মানব বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – কিভাবে আমরা সেপিয়েন্স হলাম (দ্বিতীয় পর্ব)

সংস্কৃতি, বিবর্তনীয় বেগবর্ধক

 

“সংস্কৃতি মানব বংশধারার আবির্ভাবে কারণ হয়েছিল কিছু অস্ট্রালোপিথেকাস হাতিয়ার নির্মাতাদের বিবর্তন তরান্বিত করার মাধ্যমে। তাদের বর্ধিত শারীরিক কাঠামো এবং বর্ধিত মস্তিস্কের আয়তন হোমিনাইজেশন প্রক্রিয়াটির সূচনা করেছিল, যা আরো বৃহত্তর এবং আরো সহযোগিতাপূর্ণ মানব সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর উদ্ভবের কারণ হয়েছিল, যেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করেছিল “ভাষাতাত্ত্বিক গ্রুমিং বা পরিচর্যা” ((  রবিন ডানবার তার “গ্রুমিং,গসিপ এবং ইভোল্যুশন অব ল্যাঙ্গুয়েজ” বইয়ে ভাষার বিবর্তনকে বুঝতে একটি নতুন উপায় প্রস্তাব করেছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একটি সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি করার পদ্ধতি হিসাবে ভাষা বিবর্তিত হয়েছিল: গসিপ বা গাল-গল্প করার মাধ্যমে। এটি মানুষদের সহায়তা করেছিলেন অন্য প্রাইমেটদের তুলনায় আরো বড় গোষ্ঠীতে থাকার জন্য। শিকারী প্রাণির আক্রমণ থেকে বাঁচতে আমাদের পূর্বসূরিরা যে বড় গোষ্ঠীগুলো তৈরি করতে বাধ্য হয়েছিল”।

অস্ট্রালোপিথেকাসদের কিছু বংশধারাকে মানুষে রূপান্তরিত করেছিল কী? আমরা বিশ্বাস করি এই প্রশ্নের উত্তর বেশ সুস্পষ্ট: সংস্কৃতি। সংস্কৃতি বলতে এখানে নির্দেশ করা হচ্ছে যে-কোনো একগুচ্ছে আচরণিক বৈশিষ্ট্য, প্রতীক এবং ধারণা, যা কোনো একটি প্রাণি গোষ্ঠী স্থানিক ( একই গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে) এবং  কালিক (প্রজন্মান্তরে) স্তরে ভাগাভাগি করে নেয়। এই সংজ্ঞানুযায়ী, ডলফিন অথবা শিম্পাঞ্জিদের গোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, যদিও মানুষের ওপর যে মাত্রায় এটির বিবর্তনীয় প্রভাব আছে, সেভাবে এই প্রাণিদের উপর এটি প্রভাব ফেলতে পারেনি। অস্ট্রালোপিথেকাসদের বিশেষ কিছু বংশধারায় সংস্কৃতি কি ভিন্নভাবে বিকশিত পারে, যখন দ্বিপদী আচরণ তাদের হাতগুলোকে অন্য কাজ করার জন্য মুক্ত করে দিয়েছিল? হ্যাঁ, ২০১৫ সালে আমরা যেমন দেখেছিলাম, যখন আবিষ্কৃত হয়েছিল হোমোদের উদ্ভবের আগেই পাথরের টুল বা হাতিয়ার তৈরি করা শুরু হয়েছিল। কেনিয়ার টুরকানা হৃদের পশ্চিম তীরের নিকটে একটি জায়গা, লোমেকউই ৩ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় প্রাগৈতিহাসবিদ সোনিয়া হারমন্ডের ( সিএনআরএস এবং স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়) নেতৃত্ব একটি দল আমাদের জানা আছে এমন সবচেয়ে প্রাচীন পাথর-নির্মিত হাতিয়ার বা টুল আবিষ্কার করেছিলেন, যেগুলো  প্রায় ৩.৩ মিলিয়ন বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল। আর সেকারণে এটি হোমিনিন জীবনাচরণে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের স্মারক। হোমো জিনাস বা গণের সবচেয়ে প্রাচীন যে জীবাশ্মটি আবিষ্কৃত হয়েছে সেটি হচ্ছে একটি আংশিক চোয়ালের হাড়, ‘জ এলডি ৩৫০ -১’, যার সাথে এখনও ছয়টি দাঁত যুক্ত হয়ে আছে। এটি পাওয়া গিয়েছিল ইথিওপিয়ায় লেডাই গেরারুতে, এবং এর সময়কাল ২.৮ মিলিয়ন বছর আগের কোনো একটি সময়। লোমেকোয়াই ৩ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় আবিষ্কৃত হাতিয়ারগুলো ইঙ্গিত করছে একটি প্রস্তর সংস্কৃতি, যা এখন পরিচিত ‘লোমেকুইয়ান’ সংস্কৃতি নামে, এভাবে হোমো জিনাসের সবচেয়ে প্রাচীনতম জীবাশ্মের চেয়েও আধা মিলিয়ন বছর প্রাচীন। এই সংশয়পূর্ণ বিষয়টি সবচেয়ে সরলতম ব্যাখ্যা হচ্ছে – এই অস্ত্রগুলো তৈরি করেছিলসেই সময়ে অস্তিত্ব ছিল এমন হোমিনিডরাই, অস্ট্রালোপিথেকাসদের কেউ।

