মুক্ত কর হে বন্ধ- সপ্তম অধ্যায় (পুঁজিবাদের বিস্তার)

Illustration of African-American slaves working on a cotton plantation circa 1840. (Photo by Kean Collection/Getty Images)

ঊনবিংশ শতকের শেষ নাগাদ পৃথিবীর প্রায় সমস্ত স্থানেই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রভাব পড়ে-এক মাত্র দুর্গম স্থান (যেমন আমাজনের দুর্গম জঙ্গল, অ্যানটার্কটিকার বরফাচ্ছাদিত অঞ্চল) ছাড়া। তবে তার প্রভাব পৃথিবীর দুই অঞ্চলে ছিল দুই রকম। বেশির ভাগ অঞ্চলে মানুষ কায়িক পরিশ্রম করত পৃথিবীর অন্য প্রান্তে অবস্থিত পুঁজির মালিকদের জন্য পণ্য উৎপাদন করতে। আর পশ্চিম ইউরােপ ও উত্তর আমেরিকায় যন্ত্রশিল্পের প্রসার ঘটল শিল্পদ্রব্য উৎপাদনে, যােগাযােগ ব্যবস্থায় ও কৃষিতে।

এক শতাব্দী আগে বৃটেনে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিল বস্ত্র উৎপাদনের একটি অংশে – তুলা থেকে সুতা তৈরীতে (cotton spinning)। এরপর থেকে প্রায় সব ধরণের উৎপাদনে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চালু হল – সাবান তৈরী, কাগজ তৈরী, জাহাজ তৈরী, ছাপাখানা ইত্যাদি। বিদ্যুতের আবিষ্কার ও ইলেক্ট্রিক বাল্ব তৈরীর ফলে মানুষ কৃত্রিম আলাে সৃষ্টি করতে পারল। তাই দিন শেষ হওয়ার পরও এই কৃত্রিম আলাে দিয়ে উৎপাদন চালু রাখা সম্ভব হল। আগে শিল্প উৎপাদন শক্তির উৎসের (যেমন বাষ্প ইঞ্জিন) কাছাকাছি করতে হত। বৈদ্যুতিক মটর এর আবিষ্কার শিল্প উৎপাদনকে সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের আবিষ্কার বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত উৎপাদনের অংশ গুলির সমন্বয় করা সম্ভব করল। যুদ্ধকালীন বিভিন্ন এলাকার যুদ্ধক্ষেত্রের যােগাযােগও এগুলির মাধ্যমে সহজতর হল। রেলপথের বিস্তার দূর – দূরান্তের এলাকার সঙ্গে শহরসমূহের যােগাযােগ স্থাপন করল। কারখানা, রেল যােগাযােগ, বাস্পচালিত সমুদ্রযান এগুলাের জ্বালানী সরবরাহের জন্য কয়লাখনির সংখ্যা ও আকার বাড়তে থাকল। লােহার কারখানা স্থাপিত হতে থাকল এবং কারখানা গুলােকে ঘিরে শহর গড়ে উঠল।

একটি শিল্পের বৃদ্ধি অন্যসব শিল্পের চাহিদা সৃষ্টি করল এবং সেগুলােও বাড়তে থাকল। শহরের মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকায় খাদ্যের চাহিদাও বাড়ল। কৃষিকাজ শিল্প উৎপাদনের আদলে শুরু হল। আমেরিকার মধ্য-পশ্চিম অঞ্চলের তৃণভূমিতে বড় আকারে শস্য উৎপাদন শুরু করা হল। আর্জেন্টিনায় মাংসের জন্য বিরাট আকারে গােচারণ ভূমি তৈরী করা হল। অষ্ট্রেলিয়ায় উৎপাদিত হল পশম। এগুলাে হাজার হাজার মাইল দূরে অন্য মহাদেশের শহরে চালান দেওয়ার ব্যবস্থাও হল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অবস্থাপন্ন শ্রেণীর মানুষরা দরিদ্র মানুষদের জীবনযাত্রার নিম্নমান উন্নতির কোন উদ্যোগ নেয় নাই। কিন্তু এই কালে নিম্ন মানের জীবনযাত্রার ফলে যে রােগের উদ্ভব হয় এবং সেই সব রােগ যে দরিদ্র মানুষ অধ্যুষিত এলাকা থেকে মধ্যবিত্ত ও অভিজাত শ্রেণীর এলাকায় ছড়াতে পারে এই চেতনা আসল। এর ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে অবস্থাপন্ন শ্রেণীর মানুষরাই দরিদ্র মানুষদের বাসস্থানের ও পয়ঃব্যবস্থার উন্নতি, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের দিকে নজর দিল। গ্যাস সরবরাহ করে রাস্তায় আলাের ব্যবস্থা ও শীতকালে বাড়ি ঘরে উত্তাপের ব্যবস্থাও করা হল।

