বই পরিচিতি ও পাঠ-পর্যালোচনা

বই: আরজ আলী সমীপে
লেখক: আরিফ আজাদ
প্রকাশনী: সমকালীন প্রকাশন
পৃষ্ঠা : ১৪৯
.
বইটি পড়ার আগে অবশ্যই আরজ আলী মাতুব্বর সাহেবের ‘সত্যের সন্ধান’ বইটি পড়তে হবে, কেননা এই বইটি সে বইয়ের জবাবে লিখিত হলেও এতে সে বইয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উল্লেখ করা হয়নি, অনেক প্রশ্নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। পাঠকরা দুটো বই পাশাপাশি রেখে পড়লে এই বইটির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারবেন।
.
সংক্ষেপে মূল্যায়ন:
.
আরজ আলী মাতুব্বর সাহেবের ‘সত্যের সন্ধান’ বইটির জবাবেই এই বইটি লিখিত। বইটিতে লেখক গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রশ্ন বাদ দিয়ে ও অনেক প্রশ্নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এড়িয়ে গেছেন। মাতুব্বর সাহেব তার বইয়ে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন তার লেখা ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, বইটিতে অন্যান্য ধর্ম ও দর্শন নিয়েও স্পষ্ট প্রশ্ন থাকার পরেও আরিফ আজাদ বারবার বইটিকে ইসলামের বিরুদ্ধে ধরে নিয়ে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার তুলে ধরাকে মাতুব্বর সাহেবের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা বলে অভিযোগ করেছেন, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মাতুব্বর সাহেবের বইয়ে উল্লেখ থাকার পরেও এমন প্রশ্ন করেছেন যে সন্দেহ জাগবে আরিফ আজাদ ‘সত্যের সন্ধান’ বইটি ভালোভাবে পড়েছেন কিনা! মাতুব্বর সাহেব রেফারেন্স দেননি অভিযোগ করে আরিফ আজাদ নিজেই অনেক কথা রেফারেন্স ছাড়া বলেছেন, বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে বিজ্ঞানকে ভরসা করা যায় না বলে নিজেই বিজ্ঞানের রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন এমনকি এক লোকের বিতর্কিত গবেষণাকে বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দিয়েছেন। তাকদীর ও বিবর্তনকে মাতুব্বর সাহেব খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও আরিফ আজাদ এ দুটোর আলোচনায় ১৩২ পৃষ্ঠার মূল বইয়ের ৫০ পৃষ্ঠার মতো নষ্ট করেছেন! অল্প কিছু প্রশ্নের জবাব দেয়ার সুন্দর চেষ্টা করেছেন সেটা অস্বীকার করা যাবে না, কিন্তু ‘সত্যের সন্ধান’ বইটির ৫ শতাংশ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন বললেও অত্যুক্তি হবে।

বিস্তারিত মূল্যায়ন :
.
.
আত্মা বিষয়ক
আমি কে? মাতুব্বর সাহেবের করা দর্শনের এই গুরুত্বপূর্ণ ও অমিমাংসিত প্রশ্নের জবাব দেয়া তো দূর উল্লেখই করেননি আরিফ আজাদ। প্রশ্ন না বুঝেই উদ্ভট সব আলোচনা করেছেন।
প্রাণ কি অরূপ না স্বরূপ? এ প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন প্রাণ দৃশ্যমান নয় তবে তার অস্তিত্ব আছে, দেহে প্রবেশ করে ও বের হয়। কিসের ভিত্তিতে লিখেছেন তিনিই জানেন। আরিফ আজাদ লিখেছেন, নিরাকার জিনিসেরও সংখ্যা হয় যেমন ডার্ক ম্যাটার!!
