“ধর্মব্যবসা ও চুলকানি’র মলম বিক্রি প্রসঙ্গ”

—উত্তর বঙ্গের বাসে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা মহাখালী যাইতেছিলাম। ৩৫ বছর বয়সী এক লোক কাঁদে ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠে উচ্চস্বরে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় যাত্রী ভাই ও বোনেরা। আমি আপনাদের দির্ঘ্য ৪০ বছর যাবত সেবা দিয়ে আসছি,আপনারা মনোযোগ দিয়ে আমার কয়েকটা কথা শুনুন। দাউদ,খাউজ,একজিমা,খুজলি পাচরা এবং চুলকানি;আঙ্গুলের চিপায় চাপায় ঘাঁ,রানের চিপায় চাপায় ঘাঁ; উঠতে চুলকানি, বসতে চুলকানি,ঘুমাইতে চুলকানি, খাইতে চুলকানি;চুলকাইতে-চুলকাইতে এক লুঙ্গি সাতদিনের বেশি পরতে পারেন না;চুলকাইতে মজা লাগে, অতঃপর জ্বলে!যারা এই সর্বনাশা চুলকানি থেকে মুক্তি পেতে চান,তাদের জন্য আমার কাছে আছে মোরগ মার্কা শান্তি মলম;এই মলমের দাম মাত্র দশ টাকা-দশ টাকা।যারা নিবেন তারা ১০টি টাকা বের করে যাগায় বসে থাকুন এবং মলমটা নিয়ে নিন।—-আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, এই মলমে চুলকানি ভাল না হইলে টাঙ্গাইল করটিয়া আমার চেম্বারে যোগাযোগ করবেন এবং টাকা ফেরত নিবেন!”

প্রিয় সুধী, খেয়াল করুনঃ এই ক্যানভাসারের আসল উদ্দেশ্য কিন্তু সেবা দেওয়া নয়।উদ্দেশ্যে;মলম বিক্রি!

ঠিক এই মলম বিক্রেতার মতই আমাদের সমাজে হুজুরগণ ধর্ম বিক্রি করছে দেদারসে !তারা বলছে;যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করেন,নবীকে মানেন,পরকালে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি পেতে চান এবং ইহকালে আল্লাহর অনুগ্রহ পেতে চান,তারা আমাদের অনুসরণ করুন ও কোরআন-হাদিস মোতাবেক জীবনকে পরিচালিত করুন!

মলম বিক্রেতার পুঁজি মলম;ধর্মব্যবসায়ীর পুঁজি দাড়ি,টুপি,পাঞ্জাবি, তসবিহ এবং কিছু আরবী কথামালা! আমরা বিশ্বাস, ভয় ও অনুভূতিকে কেন্দ্র করে এদের কাছ থেকে ধর্মের কলা ও মুলা ক্রয় করি!অদৃশ্য আল্লাহকে বিশ্বাস করে,পরকালের দোযখের আগুন থেকে মুক্তি পেতে এবং হুজুরগণ মিথ্যাচার করতে পারেন না–এই অনুভূতি থেকে হুজুরদের আমরা অনুসরণ করি,বিনিময়ে আমরা দেই তাদের টাকাকড়ি!খেয়াল করুন;হুজুরগণ আমাদের মুক্তির জন্য ধর্মোপদেশ দেন না,তারা মুলত ধর্ম বিক্রি করেন আমাদের কাছে!

আল্লাহর কোরআন প্রচার করে কিংবা নামাজ পড়িয়ে কি বিনিময় নেয়া যায়? –এমন প্রশ্নের উত্তরে হুজুরগণ বলেন,”আমি আমার জন্য যখন ইবাদত করবো,তখন কারো কাছ থেকে বিনিময় গ্রহণ করা যাবে না।যদি কেউ তার ইবাদতের জন্য আমাকে ডাকে, তখন তার কাছ থেকে বিনিময় গ্রহণ করলে অন্যায় হবে না।কারন;আমি তার পিছে যে সময়টা ব্যায় করবো,সে সময়টাতে যদি দুনিয়ার কাজে ব্যায় করি,তাহলে আমার সংসার ঠিকমত চলবে।”
এর মানে কি দাড়ালো? কাউকে কোরান হাদিস/নামাজ না শিখিয়ে হুজুর যদি অন্য কোথাও দিনমজুর বা ব্যাবসার কাজে সময় দেন, তাহলে হুজুরের রুটিরুজির ব্যবস্থা হয়।অন্যদিকে;হুজুর যদি আমাদের ধর্মশিক্ষা দেন এবং পারিশ্রমিক নেন,তাহলেও তার রুটিরুজির ব্যবস্থা হয়।সুতরাং ;এটা হুজুরের ধর্মব্যবসা,কথা ঠিক কিনা?

