ভিনগ্রহীদের সন্ধানে (In search of Aliens)

লেখকের কল্পনায় এলিয়েনের মুখোমুখি

আচ্ছা একবার আপনার চোখ বুজে কল্পনা করেন পুরো এই মহাবিশ্বকে, দেখবেন একটা বিশাল একাকিত্ব ও শূন্যতা আপনাকে ঘিরে ধরেছে। আর ঠিক এই চিন্তা ধারা থেকেই মূলত একটি প্রচলিত ও বিখ্যাত প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে আর তাহলো “ আমরা কি এই মহাবিশ্বে একা ?” তবে সুদুর অতীতে অনেক প্রচেষ্টা চালানো হয় এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার কিন্তু এই রহস্য আজও ভেদ করা সম্ভব হয়নি। তন্মধ্যে অন্যতম একটি প্রচেষ্টা ছিল যখন ১৯৯০ সালে VOYEGAR -1 এবং VOYEGAR -2 কে পাঠানো হয়  আমাদের সৌরজগতের বাইরের অবস্থা দেখতে। তাদেরকে দুদিকে পাঠানো হয় মূলত প্রানের সন্ধানে । তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি ছিল বিজ্ঞানীরা কিছু বার্তা পাঠান  এই মহাকাশযানদের মাধ্যমে যেন ভিনগ্রহ প্রাণীরা আমাদেরকে সহজেই খুঁজে পায় আর তাহলো দুটি মহাকাশযানের মধ্যেই দুটি স্বর্ণেরপাত বসানো হয়।

ঐতিহাসিক স্বর্ণের চাকতি

এই স্বর্ণের গোল ডিস্কটি ১৯৭৭ সালের ২৩ শে আগস্ট বসানো হয়। এই ডিস্কটির ব্যাস রেখার ১২ ইঞ্ছি ( ৩০ সেমি ) হল তামার ডিস্কের উপর স্বর্ণের পাত বসানো । ডিস্কটি আলুমিনিয়ামে বেষ্টিত এবং Electroplating এর মাধ্যমে বিশুদ্ধ Uranium – 238 এর আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়েছে এবং এই Uranium – 238 এর অর্ধায়ু ৪.৪৬৮ বিলিয়ন বছর। এখানে Uranium – 238 কে ব্যবহার করা হয়েছে যেন এর তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে ডিস্কটিকে শনাক্ত করতে পারে। এই ডিস্কটিতে ছিল একটি গ্রামোফোন রেকর্ড । এতে বাংলা সহ ৫৪ টি ভাষায় শুভেচ্ছা, “ আক্কাডিয়ান্দের” সামার ভাষায় ৬ হাজার বছর পুরনো একটি শুভেচ্ছা দিয়ে এবং  যেটা শেষ হয়েছে WU যা একটি মডার্ন চাইনিজ উপভাষা । এখানে পৃথিবীর শব্দ ছাড়াও প্রায় ৯০ মিনিটের Eastern এবং Western Classical এবং উপজাতীয় সমস্ত গান । এই মিশনটির প্রধান ছিলেন Dr. Carl Sagan । তিনি এবং তাঁর সহকারী মিলে পৃথিবী সংক্রান্ত মোট ১১৫ টি ছবি সংযুক্ত করেন । এছাড়াও এই ডিস্কে কিছু Electric Signal দেয়া হয়েছে যেন তারা সেগুলোকে ডায়াগ্রাম ও ছবিতে রূপান্তর করতে পারে।

গ্রামোফোন রেকর্ড

আসুন এবার ব্যাখ্যা করা যাক ডিস্কটির মধ্যে খোদাইকৃত সংকেতগুলোর ব্যাখ্যাঃ

১। স্বর্ণের ডিস্কটির উপরে বাম দিকে যে প্রতীকটি রয়েছে তাহলো একটি গোলাকার প্রতীক যা হল একটি রেকর্ড সিস্টেম। এই রেকর্ড সিস্টেমের Rotation হলো 3.6 sec এবং এতে ১ ঘণ্টা ধরে চালনা করার মত রেকর্ড রয়েছে । এছাড়াও এই রেকর্ডের শব্দ তরঙ্গগুলো Binary Number এ রূপান্তর করার সিস্টেম রয়েছে যেন উন্নত সভ্যতার প্রাণীরা পেলে তারা তা Binary Number এ রূপান্তর করতে পারে। এই Binary Number গুলোকে আবার Pixel অর্থাৎ ছবিতে রূপান্তর করা যায়।

