ইসলামে নিয়তি – নির্ধারিত ভাগ্য, তাকদীর

তাকদীর (আরবি: تقدير‎‎ অর্থ : নিয়তি) হল নির্ধারিত ভাগ্য। এ মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটবে আল্লাহ তার পূর্বজ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সেসব কিছু নির্ধারণ করেছেন – এই বিশ্বাসকে ইসলামে তাকদীর বলা হয়।

ইসলামে তাকদীরের ওপর বিশ্বাস করা আল্লাহ তা‘আলার রবুবিয়াত বা প্রভুত্বের ওপর বিশ্বাস করার অন্তর্ভুক্ত এবং তা ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্যতম একটি রুকন।

তাকদীরের স্তর

আল্লাহর অনন্ত জ্ঞানের ওপর বিশ্বাস করা, যা সকল বস্তুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। এ বিষয়ে কুরআনের অনুবাদ,
“তুমি কি জান না যে, আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, আল্লাহ তা জানেন? নিশ্চয় তা একটি কিতাবে রয়েছে। অবশ্যই এটা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ।”
— সূরা ২২ আল-হাজ, আয়াত ৭০

লাওহে মাহফুযে আল্লাহর জ্ঞান অনুযায়ী ভাগ্য লিখে রাখার ওপর বিশ্বাস করা। এ বিষয়ে কুরআনের অনুবাদ,
“…এ কিতাবে আমি কোনো কিছুই বাদ দেইনি…”
— সূরা ৬ আন‘আম আয়াত ৩৮

হাদীসে বলা হয়েছে,
“আসমান-যমীন সৃষ্টির ৫০ হাজার বৎসর পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টজীবের তাকদীরসমূহ লিখে রেখেছেন।”
— সহীহ মুসলিম

আল্লাহর কার্যকরী ইচ্ছা ও তাঁর ব্যাপক শক্তির ওপর বিশ্বাস করা। এ বিষয়ে কুরআনের অনুবাদ,
“আর তোমরা ইচ্ছা করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছা করেন।”
— সূরা ৮১ আত-তাকওয়ীর, আয়াত ২৯

হাদীস থেকে জানা যায় এক ব্যক্তি যখন মুহাম্মাদ কে লক্ষ্য করে বলেছিল ‘আল্লাহ এবং আপনি যা চেয়েছেন’ তখন তিনি বলেছেন, “তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে দিলে? বরং তিনি একাই চেয়েছেন।”

আল্লাহকে সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করা। এ বিষয়ে কুরআনের অনুবাদ,
“..আল্লাহই তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কর তা সৃষ্টি করেছেন?”
— সূরা ৩৭ আস-সাফফাত আয়াত ৯৬

ভরসা ও ধৈর্যধারণ

ইসলামে তাকদীর বা ভাগ্যের ব্যাপারে মানুষকে কল্যাণ অর্জনের জন্য ও অকল্যাণ বর্জনের জন্য আল্লাহ্-র উপর ভরসা করতে বলা হয়। হাদীসে বলা হয়েছে,
“তোমার জন্য কল্যাণকর কাজের প্রতি যত্নবান হও, আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর, আর অপারগতা প্রকাশ করিও না। আর তুমি যদি কোনো কষ্টের সম্মুখীন হও তবে এইরূপ বলিও না যে আমি যদি এ কাজ করতাম তাহলে এই হত; বরং বলো যে, ‘এটা আল্লাহর নির্ধারণ, আর তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন’। কারণ, ‘যদি’ কথাটি শয়তানের কর্ম খুলে দেয়।”

এছাড়া বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে এবং তা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিতে বলা হয়। হাদীসে বলা হয়েছে,
“যে বিপদ তোমাকে আক্রমণ করেছে তা তোমাকে ভুল করে অতিক্রম করে চলে যাবার নয়। আর যে বিপদ তোমাকে আক্রমণ করেনি তা তোমাকে স্পর্শ করার ছিল না।”

এ বিষয়ে কুরআনের অনুবাদ,
“আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন বিপদই আপতিত হয় না। যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহ তার অন্তরকে সৎপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে সর্বজ্ঞ।”
— সূরা ৬৪ আত-তাগাবুন, আয়াত ১১

ইরাদা

ইরাদাকে দুই প্রকারে ভাগ করা হয় :

ইরাদা কাউনিয়া ক্বাদারিয়া (সৃষ্টিগত ও প্রাকৃতিক ইচ্ছা) : সকল সৃষ্টিকূলের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত ইচ্ছা যেটি সংঘটিত হয়।
দ্বিতীয়: ইরাদা দীনিয়া শর‘ঈয়াহ (দ্বীন হিসেবে আল্লাহর ইচ্ছা) : দীনী নির্দেশ বা উদ্দেশ্য।
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, আল্লাহর সৃষ্টিগত ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়, সেখানে শরী‘আতগত ইচ্ছা থাকতেও পারে নাও থাকতে পারে। যদিও আল্লাহ অন্যায় সংঘটিত হওয়ার ইচ্ছা করেন ঘটে যাওয়ার দিক থেকে, কিন্তু তিনি তা দ্বীন হিসাবে পছন্দ করেন না, ভালোবাসেন না ও তার প্রতি নির্দেশও দেন না। বরং তা থেকে নিষেধ করেন। অন্যদিকে আনুগত্যপূর্ণ কর্ম ও ঈমান আনয়ন করাকে আল্লাহ তা‘আলা ভালোবাসেন, সেটার নির্দেশ দিয়েছেন, সুন্দর প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও তার ইচ্ছা ছাড়া তার অবাধ্য হওয়া যায় না।

মাধ্যম গ্রহণ বা উপায় অবলম্বন

ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, যদি বিপদ থেকে রক্ষাকারী মাধ্যম, যা গ্রহণ করার জন্য ইসলামী শরীআত অনুমতি দিয়েছে, তা পরিত্যাগ করার কারণে কেউ বিপদে পতিত হয়, তবে সে নিজেকে বিপদ থেকে রক্ষাকারী মাধ্যম গ্রহণ না করার কারণে দোষী হবে। আর যদি এই বিপদ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তার না থাকে, তবে ধৈর্যধারণ করলে সে পূণ্যের অধিকারী হবে। ইসলামের নবীগণ নিজেদেরকে শত্রু থেকে রক্ষা করার জন্য বিবিধ পদ্ধতি ও মাধ্যম গ্রহণ করেছিলেন।

[অতএব, আল্লাহপাকের নির্ধারিত তাকদীরের উপর ভরসা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব কিছুই পূর্বনির্ধারিত। সাবধানেও থাকতে হবে। এবং পূর্বনির্ধারিত খারাপ কিছু না ঘটিয়ে ভাল কিছু ঘটানোর অনুরোধ জানিয়ে প্রার্থনাও করতে হবে। আর পূর্বনির্ধারিত তকদির অনুযায়ী মানুষকে কিছু কিছু কাজ করতে দেখলে আল্লাহপাক ক্রুদ্ধ হয়ে পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে কিছু তাৎক্ষণিক গজবও নাজিল করেন। তখন পূর্বনির্ধারিতভাবে বেশী বেশী প্রার্থনা করে তাঁর রাগ কমানোর চেষ্টা করা উচিৎ। ]

শুভ্রনীল বহ্মচারী

You may also like...