সংস্কৃতিবান কিন্তু চ্যাপটা-মুখো

সোনিয়া হারমন্ডের দল নিকটবর্তী এলাকায়  আরেকটি আবিষ্কারের দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল, কেনিয়ানথ্রোপাস প্ল্যাটিওপস (কেনিয়ার চ্যাপটা-মুখো মানব), একটি জীবাশ্মের নমুনা, যা নরবানরদের মত বৈশিষ্ট্যসূচকে দীর্ঘ মুখ প্রদর্শন করেনি বরং এর ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক সংক্ষিপ্ততর একটি মুখ, যেখানে কিছু জীবাশ্মবিদ অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিস ও আদি হোমো – উভয় প্রজাতির বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কেনিয়ানথ্রোপাস প্লাটিওপস সম্ভবত অস্ট্রালোপিথেকাসের মত একই বিবর্তনীয় স্তরে অবস্থিত ছিল, বিশেষ করে অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেননসিস, যারা একই এলাকা একই সময়ে বসবাস করেছিল। যেহেতু ৩.৩ মিলিয়ন বছর আগে কেনিয়ায় কোনো ভিনগ্রহবাসী থাকার কথা নয়, সেকারণে সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত উপসংহার হচ্ছে – অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেননসিস অথবা কেনিয়ানথ্রোপাস প্লাটিওপস প্রজাতির সদস্যরাই লোমেকউই ৩ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় আবিষ্কৃত পাথরের হাতিয়ারগুলো নির্মাণ করেছিল। কিন্তু যারাই এগুলো নির্মাণ করুক না কেন আমরা সুনির্দিষ্টভাবেই বলতে পারি যে প্রথম হাতিয়ার-নির্মাতাদের সময়কাল অস্ট্রালোপিথেকাসদের বিবর্তনীয় পর্বে ছিল। হাতিয়ার নির্মাণ একটি সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ, যা এসেছিল এমন একটি সংস্কৃতি থেকে, যা হোমোদের পূর্ববর্তী।

কিন্তু আমরা কি এমন কিছু আসলেই বিশ্বাস করতে পারি? হ্যাঁ, আর এর কারণ হচ্ছে এমন: প্রাইমেটবিশেষজ্ঞ এবং নৃতত্ত্ববিদ জেন গুডঅল ১৯৬০ এর দশক থেকে তানজানিয়ার গম্বে স্ট্রিম ন্যাশনাল পার্ক শিম্পাঞ্জীদের নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, তার সেই গবেষণা থেকে আমরা জানি মানব নয় এমন হোমিনিডরা হাতিয়ার ব্যবহার করে। কিন্তু তারা পরিস্থিতি লব্ধ হাতিয়ার ব্যবহার করে, যেমন কোনো ভারী লাঠি বা পাথর, কোনো গর্ত খুঁড়তে অথবা কোনো বাদামের খোলস ভাঙ্গতে। লোমেকউই ৩ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় আবিষ্কৃত পাথরের হাতিয়ার এর ব্যতিক্রম, উদ্দেশ্যমূলকভাবেই আঘাত করে তৈরি করা পাথরের হাতিয়ার, যেগুলোর ধারালো প্রান্ত আছে। এগুলো তৈরি করা হয়েছিল দুটি কৌশল ব্যবহার করে – একটি স্থির নেহাইয়ের উপর হাতিয়ার বানানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত পাথরটিকে সরাসরি আঘাত করে (বড় পাথরের উপর পাথরটিকে আঘাত করে প্রয়োজনীয় রূপ দেয়া) অথবা কোনো স্থির নেহাইয়ের উপর বাইপোলার বা দ্বিমেরু বা উভয় দিক থেকে আঘাত দিয়ে ( পাথরকে রূপ দেয়া আরেকটি পাথর ব্যবহার করে একটি অন্য একটি পাথরের উপরে রেখে)।  এই জটিলতাগুলো ইঙ্গিত করছে যে এসব কৌশলগুলো উপর এই গোষ্ঠীটি দক্ষতা অর্জন করেছিল, আর এভাবেই একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কাঠামোর মধ্যে এটি সম্প্রচারিত হয়েছিল (ছবি ৬)।