শহরাঞ্চলের মানুষের সংখ্যা এই সময় বাড়তে থাকে। ১৯০০ শতাব্দী নাগাদ বৃটেনের তিন – চতুর্থাংশ মানুষ শহরে বসবাস করত। মাত্র এক দশমাংশ মানুষ কৃষিতে নিয়ােজিত ছিল। অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলিতে অবশ্য এতটা নগরায়ন হয় নাই। ফ্রান্সে ৩০ শতাংশ মানুষ এই সময় কৃষিকাজে নিয়ােজিত ছিল এবং জাপানে এটা ছিল ৩৮ শতাংশ। তবে শিল্পোন্নত দেশসমূহে নগরায়নের ধারা বাড়তে থাকল। এর ফলে অধিক সংখ্যক মানুষের জীবনযাত্রার ধারা বদলাতে থাকল।

এই বদলের ফলে পুঁজিপতিদের সামনে নতুন সুযােগ আসল । বিনােদনের প্রয়ােজনে মদ্য প্রস্তুতকারীরা দেশের সর্বত্র Pub (মানুষের একত্রিত হয়ে মদ্যপান করার স্থান) স্থাপন করল। পত্রিকা প্রকাশ করে খবর ও বিনােদনমূলক লেখা ছেপে ব্যবসা শুরু করল। Harmsworth নামে একজন পুঁজিপতি Titbits নামে সাপ্তাহিক প্রকাশ করে সাফল্য লাভ করেন। খেলাধূলাকে সংগঠিত করে ব্যবসা করাও এ সময়ে শুরু হল। শিল্প শহর এমনকি এক একটি বড় কারখানা কেন্দ্র করে খেলার দল গড়া হল। এই দলগুলাের প্রতিযােগিতার মাধ্যমে অর্থ আয় করার সুযােগ হল। পুঁজিবাদী উৎপাদন শুরু হয়েছিল মানুষদের সময়ের একটা অংশ উৎপাদনে লাগিয়ে মুনাফার মধ্য দিয়ে। কারখানায় তারা দিনের একটা অংশ পুঁজিপতিদের জন্য সময় দিত। মানুষের জীবনের প্রায় সব দিক – কাজ কর্ম থেকে বিনােদন – সব ক্ষেত্রেই ব্যবসা বাণিজ্য করে লাভ করার সুযােগ সৃষ্টি করলাে পুঁজিপতিরা।

পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রথম যুগে শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল অবহেলিত। শিশু ও মহিলাদের দিয়েও কঠোর পরিশ্রম করান হত। কারণ তাদের মজুরী কম দেওয়া যেত এবং বিভিন্ন ধরনের কাজে লাগান যেত। পুঁজিবাদের প্রথম যুগে তুলা থেকে সুতা তৈরীর কারখানা গুলােতে ঠাসাঠাসি করে মহিলা ও শিশুদের কাজ করান হত। তাদের স্বাস্থ্যের উপর এর বিরূপ প্রভাব উপেক্ষা করা হত। মুনাফার জন্য শ্রমিকদের মানবেতর জীবন যাপনও ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। ১৮৫০ সাল নাগাদ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পুঁজিপতিরা কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। গ্রামের জনসংখ্যা কমে যাওয়ায় গ্রাম থেকে কাজ করতে আসা মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। আর শহরে বসবাসকারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত অবনতি তাদের ভাবিয়ে তুলল। ভবিষ্যতে যথেষ্ট সংখ্যায় শ্রমিক পাওয়া যাবে কিনা এবং যাদের পাওয়া যাবে ক্ষীণ স্বাস্থ্যের কারণে তাদের কর্মদক্ষতা কেমন থাকবে, তা সমস্যা বলে তারা মনে করল। ১৮৭১ সালে একটি রিপাের্টে বলা হয় দরিদ্র শ্রেণীর ছেলেদের কেউই চার ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চির বেশী উচ্চতা অর্জন করছে না। ১৮৯৩ সালে ম্যানসন হাউস কমিটি বলে “লন্ডনের কর্মজীবী শ্রেণীর শারীরিক ও মানসিক শক্তি বাড়ান দরকার”।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কতকগুলি আইন প্রণয়ন করে এই অবস্থার উন্নতি করার চেষ্টা করা হল। এর মধ্যে ছিল অপ্রাপ্ত বয়স্কদের কাজ করার সময় সীমিত করা, ক্ষতিকর শিল্পে মেয়েদের কাজ করতে না দেওয়া, স্কুলে বিনামূল্যে খাবার দেওয়া ইত্যাদি।

শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বাড়ানর জন্য এই সময় একটা বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়। শ্রমিকেরা যত বেশী উৎপাদন করতে পারবে, ততই পুঁজিপতিদের লাভ বাড়বে। দুই বা তিন shift এ কাজ চালু করে ২৪ ঘন্টা উৎপাদন করা প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সম্ভব হল। একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ কতটা কাজ করতে পারে তা হিসাব করে সেই অনুযায়ী উৎপাদন হিসেব করে মজুরী দেওয়ার জন্য পরিদর্শক ও সময় হিসাব এর ব্যবস্থা করা হল।