এরপর মন ও প্রাণ কি এক? এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ মাতুব্বর সাহেবের সাথে একমত পোষণ করেছেন কিন্তু প্রাণ নিষ্ক্রিয় হলে মানুষের মন থাকে না মাতুব্বর সাহেবের এই মতকে Dr. Jeffrey Long নামক ব্যক্তির বিতর্কিত রেফারেন্স দিয়ে অসত্য ও অবৈজ্ঞানিক বলেছেন!
পরের প্রশ্নে মাতুব্বর সাহেব দেহকে জড় পদার্থ বলেছেন জড় উপাদান দ্বারা গঠিত বলে, সেখানে দেহের সাথে প্রাণ ও মনের মিলনে কেন প্রাণসঞ্চার হয় প্রশ্ন করেছেন। আরিফ আজাদ জবাবে লিখেছেন প্রতিটি কোষই আলাদাভাবে জীবিত, আর দেহের উপাদান পরমাণুও জড়ের মতো আচরণ করে না, তাতে ইলেকট্রন ঘুরে।
প্রাণ কি চেনা যায়? এ প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন আসলেই প্রাণ চেনা যায় না, তবে আত্মা অদৃশ্য হলেও চেনা যায়।
আরো তিনটি প্রশ্ন, আমি কি স্বাধীন? অশরীরী আত্মার কি জ্ঞান থাকবে? প্রাণ কিভাবে দেহে আশা যাওয়া করে? থাকলেও তার দুটো লেখক পরে আলেচনা করবেন বলে আর কিছু লেখেননি এই অধ্যায়ে! (যদিও বইয়ের পরবর্তী অংশে আমি কি স্বাধীন ছাড়া অন্য দুটো প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন বলে আমার চোখে পড়েনি।)
.
.
ঈশ্বর বিষয়ক
আল্লাহর রূপ কি এই প্রশ্নে মাতুব্বর সাহেব বলেছেন নিরাকার বা সর্বব্যাপী আল্লাহ আসনে বসে ফেরেশতাদের দিয়ে কাজ করানোর দরকার কি? এ প্রশ্নের আল্লাহর রূপ অংশ এড়িয়ে আরিফ আজাদ ফেরেশতাদের দিয়ে কাজ করানোকে ব্যাখ্যা করেছেন মানুষ নিজে পেরেও রোবটকে দিয়ে করানোর উদাহরণ দিয়ে!
খোদা তা’আলা কি মনুষ্য ভাবাপন্ন এই প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন আল্লাহর গুণাবলি অনুধাবনের জন্যই আল্লাহ মানুষকে সেসব গুণ দিয়েছেন! কিন্তু উল্টোটা হওয়াতোও সম্ভব, মানুষ কল্পনা করেছে বলে মানুষই ঈশ্বরকে নিজেদের গুণের সর্বোচ্চ দিয়ে কল্পনা করেছে।
স্রষ্টা কি সৃষ্টি হইতে ভিন্ন এই প্রশ্নটি মাতুব্বর সাহেব করেছেন স্রষ্টার সর্বব্যাপীত্ব ভিত্তি করে, এর জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন, কুরআন, হাদীস ও ইসলামের চার মাজহাবের ইমামরা কেউই আল্লাহকে সর্বব্যাপী মনে করে না, উপরে আকাশে আরশে সমাসীন মনে করে।
ঈশ্বর কি স্বেচ্ছাচারী নাকি নিয়মতান্ত্রিক এই প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ অহেতুক পেঁচিয়ে গোঁজামিল দিতে চেয়েছেন মনে হয়েছে, কুরআন থেকেই দেখানো সম্ভব আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন, তার অনুমতি ছাড়া কেউ (সুপারিশ,ক্ষতি) কিছুই করতে পারে না অর্থাৎ স্বেচ্ছাচারী! ঈশ্বর স্বেচ্ছাচারী হলেও ধর্ম টিকে থাকবে, কেবল টিকবে না ধর্মব্যবসা!
