আল-কোরআন, আল্লাহ এবং শয়তান!

আরব্য পৌরাণিক গ্রন্থ আল-কোরআনের প্রধান দুইটি চরিত্র হল আল্লাহ এবং শয়তান। এই গ্রন্থে আল্লাহ হলেন একটি জগতের সৃষ্টিকর্তা, যা তিনি ৬/৮ দিনে সৃষ্টি করেছিলেন (কোরআন ১১:৭);

পুরো গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি বাক্যেই এই আল্লাহকে একজন মহাশক্তিধর, মহাজ্ঞানী এবং পরম দয়ালু বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অপরদিকে শয়তান ছিল তারই সৃষ্ট একটা জাতি জ্বীনদের প্রধান। জ্বীন থেকে শয়তান হয়ে যাবার পেছনে অবশ্য একটা গল্প আছে। গল্পানুসারে কারণটি হল – আল্লাহ যে জগৎ বানিয়েছিলেন, সেখানে মানুষ সদৃশ্য মাটির তৈরি একটা প্রাণী বানাতে যাচ্ছিলেন (কোরআন ২:৩০); এই প্রাণীটির নাম দেয়া হয়েছিল আদম। আল্লাহ আদমকে যখন বানানো শেষ করেছিলেন, তখন তিনি ফেরেশতাকূল (আরেকটি জাতি) এবং ঐ জ্বীনটিকে সেজদাহ করতে বলেছিলেন।

সকল ফেরেশতা আদমকে সেজদাহ করলেও জ্বীনটি নিজেকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করে (কোরআন ৭:১২) অহংকারবশত তাকে সেজদাহ করতে অস্বীকৃতি জানায় (কোরআন ২:৩৪); সেজদাহ না করায় আল্লাহ তার প্রতি অনেক ক্ষিপ্ত হন এবং তাকে ধিক্কার দিতে থাকেন। অতঃপর তাকে অভিশপ্ত ঘোষণা করেন (কোরআন ১৫:৩৪) এই ঘটনার পর আল্লাহ আদমকে জান্নাত নামক একটি জায়গায় প্রেরণ করেন। তার একাকীত্ব কাটানোর জন্য তিনি হাওয়া নামক আরেকটি স্ত্রী লিঙ্গের প্রাণীও তার সাথে দিয়ে দেন (কোরআন ২:৩৫); কিন্তু পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী – পৃথিবীতে পাঠানো হবে (কোরআন ২:৩০) বলে তাকে সৃষ্টির প্রধান কারণ হওয়া সত্ত্বেও ঠিক কী কারণে আদমকে জান্নাতে পাঠানো হয়েছিল, তা আমার বোধগম্য নয়।

যাই হোক, জ্বীনটি সেখানেও আদমকে তাড়া করেছিল। জান্নাতে পাঠানোর সময় আল্লাহ আদমকে একটি বৃক্ষের নিকটে যেতে নিষেধ করেছিলেন (কোরআন ২:৩৫); কিন্তু শয়তান নানা প্ররোচনায় আদম এবং হাওয়াকে সেখানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং প্রলোভনা দেখিয়ে সেই বৃক্ষের ফল খাইয়ে নেয় (কোরআন ৭:২২)। এই ঘটনায় আল্লাহ ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি তাদের ক্ষমা করেন ঠিকই, কিন্তু শয়তানসহ তাদেরকে পৃথিবীতে নেমে যেতে আদেশ দেন (কোরআন ২:৩৬) এবং সেই সাথে আদমকে শয়তান সম্পর্কে সচেতন করেন যে, সে এবং তার সন্তানাদি যেন তার কথামত না চলে (কোরআন ৬:১৪২)… তিনি শয়তানকে আদম এবং আদম সন্তানের প্রকাশ্য শত্রু বলেই আদমকে সাবধান করে দিয়েছিলেন (কোরআন ২:১৬৮)।

এতে করে আল্লাহ এবং শয়তানের মধ্যে একটি ওপেন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হয়, যা একপ্রকার যুদ্ধেই রূপ নেয়। শয়তান অনেকটা দৃঢ় চিত্ত নিয়েই দাবি করে যে, কেয়ামতের আগ পর্যন্ত সে আদম এবং তার সন্তানদের আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করে রাখবে (কোরআন ৭:১৭; কোরআন ১৫:৩৯); অপরদিকে আল্লাহও উল্টো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন যে, শয়তান অন্য কাউকে পারলেও তার একনিষ্ঠ বান্দাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না (কোরআন ১৫:৪২)।

সমস্ত কোরআন জুড়েই শয়তানকে সেই যুদ্ধে জয়ী হতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিভিন্ন সম্প্রদায়কে ধবংস করে দেয়া। কোরআনে বর্ণিত বিভিন্ন গল্প থেকে দেখা যায় যে, আল্লাহকে ছেড়ে প্রায় প্রতিটি নবীর সম্প্রদায়ই শয়তানকে বা বিভিন্ন দেব-দেবীর পুজায় মগ্ন হয়ে ওঠে। এ কারণে আল্লাহ তাদের ধবংস করে নতুন সম্প্রদায় সৃষ্টি করতে একপ্রকার বাধ্যই হয়ে যান।

কিন্তু এখানে হাস্যকর বিষয় হল, শয়তান আদমসন্তানদের তার প্রতিজ্ঞানুযায়ী বিভ্রান্ত করতে সক্ষম তো হয়েছিল ঠিকই (উদাহরণ কোরআন ৩৬:৬২ ); স্বয়ং আল্লাও এই বিভ্রান্তিরর কাজটি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন!