শিল্প উৎপাদনের প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাজ করার জন্য শ্রমিকদের শিক্ষার দরকার হয়ে উঠল। প্রাক পুঁজিবাদী কালগুলােতে শিক্ষা-দীক্ষা মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পুঁজিবাদী শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থার জটিলতার জন্য শিক্ষিত শ্রমিকের প্রয়ােজন দেখা দিল। শুধু মাত্র যন্ত্রপাতি চালানর নির্দেশনাবলী পড়া ও কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের প্যাকেজ এর লেবেল পড়ার জন্যও স্বাক্ষরতার দরকার ছিল। গণনা করার জন্যও ছিল শিক্ষার প্রয়ােজন। বৃটেনে পুঁজিবাদ শুরু হয়েছিল যদিও স্বাক্ষর শ্রমিক ছাড়াই, কিন্তু ক্রমেই এর প্রয়ােজন অনুভূত হল। ১৮৭০ সালের পর দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হল। যেসব দেশে পুঁজিবাদী উৎপাদন পরে চালু হল (যেমন জার্মানী), সেসব দেশে বৃটেনের সঙ্গে প্রতিযােগিতার প্রয়ােজনে শুরু থেকেই বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত হল।

পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশ শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে। পশ্চিম ইউরােপ ও উত্তর আমেরিকায় পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা পূর্ণ বিকশিত হয় উনবিংশ শতকের শেষ ভাগ ও বিংশ শতকের প্রথম ভাগে। এই সময়ে এসে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তিত হয়ে যায়। পুঁজিবাদের প্রথম দিকে গ্রামীণ জীবনযাত্রা থেকে শহরের শিল্পকারখানার শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে এসে মানুষ ধাক্কা খেত। জীবনযাপনের পদ্ধতির ও নতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তি (যেমন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, মােটরগাড়ি) দেখে তারা আশ্চর্য হত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এসে তারা পুঁজিবাদী জীবনযাত্রার উৎপাদন সমূহ, যেমন প্রতিযােগিতা ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, লােভ ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়ে গেল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কিছু তারা দেখে নাই। তাই তাদের কাছে এটাই ছিল “মানব স্বভাব”। তাদের পূর্ব পুরুষরা এই আচরণ দেখার সুযােগ পেলে এটাকে উদ্ভট বলে মনে করত।

19th-century-england-society-social-classes-and-culture

 

চিন্তার জগতে পরিবর্তন

উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাত্রা আগের চাইতে আরামদায়ক হয়ে উঠল । শ্রমিকদের অনেকের অবস্থারও উন্নতি হতে থাকল। তাদের মধ্যে এই ধারণা গড়ে উঠল যে এই উন্নতি হতেই থাকবে এবং মানুষের সমস্যাগুলাের সমাধানও হয়ে যাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতি এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করতে সাহায্য করল। লর্ড কেলভিন নিউটনের মেকানিকস এর ধারণা ব্যবহার করে বিশ্বব্রহ্মান্ডের একটা মেকানিকাল মডেল দাঁড় করালেন। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্রওয়েল মেকানিকস এর মাধ্যমে ইলেক্ট্রিসিটি ও ম্যাগনেটিজম এর যােগসূত্র বিশ্লেষণ করলেন। ডারউইন ও ওয়ালেস জীবজগতে বিবর্তনের ব্যাখ্যা।

দিলেন। ডারউইন এটাও দেখালেন কিভাবে মানবজাতি বানর সদৃশ্য স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। রসায়নবিদেরা অজৈব পদার্থ থেকে যে সমস্ত রাসায়নিক পদার্থ জীবন্ত প্রাণীতে পাওয়া যায় তা তৈরী করতে সমর্থ হলেন।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও যাজকেরা বিজ্ঞানের ধারণা গুলাের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। অক্সফোর্ডের এ্যাঙ্গলিয়ান বিশপ ডারউইনের শিষ্য হ্যাক্সলির নিন্দা ও সমালােচনা করেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্প উৎপাদনের মাধ্যমে মুনাফার সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় বিজ্ঞান, যুক্তি ও মুক্তচিন্তা অতীতের মত দমন করা যায় নাই।

