদারেছ” (শিক্ষক) তাই তোমাকে সম্মান করছি আমরা। তোমার হাতে পায়ে শেকল দিয়ে, চোখ বেঁধে, বিমানে তুলে দেয়ার নির্দেশ ছিল আমাদের প্রতি। কিন্তু “মোদারেছ” হওয়াতে কেবল তোমার পায়ে শেকলটা দিলাম বাধ্য হয়ে। তখন বোর্ডিং ব্রিজ থেকে অন্তত ২/৩ কি.মি. দূরে ঢাকাগামী সৌদি জ্যাম্বোজেট দাঁড়ানো ছিল। আমাকে আনার অন্তত আধাঘন্টা আগেই সকল ঢাকাগামী যাত্রীকে বিমানে তুলে কেবল আমার জন্য বিমানটি অপেক্ষা করছিল। আমার দুহাত দুজন সৌদি পুলিশ ধরে, সামনের সিঁড়ি দিয়ে আমাকে বিমানে তুলে পায়ের শেকল খোলা হলো। এ বিমানগুলোতে সাধারণত শ্রমিকরা আসে বলে, পুরো ইকোনমিক ক্লাস তাই ঠাসা থাকে। বিমানের একজন সৌদি ক্রুর কাছে আমার বিষয়টা আরবিতে বুঝিয়ে বলে পুলিশদ্বয়। এও বলে ইনি একজন “মোদারেছ”, তাই তাকে যেন যথাযথ সম্মান করা হয়। আমার পাসপোর্টটি বিমান ক্রুর কাছে দিয়ে আমার সাথে হাত মিলিয়ে আকস্মিক আমাকে দুজনে “স্যালুট” করে, নেমে যায় সৌদি পুলিশদ্বয়। তাদের স্যালুটে চোখে জল নামে আমার! পাইলট একা আমাকে বিজনেস ক্লাসে বসিয়ে রাখে। বিমান টেকাপ করার পর, আমার পাসপোর্ট আমার হাতে দিয়ে দেয় বিমান ক্রু!
:
জেদ্দা খবর রটে যায়, আমাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। আমার ভাইসহ আত্মীয় স্বজনরা স্থানীয় থানা ও পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পাগলের মতো খোঁজ করতে থাকে আমায়। প্রায় ৭-ঘন্টা জার্নি-শেষে ঢাকা পৌঁছে জেদ্দা প্রথমে ভাইকে ফোন করি আমি যে, “আমি এখন নিরাপদে ঢাকায়”। আমার গাড়ি বিক্রয়, “মোহাম্মদ ওসমান আল-শায়ের” এর সাথে কিছু ব্যবসায়িক লেনদেন হিসেব-নিকেশ শেষ করে প্রায় দুমাস পর আমার স্ত্রী ও কন্যা ফিরে আসে বাংলাদেশে। সব শুনে সান্ত্বনা দিতে আওয়ামী নেতারা গ্রুপ গ্রুপ করে (যেহেতু ৩-গ্রুপ ছিল সাপে-নেউলে সম্পর্কের) আমার জেদ্দার বাসায় আসে। তারা কেউ কেউ প্রতিশ্রুতি দেয়, আমার স্ত্রী ও কন্যার টিকেট করে দেবে। বাসায় ফেলে আসা আমার মালামালগুলো তারা বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজারকে বলে, ফ্রিতে বা কার্গোতে বা কোন কন্টিনারে দেশে যাতে পাঠানো যায়, তার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু কিছুই করেনি তারা। সব কিছু করেছে আমার সেই ভাই (যিনি এখন মৃত)। ঘরের দামি কার্পেট থেকে শুরু করে ফ্রিজ, ফ্যাক্স, ওয়াশিং মেশিন, ভিসিআর, টিভিসহ সকল মালামাল তিনি কার্গোতে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন নিজ খরচে। কোরিয়ান “সামসাং” সে ফ্রিজটি এখনো আমার বাসায় আছে ভাল অবস্থায়। আমার স্ত্রী ও কন্যাকে বিদায় জানাতে জেদ্দা এয়ারপোর্টে কজন আওয়ামী নেতা আসেন, যাদের পরামর্শে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক কাজ করতে গিয়ে, মূলত আমার এতোবড় “শাস্তি” হয়েছে! তারা কজনে সম্মিলিতভাবে একটা “চিকন সোনার চেইন” দিতে যায় আমার কন্যাকে। কিন্তু রাগে ক্ষোভে আমার স্ত্রী তাদের সামনেই ঐ চেইন ছুঁড়ে ফেলে দেয় অনেক দূরে!