আল্লাহ ন্যায়বান না দয়ালু এই প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ প্রথমে ন্যায়বান ও দয়ালু একইসাথে হওয়া সম্ভব না বলেও কিছুটা পেঁচিয়ে গোঁজামিল দিতে চেয়েছেন বলে মনে হয়েছে।
আল্লাহর অনিচ্ছায় কোনো ঘটনা ঘটে কি এ প্রশ্নের সহজ ও কুরআন ঘোষিত উত্তর ‘না’ কে এড়িয়ে আরিফ আজাদ অহেতুক নিজের ভুল ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে প্রায় ২০ পৃষ্ঠা লিখেছেন!
কিন্তু নিরাকারের সাথে নিরাকারের পার্থক্য কি, নিরাকার পদার্থ দৃষ্টিগোচর হয় কিভাবে, স্থান-কালও শক্তি সৃষ্ট না অসৃষ্ট (সৃষ্ট হলে স্রষ্টা সেসব কোন স্থানে, কোন সময়ে, কোন শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন), সৃষ্টির যুগের আগে কোন যুগ (সবকিছু সৃষ্টির আগে ঈশ্বর কি করছিলেন), ঈশ্বর কি দয়াময় (তাহলে পৃথিবীতে এত নিষ্ঠুর অলঙ্ঘনীয় নিয়ম কেন) এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গেছেন।
.
.
পরকাল বিষয়ক
জীব সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন কুরআন অনুযায়ী পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের জন্য বানানো হয়েছে। কিন্তু মাতুব্বর সাহেবের প্রশ্ন ছিল মানুষ ছাড়াও অনেক প্রাণীর জ্ঞান আছে, তারাও ভালো এবং খারাপ হয় তাহলে তাদের স্বর্গ-নরক থাকবে না কেন? শুধু মানুষের খাবার হিসেবে সৃষ্ট হলে সব প্রাণী তো মানুষের খাদ্য নয় আর অহেতুক তাদের ব্যাথা অনুভবের জন্য কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র কেন?
পাপ-পূণ্যের ডায়েরি কেন প্রশ্নে মাতুব্বর সাহেব বলেছেন আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা, সর্বজ্ঞানী হলে অহেতুক ফেরেশতাদের নিয়ে লেখা কেন? আরিফ আজাদ জবাবে লিখেছেন, ডকুমেন্ট রাখার জন্য!!
পরকালের সুখ-দুঃখ শারীরিক, না আধ্যাত্মিক প্রশ্নে মাতুব্বর সাহেব জানতে চেয়েছেন শরীর মরার পর অন্য জীবের খাদ্য হয়ে তার শরীরের অংশ হয়ে গেলে তাকে কিভাবে শারীরিকভাবে সুখ-দুঃখ দেওয়া হবে, এর জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন যেমন করে ফোন হারিয়ে গেলেও ফেসবুক আইডি অক্ষত থাকে, শরীর মরে গলে মাটির সাথে মিশে গেলেও আল্লাহ আবার তৈরি করতে পারবেন!
গোর আজাব কি ন্যায়সঙ্গত প্রশ্নে মাতুব্বর সাহেব বলেছেন গোর আজাবের বিবরণ থেকে জানা যায় এটা ভূগর্ভস্থ আজাব, তাহলে যাদের দেহের কবর হয় না, শিয়াল-শকুন-সমুদ্রের মাছে খায় তাদের গোর আজাব কিভাবে হবে আর গোর আজাব কেয়ামত পর্যন্ত হলে আজ মারা যাওয়া, দু হাজার বছর আগে মারা যাওয়া ও কেয়ামতের দুদিন আগে মারা যাওয়া সমান অপরাধ করা মানুষের গোরের শাস্তি কি ন্যায়সঙ্গত হবে?