Anti-capitalism color Restored

পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের অভ্যুদয়

মধ্য ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত গণতন্ত্র শাসক শ্রেণীর কাছে ছিল ঘৃণিত। ম্যাকঅলে নামে একজন ইংরেজ ঐতিহাসিক লিখেছিলেন “সার্বজনীন ভােটধিকার সরকারের সমস্ত কর্মকান্ডের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর” এবং সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য বিপদজনক। নিম্নবর্গের জনগণের চাপের মুখে যখন শাসকশ্রেণী ভােটের অধিকার আরও বেশী মানুষকে দিতে বাধ্য হল, তখনও তারা যতটা সম্ভব মানুষকে এর বাইরে রাখার জন্য আইন করল, কিছু সম্পত্তি না থাকলে ভােটাধিকার পাবে না। বৃটেনের ১৮৩২ সালের সংশােধিত আইনে ২ লক্ষ মানুষ থেকে বেড়ে ১০ লাখ মানুষ ভােটাধিকার পেল। এটা ছিল প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের মাত্র এক – পঞ্চমাংশ। ১৮৬৭ সালে আন্দোলনের চাপে আইন সংশােধন করা হয় – তারপরও পুরুষদের অর্ধেক ভােটাধিকার পায়। প্রুশিয়া ও আরও কয়েকটি জার্মান রাজ্যে তিন স্তরের ভােট দেওয়ার প্রথার প্রচলন হল। এর মাধ্যমে সংখ্যায় কম কিন্তু বিত্তবান শ্রেণী সবচাইতে বেশী সংসদীয় আসন অধিকার করত। এ ছাড়াও, শাসক শ্রেণীরা সংসদে একটি অনির্বাচিত দ্বিতীয় কক্ষের ব্যবস্থা রেখেছিল (যেমন হাউস অফ লর্ডস) – যারা সব সিদ্ধান্তের উপর ভেটো দিতে পারত। আরও ছিলেন রাজা, যিনি সরকার প্রধানকে নিয়ােগ দিতেন। ফলে শাসক শ্রেণীর প্রাধান্য সংসদ ও সরকারে থেকেই যেত। কার্ল মার্কস প্যারী কমিউনের সময় বলেছিলেন, লুই বােনাপার্টের একনায়কত্ব শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাই করছিল -এটা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ছিল না।

তবে সময়ের সাথে সাথে শাসক শ্রেণী উপলব্ধি করল গণতন্ত্র তাদের স্বার্থের জন্য হুমকি নাও হতে পারে। যদি তারা এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। লুই বােনাপার্ট নিজেই ১৮৫১ সালে তার ক্ষমতা দখল বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় সার্বজনীন ভােটাধিকার এর মধ্যেও কিভাবে ভােট নিয়ন্ত্রণ করে নিজের পক্ষে আনা যায় তা দেখিয়েছিলেন। অধিকাংশ ফরাসী ভােটার ছিল কৃষক। তারা রাজনীতির খবর এর জন্য নির্ভর করত স্কুল শিক্ষক ও ধর্ময়াজকদের উপর। বােনাপার্ট দেখল তথ্য যদি এই ভাবে পৌঁছানাে যায় যাতে বিপক্ষ দল ভােটে জিতলে তাদের কি ক্ষতি হবে, তাহলে স্কুল শিক্ষক ও যাজকেরা প্রতিপক্ষের (রিপাবলিকান) চাইতে তাকেই ভােট দেওয়ার জন্য কৃষকদের প্রভাবিত করবে। এই পন্থায় জার্মানীতে বিসমার্ক প্রশিয়ার রাজাকে জার্মানীর সম্রাট বানিয়ে দেয়।

বৃটিশ শাসক শ্রেণী আবিষ্কার করে ছিল যে ক্রমান্বয়ে ভােটাধিকার এর আওতায় বেশী সংখ্যক মানুষকে নিয়ে এসেও নীতি নির্ধারণে তাদের নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখা সম্ভব। এর কারণ হল, বেশীর ভাগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাই সরাসরি সংসদীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। অনির্বাচিত কর্তৃপক্ষ চালাতেন সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন। এই কর্তৃপক্ষ সমূহ সংসদের কর্মপরিধি নির্ধারণ করত এবং তাদের স্বার্থবিরােধী কোন আইন প্রণীত হলে তা প্রত্যাখান করতে পারত। এই ব্যবস্থায় সংসদ জনগণের পক্ষে শাসক শ্রেণীর উপর চাপ প্রয়ােগ করার বদলে জনগণের দাবী দাওয়া সীমিত রাখার কাজ করত। বৃটেন ছাড়া অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশেও একই অবস্থা ছিল। উনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে সংবাদপত্র যাতে সাধারণ মানুষের হাতে না পৌছায় সেজন্য এর উপর উচ্চ কর ধার্য করা হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এসে পুঁজিপতিরা অনূভব করল সংবাদপত্রের ব্যবসাও লাভজনক হতে পারে। মালিকরা তাদের সংবাদপত্রের মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রিত খবরের মাধ্যমে জনমত প্রভাবিত করে। বৃটেন বুয়র যুদ্ধের একটি ছােট ঘটনা Mafeking এর অবরােধকে বড় করে প্রচার করে উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল। ফ্রান্সে ক্যাপ্টেন ড্রেইফাস নামে একজনকে জার্মান চর হিসেবে মিথ্যা প্রচার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে উগ্র ইহুদী বিরােধিতা জাগিয়ে তােলে। জার্মানীতে যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে ১৯০৭ সালের নির্বাচনে সংবাদ মাধ্যম সমাজতন্ত্রীদের পরাজয়ে সাহায্য করে। শাসক শ্রেণী জাতীয়তার শ্লোগান দিয়ে শ্রমিক ও অন্যান্য শ্ৰেণীকে তাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষায় নিয়ােজিত করত। সরকার, পুঁজিপতি, সংবাদমাধ্যম জাতীয়তার শ্লোগান তুলে বােঝাতে সক্ষম হল যে, শ্রমিকদের স্বার্থ ও তাদের স্বার্থ একই। এসবের ফলে যে শাসকশ্রেণী ঊনবিংশ শতাব্দীর