উপরন্তু এই দুটি পদ্ধতি পাথরের হাতিয়ার খোদাই প্রদর্শন করছে যে, প্রজাতির বিবর্তনের মত, প্রযুক্তিগত বিবর্তনও ঝোপের মত বহু শাখাপ্রশাখাযুক্ত: এই কৌশলগুলো নিরন্তরভাবে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছিল, শাখা তৈরি করেছিল, যেগুলো আবার দ্রুত মারা গিয়েছিল, কিন্তু মূল কাণ্ডটির বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ ( সিএনআরএস) এর প্রাগৈতিহাসবিদ হেলেন রোশ, যিনি এই গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন, তিনি ব্যাখ্য করেছিলেন: “প্লাইও-প্লাইস্টোসিন আচরণিক বিবর্তন বেশ জটিল একটি বিষয়, জৈববৈজ্ঞানিক বিবর্তনের মতই জটিল”। প্লাইও-প্লাইস্টোসিন, আমাদের লক্ষ করা উচিত, হচ্ছে লোমেকউই ৩ এর যুগ।

ছবি ৬: পাথরের হাতিয়ার নির্মাণ -পাথর “ন্যাপিং” পক্রিয়াগুলো প্রথম হোমো সেপিয়ন্সদের আবির্ভূত হবার বহু আগেই অনেক অগ্রসর ছিল। এই কৌশলগুলোর অন্তর্ভুক্ত সরাসরি আঘাত ব্যবহার করে মুক্ত হস্তে ন্যাপিং প্রথমে একটি পাথরকে ধারালো করে তোলা (১) এরপর একটি বাইফেস তৈরি করা (বাইফেস অর্থ যখন দুইপাশ থেকেই পাথর অপসারণ করে হাতিয়ার তৈরি করা হয়।), একটি নরম স্ট্রাইকার বা আঘাতকারী দিয় পরোক্ষ আঘাত (৩) ((‘লিথিক রিডাকশন’ পদ্ধতিতে হাতিয়ার তৈরি করার জন্য ‘ন্যাপিং’ হচ্ছে ফ্লিন্ট, চের্ট, অবসিডিয়ান অথবা ‘কনকয়ডাল ফ্র্যাকচারিং’ পাথরের [যে পাথরগুলো ভেঙ্গে যায় পৃথক হবার কোনো নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক সমতল অনুসরণ করে না] ইত্যাদির আকৃতি দেয়া । আর ‘লিথিক রিডাকশন’ প্রত্নতত্ত্বে বিশেষ করে প্রস্তর যুগে উদ্ভাবিত একটি পদ্ধতি, যা ব্যবহার করে পাথরের রূপ দেয়া হতো এটির প্রাকৃতিক রূপ থেকে কিছু অংশ ক্রমান্বয়ে আঘাতের মাধ্যমে অপসারণ করে, যেন এগুলোকে হাতিয়ারে পরিণত করা যায়))।

বেশ, এখন একটি বিস্ময়কর চিত্র আমরা পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছি: খুব সম্ভবত পাইলোসিন যুগের  (৫.৩-২.৫৮ মিলিয়ন বছর আগে) শেষ থেকে প্লাইস্টোসিন যুগের শুরু অবধি (২.৫৮ মিলিয়ন থেকে ১১,৭০০ বছর আগে), বেশ কয়েক প্রজাতির অস্ট্রালোপিথেকাস সদস্যরা পাথরের হাতিয়ার বানাতে পারতো এবং সেগুলো ব্যবহার করেছিল, যদিও শিকার করার জন্য নয়, কিন্তু অন্ততপক্ষে কিছু কাটতে, মাটি থেকে কন্দমূল খনন করে তুলতে, এবং মৃত প্রাণির শরীর থেকে মাংস ছাড়াতে।