পরকালের স্বরূপ কি, স্বর্গ-নরক কোথায় এ প্রশ্নগুলোর জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন বিজ্ঞান অনেককিছুই জানে না, তবে এক ব্যক্তি নাকি NDE থেকে পরকালের প্রমাণ পেয়েছে! (যা বিজ্ঞান মোটেই সমর্থন করে না, ড্রাগ দিয়েও মানুষকে NDE বা Near Death Experience অনুভব করানো যায়।) মাতুব্বর সাহেব হিমালয় থেকে স্বর্গে যাওয়া, হাশরের মাঠ, সেখানে সূর্য থাকা, বেহেশত দোজখের বাতাসে শীত গ্রীষ্ম হওয়াকে ভিত্তি করেই বলেছেন তেমন হলে পৃথিবী, সৌরজগত বা আশেপাশে অবস্থান হওয়ার কথা, কিন্তু দেখা যায় না কেন? আরিফ আজাদ লিখেছেন আল্লাহ চাইলেই সূর্যকে কাছে আনতে পারেন বা আরেকটা সূর্য বানাতে পারেন।
ইহকাল ও পরকালের সাদৃশ্য কেন সে প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন, মানুষকে পরিচিত জিনিসের উদাহরণ দিয়ে বোঝাতেই এমন হয়েছে। কিন্তু এমন হওয়াটাও অসম্ভব কি, যে এসব স্বর্গ-নরক-পরকালের বিবরণ মানুষ লিখেছে বলেই মানুষের জানা জিনিসের মতোই এসব!
.
.
ধর্ম বিষয়ক
প্রশ্ন অংশে মাতুব্বর সাহেবের প্রশ্ন ছিলো, আল্লাহ মানুষকে পরিবর্তন না করিয়া ঝঞ্ঝাট পোহান কেন? আরিফ আজাদ সে প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন, আল্লাহর ইবাদত করাই মানুষ সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, অথচ কুরআনে সুরা যারিয়াতের ৫৬ নং আয়াতে স্পষ্টই বলা হয়েছে মানুষকে আল্লাহর ইবাদাত ছাড়া অন্য কিছুর জন্যই তৈরি করা হয়নি। আবার আরিফ আজাদ আল্লাহ জানেন মানুষ কি করবে বলে লিখেছেন মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার কথা অথচ দুটো একইসাথে অসম্ভব, কেউ কারো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এমনটা জানা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল ভাগ্যলিপি কি অপরিবর্তনীয়? জান্নাত-জাহান্নাম সহ ভাগ্য মানুষ মায়ের পেটে থাকতেই নির্ধারিত হয়ে যায়, মানুষ যতই চেষ্টা করুক সেটা পরিবর্তন করতে পারে না, এমনটা সহীহ বুখারীর হাদিসে থাকার পরেও আরিফ আজাদ এখানে স্বাধীন ইচ্ছার গোঁজামিল দিতে চেষ্টা করেছেন।
এরপর আদমের পাপ কি প্রশ্নেও আরিফ আজাদ স্বাধীন ইচ্ছার প্রসঙ্গ এনেছেন, কিন্তু মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা থাকলেও সেটা যে আল্লাহর ইচ্ছা/পরিকল্পনা নস্যাৎ করতে সক্ষম নয় সেটা তিনি বললেন না।
পরের প্রশ্ন শয়তান কি? কিভাবে বংশবিস্তার করে? মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর উগ্র, অনৈতিক আচরণের কারণও কি শয়তান? এ প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন শয়তান ফেরেশতা নয়, জ্বীন, তাই বংশবিস্তার করতে পারবে। কুরআনে ফেরেশতাদের সেজদা দিতে বললে শয়তান দেয়নি এর একটি হাস্যকর ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, মেজরিটিকে আদেশ করলে নাকি মাইনরিটির উপরও বর্তায়! কিন্তু মূল প্রশ্ন মানুষের অনৈতিক আচরণে শয়তান কারণ হলে অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে কে সেটা আরিফ আজাদ এড়িয়ে গেছেন।