মধ্যভাগে সার্বজনীন ভােটাধিকার তাদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করত, তারা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজে বের করল। তাই ভােটাধিকার দেওয়াতে তাদের আপত্তি থাকল না। তবে এই প্রক্রিয়াতে সময় লেগেছে। বৃটেনে ১৮৩২ সালে শাসকশ্রেণী শুধু মধ্যবিত্তদের ভােটাধিকার দিয়েছিল। আর সার্বজনীন ভােটাধিকার দিল ৯৫ বৎসর পর। জার্মানীতে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অনেক আন্দোলন সংঘর্ষের পর ১৯১৮ সালে শাসক শ্ৰেণী সার্বজনীন ভােটাধিকার দিতে বাধ্য হয়েছিল। মহিলাদের ভােটাধিকার দেওয়ার ব্যাপারেও শাসকশ্রেণীর প্রতিরােধ ছিল । শিল্প উৎপাদনমুখী অর্থনীতি গড়ে ওঠার সাথে সাথে অধিক সংখ্যায় মহিলারা শ্রমিক হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগল। শ্রমজীবী মহিলাদের সঙ্গে মধ্যবিত্ত এমনকি ধনী শ্রেণীর মহিলারাও ভােটাধিকার আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।

the Revolutionary Socialist Movement

সমাজতন্ত্রের আন্দোলন

সমাজতন্ত্রের চিন্তাধারা ও কর্ম তৎপরতা ১৮৪৮ ও ১৮৭১ সালে পরাজয়ের ফলে ঝিমিয়ে পড়েছিল। শিল্পায়নের দ্রুত প্রসার এবং তার সাথে শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা সমাজতন্ত্রের জন্য অনুকূল ক্ষেত্র এনে দিল। কিন্তু কোথাও শ্রমিকদের সংগঠন ধনী শ্রেণী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র যন্ত্রকে বিপ্লবের মাধ্যমে পরিবর্তনের চেষ্টা করার মত শক্তি অর্জন করতে পারেনি। জার্মান সমাজতন্ত্রীরা এই সময় বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়ার কৌশল নেয়। আরও বেশী সংখ্যক মানুষ এই সময়কালে ভােটাধিকার পায়। নির্বাচনী ব্যবস্থায় ধনী শ্রেণীর প্রাধান্য রক্ষা ছিল নিশ্চিত, কিন্তু সংগঠন করার অধিকার পাওয়ায় শ্রমিকেরা নিজেদের সংগঠন করে রাজনীতিতে অংশ নেওয়া শুরু করল। অন্যান্য দেশের শ্রমজীবী মানুষও এই ধারা অনুসরণ করতে লাগল।

জার্মানীর সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট দল রাজনীতিতে বেশ সফলতার মুখ দেখেছিল । এর সদস্য সংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্রায় দশ লক্ষে পৌছে। প্রায় ৯০টি স্থানীয় পত্রিকা চালাত এই দল। নির্বাচনে তারা শিল্পপতিদের সমর্থিত দল এবং জমিদার শ্রেণীর সমর্থিত দলের চাইতে বেশী ভােট পেত। সমাজতান্ত্রিক দল নিষিদ্ধ হওয়ায় ১২ বৎসর বে আইনী থাকার পরও এই দল টিকে ছিল। তাদের কাছে মনে হয়েছিল পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের মধ্য দিয়েই পুঁজিবাদকে ধ্বংস করা যাবে।

জার্মানীর এই উদাহরণ ফ্রান্স, স্পেন, ইতালী এমনকি বৃটেনেও অনুসরণ করা হয়। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এর সুপারিশে Jules Guesde ও Paul Lafargueএর নেতৃত্বে ফ্রান্সের ওয়ার্কাস পার্টি এই নীতি মেনে নেয়। স্পেনে Pablo lglesias এই পদ্ধতিতে শ্রমিকদের দল গড়ে তােলে। এমনকি বৃটেনে শ্রমিকেরা ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির জন্য শাসকশ্রেণীর প্রতি সহনশীল ছিল। তারপরও ১৮৮৩ সালে ছােট আকারে সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটিক ফেডারেশন তৈরী করে। ১৮৮৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলির ফেডারেশন (দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল নামে পরিচিত) যখন গঠিত হল, তখন জার্মান সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট দলই সেখানে প্রাধান্য পায়। এই দলগুলির ঘােষিত আদর্শ ছিল বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদ উৎখাত। কিন্তু বাস্তবে তারা পুঁজিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই চাপ প্রয়ােগ করে এই ব্যবস্থা সংস্কার করার কাজ করছিল। এই দ্বন্দ্ব ১৮৯০ এর দশকে প্রকট হয়ে ওঠে।