২। এরপর বাম দিকের নিচের প্রতীকটি হলো আমাদের সূর্যের কাছাকাছি ১৪ টি Pulsar এর অবস্থান। এই ১৪ টি Pulsar হলো আমাদের সূর্যের সবচেয়ে কাছের Pulsar এবং Binary Number গুলো এই ১৪ টি Pulsar  কম্পাংক বহন করে।

৩। এরপর হাতের ডান দিকের নিচের প্রতীকটি হলো ২টি হাইড্রোজেন পরমাণুর সর্বনিম্ন অবস্থা। বিন্দুর সাথের উলম্ব রেখাগুলো পরমাণুর প্রোটন এবং ইলেকট্রনের ঘূর্ণনরত অবস্থা প্রকাশ করে । এই পরমাণুর এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থাতে পৌছাতে যে সময় লাগে তাকে Digit 1 প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর ঠিক মাঝের ছবিটির মাধ্যমে Video image Frame কে দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে স্ক্যান করার দিকটি। বাইনারি কোডগুলো প্রকাশ করে প্রতিটি ছবি স্ক্যান করতে ৫১২ টি উলম্ব রেখার সৃষ্টি হবে । যখন একটি ছবি সম্পূর্ণভাবে স্ক্যান করা শেষ হবে তখন প্রথম ছবিটি দেখা যাবে একটি বৃত্ত।

৪। ডানদিকের  উপরের ছবিটি প্রকাশ করেছে রেকর্ডিং থেকে প্রাপ্ত Video Signal এর প্রাথমিক তরঙ্গরুপ। রেকর্ডিঙে কিছু Video Signal কে তরঙ্গ আকারে সঞ্চালিত করা হয়েছে যার প্রাথমিক রূপটি এই ডিস্কে প্রকাশ করা হয়েছে।

ভিনগ্রহীরা কি আমাদেরকে কখনও কোনো সংকেত দিয়েছে?

বিজ্ঞানীরা আমাদের এই প্রশ্নের প্রতিনিয়তই মুখোমুখি হচ্ছেন। তবে এর উত্তরে আমরা বলবো “হ্যাঁ, অবশ্যই। “ বিভিন্ন সময়ে আমরা কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী মহাজাগতিক সংকেত পেয়েছি যা আমাদের বিজ্ঞানী মহলকেও চমকে দিয়েছে। ভিনগ্রহীদের এই খুঁজে বের করার জন্যই মূলত ১৯৮৪ সালে আমেরিকাতে “SETI” নামক সংস্থার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংস্থার কাজই হল মূলত ভিনগ্রহীদের খোঁজার জন্য Radio এবং Laser Signal ব্যবহার করা হয়। এবার দেখা যাক ভিনগ্রহীদের পাঠানো কিছু সাড়া জাগানো সংকেতসমূহঃ

1. “WOW SIGNAL :

এখন পর্যন্ত মহাজাগতিক সিগন্যালটির মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রমান বলা হয় এই “WOW SIGNAL” কে । এটি ১৯৭৭ সালের ১৫ ই আগস্ট “Ohio State University” এর “Radio Telescope Big Ear” এ সিগন্যালটি রেকর্ড করা হয়।

বিখ্যাত WOW SIGNAL

এই রহস্যময় সিগন্যালটি একটি “তারা মণ্ডল” থেকে আসে যা ১২০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এবং এটি ৭২ সেকেন্ড পর্যন্ত রেকর্ড হতে থাকে। “SETI” এর বিজ্ঞানী “DR. Jerry R. Ehman”  এর নজরে আসে। তিনি সিগন্যালটি দেখে এতই অবাক হন যে সিগন্যালটির রিপোর্টের প্রিন্ট আউটে “WOW” লিখেন এবং এরপর থেকে এই সিগন্যালকে “WOW SIGNAL” বলা হয় । এই সিগন্যালের পরে বিজ্ঞানীরা সিগন্যাল পাঠান যার উত্তর আজও পাওয়া যায়নি ।

2. “RADIO SOURCE SHGBO2+14A “ :

২০০৩ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে “SETI” এর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি বিশাল “ARECIBO TELESCOPE “ নির্মাণ কর যেন মহাকাশের ২০০ টি জায়গা থেকে রেডিও সিগন্যালকে রেকর্ড করা যায় । এই টেলিস্কোপটি ৩বার রেডিও সিগন্যাল গ্রহণ করে এবং প্রতিবারই ১ মিনিট ধরে গ্রহণ করে । এই সিগন্যালটির কম্পাংক ছিল “১৪২০ মেগা হার্টজ ।“ এটি “Pisces and Aries Constellation” অর্থাৎ “মেস তারা মন্ডল” থেকে এসেছিলো ।

3. “FREQUENCY 4462.3” :