হুজুরদের যুক্তি বড় কড়া!আর এই যুক্তি দিয়েই তারা দুনিয়ায় বাড়িগাড়ি করিতেছেন,আরাম আয়েশে চলিতেছেন ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাচ্ছেন এবং হরদম ফতুয়া দিয়ে যাচ্ছেন;মূলে তারা দুনিয়ামূখী!অথচ;হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,”আল্লাহর নিকট যদি এই পৃথিবীর মূল্য একটি মশার পাখনার সমান হতো,তাহলে কোনো কাফিরকে এখানকার এক ঢোক পানিও কাফেরদের পান করাতেন না।”[দ্র.জামে’ আত-তিরমিযী,হাদিস নং-২৩২০]

যুক্তি যতো মজবুত হোক,বাস্তবতা যতই সত্য হোক,কোরআনের বাহিরে আমরা অবশ্যই যেতে পারবোনা। কোরআনের আয়াত প্রচার করতে গিয়ে যদি কারো সংসার না চলে,তাহলে সে প্রচার করবে না।কারন;দুনিয়া ও আখেরাত যারা একসাথে চায়,তারা নিশ্চিত লেবাসধারী!আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন,”যারা আমার আয়াতের বিনিময়ে সামান্য মূল্য গ্রহণ করে,তারা আগুন ছাড়া পেটে কিছুই ঢুকালো না এবং তারা অনুগ্রহের বিনিময়ে আযাব গ্রহণ করলো”।[দ্র.বাকারা/১৭৪]

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করিতেন,হুজুরদের সেই পথ অবলম্বন করিতে হবে,তাই নয় কি?তাহলে রাসুল কি কোরআন প্রচার করে টাকা নিতেন?এ ব্যাপারে কোরআন কি বলে?কোরআন বলে,”হে নবী! আপনি বলে দিন,আমি এর জন্য(কোরানের জন্য) তোমাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক চাইনা;এটি সারা বিশ্বের জন্য উপদেশ মাত্র।'[দ্র.আনআমা/৯০]

আল্লাহ বারবার বলেছেন,
“সত্য বক্তা হিসেবে তোমাদের প্রতি আমি যা অবতীর্ণ করেছি,তোমরা তা অস্বীকার করোনা,এবং আমার আয়াতের বিনিময়ে সামান্য মূল্য দিয়ো না(বাকারা/৪১)।
যারা আমার আয়াত সমূহ নগন্য মূল্যে বিক্রয় করে,তারা অতি নিকৃষ্ট (তওবা/৯)।
তোমরা আল্লাহর আয়াত এর বিনিময়ে সামান্য মূল্য গ্রহণ করোনা,নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে যা আছে তা তোমাদের জন্য উত্তম;যদি তোমরা জ্ঞানী হও (নাহল/৯৫)।”

আল্লাহ আরো বলেন,” যারা আমার নামে কৃত অঙ্গীকার এবং প্রতিজ্ঞা সামান্য মূল্যে বিক্রয় করে,আখেরাতে তাদের কোনো অংশ নেই,আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক আযাব![দ্র.আল ইমরান/৭৭]
এবার চিন্তা করুনঃ আল্লাহ এবং পরকালের শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক নিলে যাদের আযাব ভোগ করতে হবে,তারাই আমাদের ধর্মগুরু হিসেবে আজ প্রতিষ্ঠিত!আমরা তাদের অন্ধের মতো অনুসরণ করে চলছি!কি আজব!

আল-কোরআনের সুরা ইমরানের ১৯৯ নং আয়াত এবং মায়েদার ৪৪ নং আয়াতেও আল্লাহ ঘোষণা করেছেন,তার আয়াতের বিনিময়ে মূল্য গ্রহণ করা যাবে না!তথাকথিত হুজুরগণ এসব আয়াত কেনো আমলে নেন না?