জার্মান সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট দলের একজন অগ্রণী নেতা ছিলেন এডুয়ার্ড বার্নষ্টেইন (Eduard Bernstein)। তিনি নব্বই এর দশকের মধ্যভাগে ঘােষণা করলেন মার্কস ও এঙ্গেলস এর তত্ত্ব সঠিক নয়। তাঁর মতে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অর্থনৈতিক সংকট আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত উপাদান নয় এবং শ্রেণীসমূহের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতও অবধারিত নয়। তিনি লিখেন, “সমস্ত উন্নত দেশেই পুঁজিপতি শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ ও সুযােগ-সুবিধা গণতান্ত্রিক সংগঠন গুলাের কাছে ধাপে ধাপে কমে আসছে। সর্বসাধারণের স্বার্থের উন্নতি হচ্ছে, ব্যক্তি স্বার্থ পিছু হটছে, মৌলিক অর্থনৈতিক শক্তির একাধিপত্য কমছে”। বার্নষ্টেইন যুক্তি দিলেন, আধুনিক রাষ্ট্রের উৎখাতের প্রয়ােজন নাই, যেটা মাকর্স প্যারী কমিউন সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রসার ঘটাতে হবে। ক্রমবর্ধমান সংস্কারের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর লক্ষ অর্জিত হবে। কার্ল কাউৎস্কি (Karl Kautsky) ছিলেন জার্মান সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট দলের মূল তাত্ত্বিক, তিনি কিছুটা ভিন্ন মত দিয়েছিলেন। তাঁর মত ছিল, পুঁজিবাদকে সংস্কার করে রূপান্তর ঘটান যাবে না। কোন এক পর্যায়ে পৌছে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রয়ােজন হবে। তবে সমাজতন্ত্রের সমর্থকদের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। এক পর্যায়ে তা ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে পুঁজিবাদী শক্তির পক্ষে সমাজতন্ত্রীদের ক্ষমতা দখল করে সমাজ বদল আটকে রাখা সম্ভব হবে না। তবে সেটা একটা দূরবর্তী লক্ষ্য। বর্তমানের জন্য এমন কোন তৎপরতা চালান ঠিক হবে না, যা পুঁজিবাদীদের প্রত্যাঘাত করার সুযােগ দেয়।

বাষ্টেইন ও কাউৎস্কি দুজনই বিশ্বাস করতেন পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। বার্নষ্টেইন মনে করতেন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গণতন্ত্র চর্চা পুঁজিবাদী সমাজকে রূপান্তরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কাউৎস্কি মনে করতেন এই প্রক্রিয়া দূর ভবিষ্যতে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছাবে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে পরিবর্তিত হবে এ ব্যাপারে তারা দুজনই নিঃসন্দেহ ছিলেন। জার্মানীর সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট দলের নেতৃত্ব বার্নস্টেইনের মতবাদকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করল। কিন্তু বাস্তবে তারা তার নির্দেশিত নরমপন্থী (moderate) পথ অবলম্বন করল, শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও এই পথে চললেন। তবে সমাজতান্ত্রিক দলগুলাের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি ছিল পুঁজিবাদী সমাজের স্থিতিশীলতার উপর নির্ভরশীল। ঊনবিংশ শতাব্দীর নব্বই এর দশকে জার্মান পুঁজিবাদ ছিল স্থিতিশীল। এই স্থিতিশীলতা স্থায়ী হবে এই ধারণা থেকেই বার্নষ্টেইন তার মতামত দিয়েছিলেন।

একমাত্র পােলিশ জার্মান তরুণ বিপ্লবী রােজা লুক্সেমবার্গ এই নরমপন্থী মতবাদের বিরােধিতা করেন। তিনি বলেন যে প্রক্রিয়ার ফলে পুঁজিবাদ ১৮৯০ এর দশকে স্থিতিশীল ছিল, সেই প্রক্রিয়ার ফলেই ভবিষ্যতে দেখা দিবে অস্থিতিশীলতা। তিনি আরও একটি বিষয়কে স্বীকৃতি দিলেন যা ইংরেজ অর্থনীতিবিদ হবসন কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন এবং যেটা ১৯১৬ সালে রাশিয়ান বিপ্লবী নিকোলাই বুখারিন ও ম্লাদিমির লেনিন পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরেন। সেটা হল দ্রুত পুঁজিবাদী প্রবৃদ্ধি বৃহৎ শক্তিগুলাের সাম্রাজ্যবাদী প্রসারের সঙ্গে ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সাম্রাজ্যের বিস্তার

১৮৭৬ সালে আফ্রিকার মাত্র ১০ শতাংশ ছিল ইউরােপীয় রাষ্ট্রগুলাের শাসনাধীন। কিন্তু ১৯০০ সালে আফ্রিকার ৯০ শতাংশ তারা দখলে নিয়েছিল। বড় অংশ গুলাে বৃটেন, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম দখল করেছিল, জার্মানী ও ইতালী পেয়েছিল ক্ষুদ্র অংশ। ফ্রান্স দখল করেছিল ইন্দোচীন (ভিয়েতনাম, কম্বােডিয়া ও লাওস)। জাপান দখল করল কোরিয়া ও তাইওয়ান; বৃটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানী চীনে বড় বড় এলাকায় আধিপত্য স্থাপন করল; আমেরিকা স্পেনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল ফিলিপাইন ও পাের্টোরিকো। বৃটেন ও রাশিয়া অনানুষ্ঠানিক ভাবে ইরান ভাগাভাগি করে নিল। ইউরােপ ও আমেরিকার বাইরে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন দেশ ছিল মাত্র কয়েকটিঃ অটোমান সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশ, থাইল্যান্ড, ইথিওপিয়া ও আফগানিস্তান।