প্রাচীন পশুদের হাড়, ৩.৪ মিলিয়ন বছর আগে থেকে, পাথরের হাতিয়ার দিয়ে কাটার দাগ বহন করছে, সেগুলো খুব শক্তিশালীভাবে ইঙ্গিত দেয় পরিস্থিতি এমনই ছিল। এগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে ইথিওপিয়ায় একটি এলাকা, ডিকিকায়, একটি জায়গা যেখানে ৩.৩ মিলিয়ন বছর আগের একটি অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেননসিস প্রজাতির নারী সদস্য আবিষ্কৃত হয়েছিল। অস্ট্রালোপিথেকাসরা যে পাথরের হাতিয়ার বানাতে পারতো, তার আরো প্রমাণ মিলেছে ইথিওপিয়ার আওয়াশ নদীর কাছে বৌরি ফরমেশনে, এখানে পাওয়া গিয়েছিল ২.৫ মিলিয়ন বছর প্রাচীন অস্ট্রালোপিথেকাস গাহরি জীবাশ্ম, যার সাথে কিছু হাতে তৈরি পাথরের হাতিয়ারও আবিষ্কৃত হয়েছিল। ( যদিও জীবাশ্ম অস্থি এবং পাথরের হাতিয়ারের মধ্যে ভূতাত্ত্বিক সম্পর্ক এখনও বিতর্কিত)। কিন্তু এটি স্পষ্ট যে এই পাথর নির্মাতা অস্ট্রালোপিথকাস প্রজাতিগুলোর কোনো একটি অবশ্যই মানব প্রস্তর প্রযুক্তির উৎস, যা এই পৃথিবীতে সেপিয়েন্সদের প্রযুক্তিগত প্রাধান্যের সূচনা করেছিল।

হোমিনাইজেশন অব হোমো

এইসব প্রত্নতাত্ত্বিক যুক্তি ও পর্যবেক্ষণগুলো দ্বারা সশস্ত্র হয়ে, আমরা এখন সেই প্রক্রিয়াটির একটি সাধারণ বর্ণনা প্রস্তাব করতে পারি, যা মানুষের উদ্ভবের কারণ হয়েছিল: হোমিনাইজেশন। হোমো গণ আবির্ভূত হয়েছিল হাতিয়ার-নির্মাতা অস্ট্রালোপিথেকাসদের বংশধারাগুলোর মধ্য থেকেই, বাইপেডালিজম এবং সাংস্কৃতিক হস্তান্তরণের মিলনের পরিণতি হিসেবে। যেহেতু এখন তারা সোজা হয়ে দুই পায়ে ভর করে হাটতে পারতো, এইসব সদস্যরা আরো বিশাল মাত্রায় তাদের পরিবেশের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিল, যা তাদের গোষ্ঠীগুলোর অভ্যন্তরে সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতার মাত্রাও বৃদ্ধি করতে সহায়তা করেছিল। এটি অনুকরণ করার ক্ষমতা ( কগনিশন বা অবধারণ, বৌদ্ধিক ক্ষমতা) বৃদ্ধি এবং  হাত ব্যবহার করে কোনো কাজ করার দক্ষতা ক্রমবিকাশ (অবধারণ এবং হাতের বিবর্তনের মাধ্যমে, উল্লেখযোগ্যভাবে পাথরের হাতিয়ার তৈরি করতে), এবং সোজা হয়ে দৌড়ানোর ক্ষমতা ( শরীরের বিবর্তনের মাধ্যমে) অর্জনে সহায়তা করেছিল। এইসব উন্নতিগুলো, পক্ষান্তরে, গোষ্ঠী অভ্যন্তরে সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিমান বৃদ্ধি করেছিল, যা আরো বেশি মাত্রায় স্থানীয় এলাকা ব্যবহার করার কারণ হয়েছিল। সংক্ষেপে, স্বদৃঢ়ীকরণের একটি শক্তিশালী চক্রের সূচনা হয়েছিল, যা মূলত নির্বাচিত সামাজিক চাপেরই পরিণতি। এভাবে বাইপেডালিজমের দিকে দীর্ঘ বিবর্তন প্রাক-মানব রূপগুলো সৃষ্টি করেছিল এবং পরিশেষে মানুষের আবির্ভাব হয়েছিল। (প্রাক) মানব জীববিজ্ঞান এবং প্রাক-মানব সংস্কৃতি এমনকি হোমো আবির্ভাব হবার আগেই সহবিবর্তিত হয়েছিল।