অনেক হুজুর আছেন সাংসারিক কাজ ঠিক রেখে মসজিদে ইমামতি করেন এবং বেতন নেন।তাদের এ ব্যবসায় মহিলারাও পিছিয়ে নেই;তারা তালিমের নামে ইদানিং টাকা ইনকাম করছেন!মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষা দেবার নামে হুজুরগণ লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন!সাড়া জাগানো বক্তারা ২/১ ঘন্টা ওয়াজ করে ১০ হাজার,৩০ হাজার,৫০ হাজার, ১ লক্ষ কিংবা এর বেশি টাকাতেও কন্টাক্ট করে ওয়াজ করছেন!
কেউ কেউ হেলিকপ্টার যোগে ওয়াজ করতে এসে ২/৩ ঘন্টা ওয়াজ করে বলিতেছেন,”আমার নবী এতিম ছিলেন,গরীব ছিলেন;তিনি তপ্ত মরুভূমির পথ পারি দিয়ে বহুদূরে কোরআন প্রচার করেছেন;তিনি কোনো সম্পদের লোভ করেন নাই।”অতঃপর; ওয়াজ শেষে পোলাও কোর্মা খাইয়া, তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলিয়া,১ লাখ টাকার বান্ডিল পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকাইয়া উড়াল দেন আকাশে!কেনো এমন?এরা ধর্মটাকে কি পেয়েছে?এরা তো ইহুদি খ্রীষ্টানদের চেয়েও খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তাই নয় কি?
কোরআন নাজিল করার পূর্বে আল্লাহ ইহুদী খ্রীষ্টানদের উপরেও কিতাব নাজিল করেছিলেন;তারাও এইসব মোল্যাদের মতো আয়াত কেনাবেচা করতো!আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন,”আল্লাহ যখন আহলে কিতাবদের(ইহুদি-খ্রীষ্টানদের) কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলেন যে,তা(আয়াত) মানুষের নিকট বর্ননা করবে এবং গোপন করবে না,তখন তারা সে প্রতিজ্ঞা পেছনে ফেলে রাখলো,আর কেনাবেচা করলো সামান্য মূল্যের বিনিময়ে। সুতরাং কতই না জঘন্য তাদের এ কেনা কেনাবেচা। [দ্র.ইমরান/১৮৭]

হুজুরদের কবলে পড়া আমাদের মতো কিছু ভুক্তভোগীরা বলেন,”হুজুরদের ঘর সংসার আছে,তাদের ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীদের ভরনপোষণ করতে টাকা লাগে;অনেক হুজুরের বডিগার্ড আছে,বডিগার্ড এর বেতন দিতে হয়;তারা গাড়িতে চলেন,তাদের গাড়ির তৈল-গ্যাস খরচ আছে,গাড়ি নষ্ট হলে মেরামত করতে টাকা লাগে;হুজুরদের ম্যানেজার/এপিএস ও ক্যামেরাম্যানের বেতন দিতে হয়;সুতরাং, কোরআন প্রচারের বিনিময়ে অর্থ নেওয়া কিংবা কন্টাক্ট করা ঠিকই আছে!”বুঝলাম তাদের কথায় যুক্তি আছে।কিন্তু;কোরআন হাদিস কি এসবের নামে বিনিময় গ্রহণ করা সমর্থণ করেছে?বিনিময় গ্রহণ না করলে যাদের চলে না,তারা বয়ান করবে না,আমরাও তাদের বয়ান বা ওয়াজ নসিয়ত শুনবো না!কারণ;আল্লাহ আমাদের আদেশ দিয়েছেন,”অনুসরণ করো তাদের,যারা তোমার নিকট বিনিময় কামনা করে না।[দ্র.ইয়াসিন/২১]

আল্লাহর বাণী কোরআন প্রচারের নামে ভিক্ষা করা কিংবা ধর্মবিক্রি করা দুনিয়ার কুত্তারা আমাদের এসব কোরআনের আয়াত শিক্ষা দেন না!তারা কখনো বলেন যে,ওয়াজ করে টাকা নেওয়া কোরআন বিরোধী কাজ!অথচ;কিছু অসাম্প্রদায়িক মুক্তচিন্তার মানুষ যখন কোরআনের বিরোধিতা করে, তখন তাদের জবাই করার হুমকি ঠিকই দেন;একবারের জন্যও চিন্তা করেন যে,কোরআন বিরোধী নাস্তিকের যে অপরাধ,কোরআনের আইন অমান্য করে টাকা নিয়ে তিনিও একই অপরাধে অপরাধী!
বড় পরিতাপের বিষয়, হুজুরদের পাশাপাশি এদেশে মারফতি পীর ফকিরের বাচ্ছারাও মস্তিষ্ক প্রতিবন্ধি ভক্তদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে!

সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সেদিনের এই বাংলাদেশ সম্পর্কে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে কিছু বললে হয়তো কল্লা থাকবে না।তবুও ;বলে যাবো…..!

পরিশেষে পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়া নামক রাষ্ট্রের জনক জেমো কেনিয়াত্তার একটি বাণী দিয়ে আজকের মতো শেষ করতে চাই,দেখুন উনার রাষ্ট্রে ব্রিটিশ ক্যাথলিকেরা প্রবেশ করে– কি অবস্থা করেছিল!

“প্রথম যখন ধর্মপ্রচারকেরা এলো,তখন আমাদের ছিল জমি,আর তাদের হাতে ছিল বাইবেল।তারা আমাদের শেখালো,কি করে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে হয়।একদিন যখন আমরা চোখ খুললাম,দেখি আমাদের হাতে বাইবেল,আর ওদের কাছে আমাদের জমি!”

ধন্যবাদ

শহিদুল শাহ্

You may also like...