এই সিগন্যালটিকে বিজ্ঞানীরা ১০০ আলোকবর্ষ দূরে থেকে আসে । এই ১০০ আলোকবর্ষ দূরে আমাদের এই পৃথিবীর মতো “TYC 1120911” নামক একটি গ্রহ রয়েছে এবং  এই সিগন্যালটির উৎপত্তি স্থল ছিল ঐ গ্রহটি । এই সিগন্যালটিকে ২য় “WOW SIGNAL” ও বলা হয়ে থাকে। ২০১০ সালে “SETI” এর টেলিস্কোপটিতে এই সিগন্যালটি গ্রহণ করেন ।

4. “FRB 150215” :

এই সিগন্যালটি এমন একটি সিগন্যাল যা ২০১৫ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি ধরা পড়ে । এই সিগন্যালটির নাম হল “FAST RADIO BURST.” এটি মাত্র কয়েক মিলি সেকেন্ড স্থায়ী ছিল। এটি এমন একটি সিগন্যাল যার উৎপত্তিস্থল এবং সিগন্যালটির অর্থ পর্যন্ত কেউ বের করতে পারেনি। অনেক বিজ্ঞানীগণ কঠোরভাবে ভিনগ্রহীদের সিগন্যাল হিসেবে দাবী করেন । তবে “Harvard University” এর বিজ্ঞানীদের মতে এই সিগন্যাল কোন স্পেসশীপ থেকে এসেছিলো । এই সিগন্যালটি মোট ১১ টি টেলিস্কোপে ধরা পড়ে। একটি কথা না বললেই নয় আর তাহলো হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন জাগবে যে এর উৎপত্তিস্থল কেন শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি ? এর উত্তর হচ্ছে এই সিগন্যালটি

আমাদের Milkyway Galaxy এর বাইরে থেকে এসেছিলো । বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বের করে দেখেন যে , “ এটি ১ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের কোন গ্রহ থেকে এসেছিলো ।“

5. “HD 16495” :

সুদূর মহাকাশ থেকে এই সিগন্যালটি গ্রহণের পর থেকে বিজ্ঞানী মহলে হৈচৈ লেগে যায়। ২০১৫ সালের ১৫ই মার্চ রাশিয়ার একটি টেলিস্কোপ থেকে এই সিগন্যালটিকে রেকর্ড করা হয়। হিসেব করে দেখা গেছে যে, ৫০ আলোকবর্ষ দূরে “HD 16495” নামক একটি গ্রহ রয়েছে যেখান থেকে এই সিগন্যালটি এসেছিলো । বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে এমন কোন যন্ত্র নেই যা এতো শক্তিশালী সিগন্যাল পাঠাতে পারে এবং এরপর থেকেই বিজ্ঞানীরা জড়সড় হয়ে এই গ্রহ নিয়ে তীব্র গবেষণা শুরু করেন ।

এরকম অজস্র গবেষণা যেমন অতীতে হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তার মাত্রা আরও বাড়বে । তবে ভিনগ্রহীদের খুঁজার সম্পর্কে আমাদের বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী Stephen Hawking বলেন , “ আমাদের বাইরের কোন প্রাণীজগতকে কোন সিগন্যাল পাঠানো উচিত নয়। “ এর কারণ হল আমরা যেমন বাস উপযোগী অন্য কোন গ্রহের সন্ধান করছি হয়তো তেমনি ভিনগ্রহী প্রানীরাও বাস উপযোগী কোন গ্রহ খুজছে। আর তারা যদি পৃথিবীকে তাদের বাস উপযোগী মনে করে তাহলে তারা তা দখল করে ফেলবে। তবে এই ভয়ে বিজ্ঞানীগণ যে কোনোদিনই ভিনগ্রহীদের সন্ধানে সিগন্যাল পাঠানো বন্ধ করবেন না তা আমরা ভালো করেই জানি। আমাদের এই সিগন্যাল কি তারা আদৌ পাচ্ছে ? কে জানে তারা কোথায় অবস্থান করছে । হয়তো আমাদের খুব কাছে হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাদেরকে খুঁজে বের করতে পারছি না আবার হয়তো তারা আমাদেরকে এতোটা এতোটাই দূরে যে আমাদের সিগন্যাল তাদের কাছে কখনোই পৌঁছায়নি। এর উত্তর হয়তো আমাদেরকে সময়ই বলে দেবে । আর সেই অপেক্ষাতেই আমরা আজও দিন গুণে যাচ্ছি ।

তথ্যকণিকাঃ

http://www.voyegar.jpl.nasa.gov/

হাসিবুল হোসেন রিফাত

প্রথম প্রকাশিত

৬ই মার্চ২০১৮ তে

You may also like...