উপাসনার সময় নির্দিষ্ট কেন প্রশ্নে মাতুব্বর সাহেব বলেছেন পৃথিবীর সর্বত্রই কোনো না কোনো সময় নামাজ হয়, তাহলে উপাসনার নির্দিষ্ট বা নিষিদ্ধ সময়ের কি তাৎপর্য? যেসব দেশে ছয়মাস দিন থাকে সেসব দেশে কিভাবে উপাসনা হবে? বছরে পাঁচওয়াক্ত নামাজ? সেটা হলেও একমাস রোজা রাখবে কিভাবে? আরিফ আজাদ উপাসনার নির্দিষ্ট সময়কে স্কুলে নির্দিষ্ট সময় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন! এছাড়া উপাসনার নির্দিষ্ট দিক কেন প্রশ্নের জবাবে বিশৃঙ্খলা এড়াতে একই দিকের কথা বলা হয়েছে, অথচ নবী মুহাম্মদের ইচ্ছাতেই কাবার দিকে মুখ করতে বলা হয়েছে, যা মোটেই নির্দিষ্ট এক দিক নয় আর গোলকাকার পৃথিবীতে সম্ভবও নয়।
নাপাক বস্তু কি আল্লাহর কাছেও নাপাক, কতগুলি খাদ্য হারাম হইল কেন, ফেরেশতা কি এই প্রশ্নগুলো আরিফ আজাদ এড়িয়ে গেছেন।
ফেরেশতাদের কাজ কি? আল্লাহর হুকুম ছাড়া ফেরেশতারা কিছুই করতে পারে না, তবে কি ফেরেশতা অহেতুক নয়? নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর আর নবী না আসলে জীবরাঈল কি করছে? মিকাইলের খাদ্য ও আবহাওয়ার নিয়ন্ত্রণে অযৌক্তিকতা কেন? ইস্রাফিল একটা ফুঁ দেওয়ার জন্য এত বছর থাকার মানে কি আর ফুঁ দেওয়ার পর কি করবে? আজরাইল কি শুধু মানুষের প্রাণ নেয় নাকি জীবাণু, গাছেরও? ঔষধ প্রয়োগে যে জীবাণু মারা যায় তার প্রাণ নেয় কে? এমন মুনকার-নকীর, কেরামান কাতেবিন সম্পর্কেও প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু আরিফ আজাদ সেসব এড়িয়ে শুধুমাত্র লিখেছেন আল্লাহ এসব কাজ নিজেই পারতেন, তবু ফেরেশতাদের দিয়ে করিয়ে তার ক্ষমতা প্রকাশ করেন।
দূরত্বহীন যাতায়াত কি সম্ভব প্রশ্নে মাতুব্বর সাহেব বলেছেন আল্লাহ ও নবীদের মধ্যে দূরত্ব না থাকলে জীবরাঈল কিভাবে ওহী নিয়ে যাতায়াত করতো আর দূরত্ব থাকলেও তাহার পরিমাণ কত? এ প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন আল্লাহ তার সম্মান বজায় রাখতে নিজে না এসে জীবরাঈলকে পাঠায়!! কি প্রশ্ন করলো, কি উত্তর দিল!!
মেরাজ কি সত্য, না স্বপ্ন? এ প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন বুরাক কোনো জন্তু নয়, যে বিমান দেখেনি তাকে বোঝাতে আমরা যেমন পাখির মতো বলি, তেমনি নবী বলেছে, আর বুরাকে করে নবী মুহাম্মদ আকাশেও যায়নি। অথচ হাদিস বলছে, ‘তারপর সাদা রং এর একটি জন্তু আমার নিকট আনা হল। যা আকারে খচ্চর থেকে ছোট ও গাধা থেকে বড় ছিল? জারূদ তাকে বলেন, হে আবূ হামযা, ইহাই কি বুরাক? আনাস (রাঃ) বললেন, হাঁ। সে একেক কদম রাখে দৃষ্টির শেষ প্রান্তে। আমাকে তার উপর সাওয়ার করানো হল। তারপর আমাকে নিয়ে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) চললেন, প্রথম আসমানে নিয়ে এসে দরজা খোলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হল, ইনি কে?’ [সহীহ বুখারী (ইফা), ৩৬০৮] আবার আরিফ আজাদ বের করেছেন বুরাক শব্দটি এসেছে আলো থেকে তাই তার গতি আলো বা তার চেয়েও বেশি হতে পারে, কিন্তু যতোই হোক দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বাইরে যাওয়া কয়েক মিনিটে সম্ভব কি?