তৎকালীন সভ্য সমাজে এমন ধারণা প্রচলিত ছিল যে ইউরােপের বাইরের সমাজগুলি ছিল আদিম ও অশিক্ষিত। কিন্তু লিভিংষ্টোন ও ষ্ট্যানলী ১৮৫০ ও ১৮৬০ এর দশকে আফ্রিকায় পরিভ্রমণ করতে পেরেছিলেন তা সম্ভব হয়েছিল আফ্রিকায় সংগঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রপুঞ্জের অস্তিত্ব ছিল বলেই। ইউরােপীয় দেশ সমূহের আগ্রাসী অভিযানগুলােকে প্রথম দিকে আফ্রিকার এই রাষ্ট্রগুলাে সহজেই প্রতিহত করেছিল। যদিও ১৮৮০ সাল নাগাদ পশ্চিম ইউরােপীয় শক্তিগুলাে প্রায় ৪০০ বৎসর ধরে নৌপথে আফ্রিকার সঙ্গে সংযােগ রেখে আসছিল, কিন্তু এই সময় তারা মাত্র অল্প কিছু উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। তুলনায় আরব, ভারতীয় ও তুর্কীরা এর চাইতেও অনেক আগে থেকেই আফ্রিকা মহাদেশের অভ্যন্তরে আরও অনেক বেশী জায়গায় বিচরণ করত। ব্রুস ভ্যান্ডারভাের্ট বলেছেন,“আধুনিক যুগের প্রথম দিকে আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলাের তুলনায় ইউরােপের প্রযুক্তিগত পার্থক্য বেশী ছিল না (শুধু সামুদ্রিক শক্তি ছাড়া)”। আর ইউরােপীয় আবিষ্কার স্থানীয় জনগণ দ্রুত আয়ত্ত করে নিত।