নিচের আয়াতগুলো পড়ুন:

যাকে ইচ্ছা আল্লা বিপথগামী করেন। (কোরআন ৬:৩৯)

আল্লাহ যাদেরকে পথনির্দেশ করেন তারাই তো পথপ্রাপ্ত এবং যাদের “পথভ্রষ্ট” করেন তাদের তাকে ব্যতিত অন্য কাউকে অভিভাবক হিসেবে পাইবে না। (কোরআন ১৭:৯৮)

সুতরাং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেছেন কে তাকে সৎপথে পরিচালিত করবে? (কোরআন ৩০:২৯)

আল্লাহ যাদের পথভ্রষ্ট করেন তাদের জন্য কোন পথপ্রদর্শক নাই। (কোরআন ৪০:৩৩; কোরআন ৪২:৪৪)

এইভাবে আল্লাহ বিভ্রান্ত করেন সীমালংঘনকারী এবং সংশয়বাদীদেরকে। (কোরআন ৪০:৩৪)

এইভাবে আল্লাহ কাফিরদের বিভ্রান্ত করেন। (কোরআন ৪০:৭৪)

আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার কোন গতি নাই। (কোরআন ৪২:৪৬)

আরেকটা মজার বিষয় হল, শুধু নিজেই নন, তিনি মাঝে মধ্যে নিজ থেকে শয়তান নিযুক্ত করে দেন আদম সন্তানকে পথভ্রষ্ট করার জন্য:

যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয় তার জন্য নিযুক্ত করি এক শয়তান। (কোরআন ৪৩:৩৬)

ওপরের আয়াতটির সাথে পাঠকদের সামনে আরো কয়েকটি আয়াত তুলে ধরতে চাই। যেমন:

মানুষের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করিবে নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সকলের দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করিবই। (কোরআন ৭:১৮; কোরআন ৩২:১৩)

বিষয়টা কেমন জানি হয়ে গেল না! আল্লা নিজেই আদমসন্তানের জন্য শয়তান নিযুক্ত করে দিচ্ছেন, যাতে তাদের বিভ্রান্ত করা যায় এবং অন্যদিকে তাদের জাহান্নামে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন!

এবার এই আয়াতটি পড়ুন:

আমি তো বহু জ্বীন এবং মানবকে জাহান্নামের জন্যই সৃষ্টি করেছি। (কোরআন ৭:১৭৯)

এই আয়াতে আল্লাহ দম্ভ করেই বলছেন, তিনি কিছু মানুষকে (আদমসন্তান) সৃষ্টিই করেছেন জাহান্নামে পাঠানোর জন্য! এর মানে কি এমন দাঁড়াল না যে, আদমসন্তানের মাঝে যারা জাহান্নামে, যাবে তারা নিজের কোনো দোষে যাবে না? আল্লাহই তাদের বিনা কারণে জাহান্নামে প্রেরণ করবেন! এটা কি স্বেচ্ছাচারিতা হয়ে গেল না?

এবার এই আয়াতটি খেয়াল করুন:

আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন, যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। (কোরআন ৩৫:৮)

এটা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আল্লার সৃষ্ট আদমসন্তানেরা নিজ থেকে কিছুই করে না। সবই আল্লার ইচ্ছার ওপর! তারা পথ পেলেও আল্লার ইচ্ছায় পায় এবং পথভ্রষ্ট হলেও সেটা আল্লার ইচ্ছাতেই হয়।

যারা ধৈর্য ধরে এতক্ষণ পড়েছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে এবার কিছু প্রশ্ন সামনে তুলে ধরতে চাই:

১. নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আল্লাহ একটা হিপোক্রিট চরিত্র হয়ে গেল না?

২. আদমসন্তানদের জাহান্নামে যাবার পেছনে দায়ী কে?

৩. আল্লাহ এবং শয়তানের মধ্যে তাহলে পার্থক্যটা কোথায় থাকল?

সর্বশেষ প্রশ্নটি কোরআন থেকেই করছি: “কিসে তোমাকে তোমার প্রতিপালক হইতে বিভ্রান্ত করিল?” (কোরআন ৮২:৬)।

ধন্যবাদ

শুভ্রনীল ব্রহ্মচারী

You may also like...