:
দেশে ফেরার কদিন পরই পত্রিকায় “বিজ্ঞাপন” দেখি উন্নয়ন সহযোগী European Commission (EU) এর আর্থিক সহযোগিতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা Project-এ নানাপদে লোক নেয়া হবে। বিজ্ঞাপনে বর্ণিত “উপ-পরিচালক” (প্রোগ্রাম লিঁয়াজো অফিসার) পদের সব যোগ্যতা মিলে যায় আমার সাথে। ঐ প্রকল্পে “বিভাগীয় কর্মকর্তা” হিসেবে চাকরি হয় ২০০০-সনের এপ্রিলে আমার। ঐ প্রকল্পের আওতায় বৃটেনের প্লিমাউথে শিক্ষা ম্যানেজমেন্টে ওপর প্রশিক্ষণে ২০০২-সনে বৃটেনে যাওয়ার অর্ডার হয়, অপর ১১-জন সরকারি অফিসারের সাথে। কাতার এয়ারে যাত্রা ছিল আমাদের। মানে ঢাকা-দোহা-লন্ডন ফ্লাইট। দোহাতে ১২-ঘন্টার ট্রানজিট। টিকেটে বলা ছিল, এই ১২-ঘন্টা একটা ফোর-স্টার হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করবে কাতার এয়ার আমাদেরকে। আমার নতুন পাসপোর্টের সাথে পুরনো পাসপোর্টটিও স্টাপল করা ছিল। প্রথমে সবার পাসপোর্ট জমা নিলো transit-transfer desk-এ. কিন্তু ১০-জনের জন্যে হোটেলের কুপন নিয়ে এলেও, আমাকে বললো, “তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে দেবোনা। কারণ সৌদি আরব থেকে তোমার পাসপোর্টে যে “সিল” দেয়া হয়েছে। তাতে বলা আছে, KSA & GCC-ভুক্ত কোন দেশেই ঢুকতে পারবেনা তুমি। সুতরাং তোমাকে লাঞ্চ, ডিনার, টি-কফির কুপন দিচ্ছি। কিন্তু এই ১২-ঘন্টা থাকতে হবে এই ট্রানজিট লবিতেই”। UK-থেকে ফেরার পথেও একই ঘটনা ঘটলো আমার সাথে। এই হলো আমার জীবন ট্রাকের আরেকটা না বলা কাহিনিকাব্য !
:
নোট : জেদ্দা কিং আ: আজিজ ভার্সিটিতে কর্মরত (এখন মৃত) আমার ভাইর ইচ্ছে ছিল, আমি তারমতো “উত্তম ধার্মিক” হই। তাই তিনি তার আগ্রহে, তার খরচে ২০১৭-সনে “ওমরাহ” করাতে জেদ্দা নেন আমাকে। তখন পুরনো কার্ডের ঠিকানা ধরে “মোহাম্মদ ওসমান আল-শায়ের”কে অনেক খুঁজেছি আমি। কিন্তু তার সেই অফিস ভবনটি আর তখন সেখানে ছিলনা! সেখানে তখন পুরনো ৪-তলা ভবনের স্থানে ২০-তলা আধুনিক ভবন। আগের ফোন নম্বরও অচল ছিল তখন। কেউ চিনতে পারলোনা ১৯৯৯ সনের তায়েফের ঐ গীতিকবি “মোহাম্মদ ওসমান আল-শায়ের”কে!

You may also like...