এক নেকী কতটুকু এই প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন ভালোবাসার মতোই এটা পরিমাপ করা যায় না কিন্তু হাদিসে দশ নেকি বলা হয়েছে কেন? আমরা কি তোমাকে দশ ভালোবাসি বলি?
পাপের কি ওজন আছে (মীযানে পরিমাপের জন্য) এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ লিখেছেন পাপের ওজন নেই, হিসেব আছে, একটা মিথ্যা একটা পাপ, খুন একটা পাপ এভাবে! হাস্যকর নয় কি? সব পাপের মাত্রা কি একই?
পৌত্তলিকতার সাথে ইসলামের সাদৃশ্য কেন এমন প্রশ্ন করে মাতুব্বর সাহেব ইসলামি রীতির ৩২ টি বড় মিল দেখিয়েছেন হিন্দু ধর্মের সাথে, এর কারণ কি অনুকরণ এমন প্রশ্ন রেখেছেন কিন্তু সেটা আরিফ আজাদ একপ্রকার এড়িয়েই গেছেন।
আরব ও এর আশেপাশেই অধিকাংশ নবী কেন এসেছে, বার এর মাহাত্ম্য কি, এক এক ধর্মে একেকদিন পবিত্র কেন, চাঁদের ফজিলত কি, চাঁদ দেখেই ইসলামের বিভিন্ন ইবাদত-উৎসব কেন এই প্রশ্নগুলোর জবাব আরিফ আজাদ এড়িয়ে গেছেন, সমাজে প্রচলিত শবে বরাতের ফজিলত নিয়ে প্রশ্ন আরিফ আজাদ এটা বলে এড়িয়ে গেছেন যে এমনটা ধর্মে নেই!
জীবহত্যায় পূন্য কি এমন প্রশ্নে মাতুব্বর সাহেব হিন্দুদের বলি ও মুসলিমদের কুরবানিতে পূণ্য কেন কারণ জানতে চেয়েছেন, কুরবানি প্রথাকে বিশ্লেষণ করে ইব্রাহীমের ঘটনার ২৫০০ বছর পরে প্রচলন কেন সহ এটাকে ঘিরে অনেকগুলো প্রশ্ন করেছেন কিন্তু আরিফ আজাদ শুধুমাত্র প্রিয়বস্তু কুরবানি করতে নয়, পুত্রকেই কুরবানি করতে বলেছে বলে প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গেছেন, অথচ মাতুব্বর সাহেবও বইয়ে নবী ইব্রাহিম স্বপ্নে পুত্রকে কুরবানি করতে দেখেছেন উল্লেখ করেছেন! আরিফ আজাদ কি বইটিই ভালোভাবে পড়েনি?
পাথরে (হাজরে আসওয়াদ) চুমু খাওয়া নিয়ে মাতুব্বর সাহেব বলেছেন অনুভূতিহীন একটা উল্কাপিণ্ডকে চুমু খাওয়ার মানে হয় না, আরিফ আজাদ লিখেছেন সেটা আবেগে করে, আবেগ হলেই কি অর্থপূর্ণ হয়?
.
.