আরো বড় শরীর এবং আরো বড় মস্তিষ্ক

এটি বেশ ভালো একটি তত্ত্ব, কিন্তু জীবাশ্ম রেকর্ডে কি এই স্বদৃঢ়ীকরণ চক্রের কোনো প্রমাণ আছে? নিশ্চয়ই, যদি আমরা সেই ধারণাটিকে গ্রহন করে নেই যে, অপেক্ষাকৃত বড় শারীরিক সংগঠন হাতিয়ারের সহায়তায় মাটির প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহে সুবিধাজনক প্রমাণিত হতে পারে। শরীরের আকার যত বড় হবে, এবং সেকারণে, দীর্ঘতর হাত একটি মানুষকে অন্য যে কোনো প্রজাতির তুলনায় আরো বেশি শক্তিসহ কিছু নিক্ষেপ করতে, (মানুষের কাধ মানুষকে অন্য যে কোনো প্রজাতির চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে কোনো কিছু নিক্ষেপ করার ক্ষমতা দিয়েছে), আরো সজোরে পাথর দিয়ে আঘাত করতে, লাঠি দিয়ে মাটির আরো গভীর গর্ত খুঁড়তে, আর আরো বড় বর্শা ব্যবহার করতে এবং এছাড়া আরো অনেক কিছু করতেই সহায়তা করে।  

আমরা যদি চিন্তার এই ধারাটি অনুসরণ করি, হোমিনাইজেশন ঘটেছিল কিছু সুনির্দিষ্ট প্রাকমানব বংশধারাগুলোর নির্বাচনের মাধ্যমে, এরপর আরো বড় থেকে বড় মানুষরা, যতক্ষণ না একটি জৈববৈজ্ঞানিক অনকূল পরিস্থিতি অর্জন করা সম্ভব হয়। এছাড়াও, এসব হোমিনিডদের অপেক্ষাকৃত বড় আকার, বিচিত্র ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করার সুযোগ নিতে তাদেরকে সক্ষম করে তুলেছিল ( মাংস, কন্দমূল, মধু, বাদাম এবং ফল যেমন)। পাথরের হাতিয়ার, সমষ্টীগতভাবে উত্তম সংগঠন ও সমন্বয় আরো বৃহত্তর একটি এলাকা থেকে এই সব সম্পদ সংগ্রহ করতে তাদের সহায়তা করেছিল। এটি ইঙ্গিত করে তাদের কগিনিটিভ বা অবধারণ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল ((কগনিশন শব্দটি জ্ঞান অর্জন এবং চিন্তা, অভিজ্ঞতা আর ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করার মানসিক ক্রিয়া অথবা প্রক্রিয়ার প্রতি তথ্য নিদের্শ করে))।

আমরা জানি যে সময়ের সাথে মানুষের আকৃতি সুনির্দিষ্টভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছে, ৪.৩ ফুট ( পুরুষ হোমো হ্যাবিলিস) থেকে প্রায় ৫.৬ ফুটের ( পুরুষ হোমো সেপিয়েন্স) কাছাকাছি। এর সাথেই বৃদ্ধি পেয়েছিল মস্তিষ্কের আয়তন, ৪০০ ঘন সেন্টিমিটার ( পুরুষ হোমো হ্যাবিলিস) থেকে প্রায় ১৩৫০ ঘন সেন্টিমিটার (পুরুষ হোমো সেপিয়েন্স)। এভাবেই মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া অব্যহত ছিল যতক্ষণ না এটি জৈববৈজ্ঞানিক অনুকূল পরিস্থিতি স্পর্শ না করতে পেরেছে সেপিয়েন্সের মস্তিষ্কে এসে ( এখন বিলুপ্ত নিয়ানডারথাল প্রজাতির সদস্যদের মস্তিষ্কের আয়তন হোমো সদস্যদের মধ্যে মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ আয়তনের সমান ছিল, যা প্রায় ১৭০০ ঘন সেন্টিমিটারের কাছাকাছি)।

বিষয়টি সুস্পষ্ট করতে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যদিও হাতিদের আমাদের চেয়ে ব্ড় মস্তিষ্ক আছে কিন্তু তারা আমাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান নয়। কগনিটিভ বা অবধারণগত ক্ষমতার বৃদ্ধি মূল্যায়ন করতে, যা মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধির সাথে ঘটেছিল, আমাদের অবশ্যই “এনকেফালাইজেন কোএফিসিয়েন্ট” ধারণাটি ব্যবহার করতে হবে, সে সূচকটি মস্তিষ্কের ওজন এবং শরীরের ওজনের মধ্যে অনুপাতের একটি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে।

গরিলাদেএর মধ্য এই অনুপাত হচ্ছে ১/২৩০। শিম্পাঞ্জীদের মধ্যে এটি ১/৯০ এবং ১/১৮০ র মাঝামাঝি। কিন্তু বর্তমান মানুষের মধ্যে এটি মাত্র ১/৪৫। সুতরাং আমরা যদি বিবেচনা করি যে ‘টুমাই’-এর বিবর্তনীয় ধাপ একটি শিম্পাঞ্জির সমতূল্য, তাহলে মানুষ ৭ মিলিয়ন বছরে তাদের মস্তিষ্কের আয়তন ৪ গুণ পরিমান বৃদ্ধি করেছে। মস্তিষ্কের বৃদ্ধি বিশেষভাবে ত্বরান্বিত হয়েছিল গত আধা মিলিয়ন বছর সময় পর্বে – হোমো হাইডেলবার্গেনসিসদের সাথে, যাকে অধিকাংশ প্রত্নতত্ত্ববিদরা নিয়ানডারথাল এবং সেপিয়েন্স উভয় প্রজাতির সাধারণ পূর্বসূরি হিসাবে বিবেচনা করেন ( ছবি ৭)।

আমরা লক্ষ করতে পারি যে, পর্যায়ক্রমে আসা (প্রাক) মানব প্রজাতিগুলোর স্বদৃঢ়ীকরণের চক্রের অস্তিত্বের সপক্ষে প্রমাণ সরবরাহ করছে : ক্রমবর্ধমান বাইপেডালিজম  >>>  অপেক্ষাকৃত বড় এলাকায় বিচরণ করার ক্ষমতা >>> বড় আকার, বৌদ্ধিক ক্ষমতা আর চলৎশক্তি যা সম্পদ ব্যবহারে সহায়ক >>> আরো বেশি বাইপেডালিজম, এবং এভাবেই চক্রটির পুনরাবৃত্তি অব্যাহত ছিল।

ছবি : হোমিনিদের ক্রেনিয়াল বা খুলির আয়তনের বিবর্তনমানব বিবর্তনের সাথে ক্রমান্বয়ে মস্তিষ্কের আয়তনের বৃদ্ধির ঘটেছিল। হোমো সেপিয়েন্স এবং নিয়ানডারথালদের সাধারণ পূর্বসূরিদের সময় থেকে,  প্রায় ৫০০,০০০ বছর আগে, মানব মস্তিষ্কের আয়তন শরীরের ভরের আনুপাতিক হওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এটি ক্রমশ আরো বড় হয়ে উঠেছিল।