প্রকৃতি বিষয়ক
প্রশ্ন অংশে আরজ আলী মাতুব্বরের প্রথম প্রশ্ন ছিল মানুষ ও পশুতে সাদৃশ্য কেন? সেখানে তার প্রশ্ন ছিলো মানুষকে মাটি থেকে বানানো হয়েছিল, অন্য প্রাণীদের কি থেকে বানানো হয়েছিল? তাদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-সংগঠন, গাঠনিক উপাদান, জৈবিক প্রক্রিয়ায় এত মিল কেন? হাওয়া নাহয় গন্ধম ফল খাওয়ায় তার রজঃচক্রের শাস্তি হয়েছিল, অন্য প্রাণীর হয় কেন? এতসব প্রশ্নের জবাবে আরিফ আজাদ শুধু লিখেছেন কুরআন অনুযায়ী মানুষ ও অন্য সব প্রাণী পানি থেকে তৈরি, তাই এত মিল। উত্তরটা আমার মোটেই যুতসই মনে হয়নি।
দ্বিতীয় প্রশ্নে মাতুব্বর সাহেব বলেছেন আকাশ বলতে সাধারণত শূন্যস্থান বোঝায় কিন্তু ধর্মমতে সে শূন্যস্থানের সংখ্যা সাত হয় কিভাবে, তিনি তৎকালীন বিভিন্ন ধর্মগুরুর ব্যাখ্যা নিয়েও কথা বলে সেগুলো কল্পনা নয় কি বলে প্রশ্ন রেখেছেন। আরিফ আজাদ সে প্রশ্নের জবাবে উইকিপিডিয়া থেকে আকাশের সংজ্ঞা দেখাতে গিয়ে ভুল অনুবাদ করেছেন, ‘…on which the Sun, stars, planets and Moon appear to be travelling.’ (…যার ওপর সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি ও গ্রহগুলো ভ্রমণ করছে বা ভেসে বেড়াচ্ছে বলে মনে হয়) এটার অনুবাদ তিনি করেছেন, ‘অর্থাৎ সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র সবকিছুকে নিয়েই হচ্ছে আকাশ।’ তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় সূর্য যদি আকাশের অংশই হয়, তবে আকাশে সূর্য উঠেছে বলার কোনো মানে হয়?
তৃতীয় প্রশ্নে দিবারাত্রির কারণ প্রসঙ্গে মাতুব্বর সাহেব (সহীহ হাদীসেও আছে) সূর্য আরশের নিচে যাওয়া-সেজদা করা ও পুনরায় উদিত হওয়ার প্রসঙ্গ এনেছেন যা বিজ্ঞানসম্মত নয়, আরিফ আজাদ সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কুরআন হাদীসের কোথাও এমন কথা তন্নতন্ন করে খুঁজে পাওয়া যাবে না বলেছেন (অজ্ঞতা/ইচ্ছাকৃত মিথ্যা)!
এরপর পৃথিবী কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত প্রশ্নে মাতুব্বর সাহেব উল্লেখিত মাছের পিঠে পৃথিবী থাকার কথা ইসলামে নেই বলে আরিফ আজাদ সাহেব দাবি করেছেন, অথচ ইবনে আব্বাসের সহীহ রেওয়াতে তাফসীর ইবনে কাসীর সহ বেশ কিছু তাফসীর গ্রন্থে এমনটা উল্লেখ আছে।
ভূমিকম্প কেন হয় ও জোয়ার ভাটা কেন হয় এ দুটো প্রশ্ন লেখক পৌরাণিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে করেছেন। আরিফ আজাদ সাহেব সে দুটো ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় বলেছেন, কিন্তু এই বইয়ের সবকিছুই ইসলাম সংশ্লিষ্ট এমনটা আরিফ আজাদের মনে হলো কেন সেটা বোধগম্য হয়নি আমার!
বজ্রপাত হয় কেন? (ফেরেশতাদের দ্বারা?) রাত্রে সূর্য কোথায় থাকে? (আরশের নিচে?) ঋতুভেদের কারণ কি? (জান্নাত জাহান্নামের নিঃশ্বাস?) এ প্রশ্নগুলো আরিফ আজাদ এড়িয়ে গেছেন।
উত্তাপহীন অগ্নি কিরূপ? এই প্রশ্নটা ছিলো নবী ইব্রাহিমকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপে অগ্নি উত্তাপহীন হওয়া প্রসঙ্গে লৌকিক বিবেচনায় প্রশ্ন করেছেন, আরিফ আজাদ এর জবাবে আল্লাহর ইচ্ছায়, অলৌকিক কিছুটা এমনই বলেছেন।
হযরত নূহ নবীর সময়ের মহাপ্লাবন পৃথিবীর সর্বত্র হইয়াছিল কি? এই প্রশ্নে মাতুব্বর সাহেব বলেছেন একটানা চল্লিশদিন বৃষ্টি হওয়া সম্ভব না, হলেও সে পানিতে পাহাড় ডুবে যাওয়া সম্ভব না, মানুষের পাপে নিষ্পাপ প্রাণীরা মরিল কেন? আল্লাহ সবাইকে মারতে আজরাইলকে বললোই পারতো, মহাপ্লাবনের কি দরকার ছিলো? পৃথিবীব্যাপী হইলে সব প্রাণীও গাছের বীজ নূহ নবী সংগ্রহ করলো কিভাবে আর মহাপ্লাবন শেষে সব প্রাণী বিচ্ছিন্ন মহাদেশে পৌঁছাল কিভাবে? বাইবেলে বর্ণিত সময়কাল ও নৌকার আকার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন, আরিফ আজাদ শুধু সেটাই বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন কুরআন কোথাও বলেনি মহাপ্লাবন পৃথিবীজুড়ে হয়েছে [কিন্তু প্রশ্ন জাগবে পৃথিবীর সর্বত্র না হলে প্রত্যেক প্রাণীর একজোড়া করে নৌকায় নিতে বলেছিল কেন?], হলেও হতে পারে সেটা মিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগের কথা যেহেতু কুরআন সময়ও উল্লেখ করেনি এবং আল্লাহই সর্বজ্ঞাত।
.
.
বিবিধ বিষয়ক
প্রশ্ন অংশে আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব প্রশ্ন করেছেন অনেকগুলো,
আদম কি আদি মানব?
নীল নদের জল শুকাইল কেন?
হযরত মুসা সীনয় পর্বতে কি দেখিয়াছিলেন?
হযরত সোলায়মানের হেকমত না কেয়ামত?
যীশু খ্রীষ্টের পিতা কে?
জ্বীন জাতি কোথায়?
সূর্য বিহীন দিন কিরূপ?
ফরায়েজে ‘আউল’ কেন?
স্ত্রী ত্যাগ ও হিলা প্রথার তাৎপর্য কি?
কিন্তু আরিফ আজাদ সে প্রশ্নগুলোর মাত্র একটি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাও ভুলভাবে। মাতুব্বর সাহেব দেখাতে চেয়েছেন আদিপুস্তকে আদমের জন্ম ৪০০৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বলা হয়েছে কিন্তু তার আগেও মানুষ থাকার, সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়, এছাড়াও আদিপুস্তকের বিবরণ থেকে দেখিয়েছেন আদমের পূর্বেও মানুষ ছিলো, আদিপুস্তকের বিবরণ সত্য হলে বিচ্ছিন্ন অন্য মহাদেশগুলোতে মনুষ্যবসতি গড়ে ওঠার কথা না। এখানে বিবর্তন তেমন একটা গুরুত্ব না পেলেও লেখক আরিফ আজাদ বিবর্তনের বিরুদ্ধেই ১৩২ পৃষ্ঠার মূল বইয়ের ৩০ পৃষ্ঠা নষ্ট করেছেন, অন্য প্রশ্নগুলোর বা এই প্রশ্নেরই বড় অংশ আলোচনাই করেননি।

ধন্যবাদ ?
শামস অর্ক

You may also like...