এই চক্রটির যে অস্তিত্ব আছে সেটি সমর্থন করার মত আরেকটি নির্দেশক আছে, যা উন্মোচন করেছে যে সামাজিক সংগঠনের স্বার্থে এবং ব্যক্তিক স্তরে সামাজিক অভিযোজনের মাধ্যমে প্রাইমেটদের অবধারণগত ক্ষমতার একটি বড় অংশ বিকশিত হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত থাকাকালীন লেসলি আইয়েলো এবং রবিন ডানবার প্রাইমেট সামাজিক দল এবং তাদের নিওকর্টেক্সের পুরুত্বের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছিলেন- ((নিওকর্টেক্স হচ্ছে আমাদের মস্তিস্কের সবচেয়ে বাইরের স্তরটি যেটিকে কগনিশন বা অবধারণ ক্ষমতার স্থান হিসাবে মনে করা হয়))। দল হিসাবে কাজ করার জন্য প্রাইমেটদের পারস্পরিক শারীরিক পরিচর্যায় (গ্রুমিং) সময় বিনিয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা আছে ( উকুন বাছাই করা যেমন), যা আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে। শিম্পাঞ্জিরা তাদের মোট সময়ের ১৬ শতাংশের বেশি পরিমান সময় তাদের এই সামাজিক পরিচর্যায় (সোস্যাল গ্রুমিং) বিনিয়োগ করে। সমসাময়িক প্রাইমেটদের আচরণগত উপাত্তের উপর ভিত্তি করে আইয়েলো এবং ডানবার একটি গাণিতিক সূত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং এটি হোমিনিনদের উপর প্রয়োগ করেছিলেন। তারা যে উপসংহারে উপনীত হয়েছিলেন সেটি হচ্ছে, অস্ট্রালোপিথেকাসরা সামাজিক পরিচর্যায় তাদের সময়ের ২০ শতাংশ ব্যয় করতো। এই সময় এরপর আরো বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫ শতাংশ হয়েছিল হোমো নিয়ানডারথালেনসিস এবং হোমো সেপিয়েন্সদের ক্ষেত্রে। তবে , সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে আমরা এখন আমাদের সময়ের পঞ্চাশ শতাংশ পরস্পরের শরীর থেকে উকুন বাছাই করতে ব্যয় করি না ( সামাজিক গ্রুমিং), বিশেষ করে যখন আমাদের সামাজিক গোষ্ঠীটি সাধারণত গঠন করে শত সংখ্যক মানব সদস্য ( যে সম্পর্ক আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করি সেই অর্থে)  অথবা আরো বেশি সংখ্যক সদস্য( যদি আমার সেই সম্পর্কগুলোও বিবেচনা করি, যেগুলো আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করি না)।

গবেষকদের মতে, পারস্পরিক সামাজিক পরিচর্যাকে আমরা  একটি নতুন এবং আরো দক্ষতর প্রকারের পরিচর্যা ও বন্ধন দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছি: ভাষা, ‘প্রতীকীভাবে’ একই সাথে বহু মানুষকে পারস্পরিক পরিচর্যা করার একটি কৌশল ( সিমবোলিক গ্রুমিং)। মানব কথোপকথন বিশ্লেষণ প্রদর্শন করে যে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর সম্পর্কগুলো নিয়ে গাল-গল্প করে আমরা আমাদের সময়ে ৬০ শতাংশ ব্যয় করি । আইয়েলো এবং ডানবার প্রস্তাব করেছিলেন যে,  শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে যতটুকু জানা সম্ভব তার চেয়ে দ্রুততর উপায়ে কোন সদস্যকে তার গোষ্ঠীর অন্য সদস্যদের আচরণিক বৈশিষ্ট্যগুলো সম্বন্ধে জানার সুযোগ করে দিতেই ‘ভাষা’ বিবর্তিত হয়েছিল।

(চলবে….)

 

তথ্যসূত্র

  1. Harmand et al. “3.3-million-year-old stone tools from Lomekwi 3, West Turkana, Kenya.” Nature, 521 (2015): 310–15.
  2. Goodall. My Friends, the Wild Chimpanzees. Washington, DC: National Geographic Society, 1967.
  3. Villmoare et al. “Early Homo at 2.8 Ma from Ledi-Geraru, Afar, Ethiopia.” Science, 347, (2015), 1352–55.
  4. Roche. “Cognition et Culture matérielle.” Talk to the Fyssen Foundation, when she received the Prix Fyssen 2012.
  5. C. Thompson et al. “Taphonomy of fossils from the hominin-bearing deposits at Dikika, Ethiopia.” Journal of Human Evolution, 86 (2015): 112–35.
  6. C. Aiello and R. I. M. Dunbar. “Neocortex Size, Group Size, and the Evolution of Language.” Current Anthropology, 34, no. 2 (1993): 184–93.
  7. S. B. Leakey et al. “A New Species of The Genus Homo From Olduvai Gorge.” Nature, 202 (1964): 7–9.
  8. A. Wood. Koobi Fora Research Project Volume 4: Hominid Cranial Remains. New York: Oxford University Press, 1991.
  9. A. Wood and M. Collard. “The Human Genus.” Science, 284 (1999): 65–71.
  10. Klein, The Human Career: Human Biological and Cultural Origins, 3rd ed. Chicago: University of Chicago Press, 2009

 

You may also like...