ইউরােপীয় শক্তিগুলির আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল জয় করার চেষ্টা আফ্রিকার দেশগুলি প্রতিরােধ করেছিল এবং অনেক যুদ্ধে ইউরােপীয়রা পরাজিত হয়েছিল। ১৮৭০ এর দশকে আশান্তিদের (Ashanti) সঙ্গে যুদ্ধে বৃটিশরা হেরে গিয়েছিল। তারা ১৮৮৪ সালে সুদানে মাহদীর সৈন্য বাহিনীর হাতেও পরাজিত হয়েছিল এবং ১৮৭৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জুলুদের হাতেও পরাজিত হয়েছিল। ইতালীয়রা ১৮৯৬ সালে ইথিওপিয়ান সৈন্যবাহিনীর হাতে শােচনীয়ভাবে হেরেছিল। ১৮৮০ সালের পর পরিস্থিতি বদলে গেল। শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ইউরােপীয় শক্তিগুলি নতুন ও আগের চাইতে অনেক শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র হাতে পেল। এর মধ্যে ছিল রাইফেলের পেছন দিকে গুলি ভরার ব্যবস্থা (breech loading rifles), Gatling মেশিন গান, লােহার পাতে মােড়া বাষ্পচালিত জাহাজ ইত্যাদি। এছাড়া অধিক পরিমাণে উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য আফ্রিকার মিত্রদের “ঘুষ” দেওয়া সহজতর করল। সুদানে যুদ্ধরত “বৃটিশ সৈন্যদের একটা বড় অংশ ছিল মিশরীয় ও সুদানী। যে বিভাজন ও শাসন (divide and rule) নীতি ভারতে শুরু করেছিল বৃটিশরা – তা তারা বড় আকারে সারা আফ্রিকায় প্রয়ােগ করা শুরু করল। ইউরােপীয়দের দাবী ছিল তারা অসভ্য জাতিগুলাের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে কিন্তু তাদের নিজেদের পদ্ধতি ছিল বর্বর। ১৮৯৮ সালে সুদানের ওমদুরমানে লর্ড কিচেনার এর নেতৃত্বে বৃটিশরা সুদান জয় করার সময় মেশিন গান দিয়ে দশ হাজার সুদানী সৈন্যকে হত্যা করেছিল। বৃটিশ পক্ষে মারা গিয়েছিল মাত্র ৪৮ জন। হাজার হাজার সুদানী সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে আহত অবস্থায় পড়েছিল, বৃটিশ সৈন্যরা তাদের কোন সাহায্য করেনি। লর্ড কিচেনার সুদানীদের নেতা মাহদীর মাথার খুলি দিয়ে কলমদানী বানিয়েছিলেন। একই ধরনের বর্বরতা দেখিয়েছিল লর্ড লুগার্ড নাইজেরিয়াতে। সেখানে সাতিরু নামে একটি এলাকায় বিদ্রোহ দমন করতে তিনি দুই হাজার বিদ্রোহীকে হত্যা করেছিলেন। তার পক্ষে একজন নিহত হয়নি। সব বন্দীদের হত্যা করে তাদের মাথা বর্শার আগায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। বেলজিয়ামের রাজা লিওপােল্ড আফ্রিকার একটা বিরাট এলাকা কঙ্গো-জয় করে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছিল। একটি এলাকায় তার সৈন্যরা গ্রামের পর গ্রাম লুট করে বাড়িঘর পূড়িয়ে দিয়েছিল। এলাকার সমস্ত মানুষকে হত্যা করে তাদের হাত কেটে নিয়ে গিয়েছিল প্রমাণ করার জন্য যে তারা গুলি নষ্ট করেনি। অন্যান্য দেশ জয় করে সাম্রাজ্য বিস্তার করার এই কর্মকান্ড ছিল সম্পূর্ণ লাভের জন্য। রাজা লিওপােল্ড লন্ডনে বেলজিয়ান রাষ্ট্রদূতের কাছে লিখেছিলেন, “আমরা আফ্রিকার মত একটা লােভনীয় কেকের একটা অংশ নেওয়ার কোন সুযােগ হাতছাড়া করতে চাইনা”। পৃথিবীকে এভাবে ভাগ করে দখল করে নেওয়ার প্রয়ােজন বােঝা যাবে তখনকার ইউরােপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানলে। ১৮৭০ ও ১৮৮০ এর দশকে পুঁজিবাদী দেশগুলাে, বিশেষত: বৃটেনে চলছিল অর্থনৈতিক মন্দা। বেচা কেনা কমে গেছিল, দ্রব্য মূল্যও কম ছিল। সেই সঙ্গে কম ছিল মুনাফা। দেশের বাইরে টাকা। খাটানর কোন বিকল্প ছিল না। পুঁজিবাদীরা তাই টাকা খাটানর জন্য ও লাভের জন্য দেশ দখল করে সাম্রাজ্য বাড়ান শুরু করল। বিদেশী স্টকে (stock) লগ্নি করা টাকা ১৮৮৩ সালে সাড়ে নয় কোটি থেকে বেড়ে ১৮৮৯ সালে হল ৩৯.৩ কোটি পাউন্ড। অল্প দিনের মধ্যেই এটা বৃটেনের মােট জাতীয় আয়ের (GDP) আট শতাংশ এবং সঞ্চয়ের অর্ধেক হল। টাকাটা লগ্নী করা হল স্টকে (stock)। এই স্টক সমূহ বিদেশে রেলপথ, সেতু, বন্দর ইত্যাদি তৈরীতে অথবা সরকারী খাতে টাকা খাটিয়ে নির্দিষ্ট হারে সুদ দিত। এই সুদের হার ছিল বৃটেনে যে হারে এই টাকা থেকে আয় করা সম্ভব হত, তার চাইতে বেশী। এছাড়াও এই টাকা খাটানর ফলে বৃটিশ শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের বাজার বাড়ত। যেমন বিদেশে রেলপথ, সেতু ইত্যাদি তৈরীর জন্য ইস্পাতের প্রয়ােজন হত, এইভাবে বৃটিশ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রসারের একটি নতুন সুযােগের সৃষ্টি করেছিল। যে সমস্ত দেশে বৃটিশ পুঁজি বিনিয়ােগ করা হল তারা যাতে টাকা ঠিক মত দেয় সেজন্য সেসব দেশে অস্ত্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হল। এইভাবে উপনিবেশের প্রয়ােজন হল।

১৮৭৬ সালে মিশর তার দেনা পরিশােধে অক্ষম হয়। বৃটেন ও ফ্রান্স যুক্তভাবে মিশরের অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে নেয়। ১৮৮০ এর দশকের প্রথম দিকে বৃটেন সামরিক বাহিনী দ্বারা মিশরকে “আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করে। বাস্তবে মিশর বৃটিশ সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয় এবং এতে সুয়েজ খাল থেকে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত হল ও ভারতে বৃটেনের আরও বড় বিনিয়ােগ এর জন্য যােগাযােগের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হল। একইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার সােনা ও হীরার খনি আবিষ্কার হওয়ার পর ডাচ ভাষাভাষী বুয়র (buer) দের সঙ্গে যুদ্ধ করে সেখানে বৃটিশ আধিপত্য স্থাপন করে।

উপনিবেশসমূহ যেমন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলাের নিরাপদ বিনিয়ােগের স্থান ছিল তাই নয়, এগুলাে তাদের সামরিক ঘাঁটি ছিল যার দ্বারা তারা আরও দূরবর্তী উপনিবেশ এবং সেখানে যাতায়াতের পথ রক্ষায় সাহায্য করত। যেমন মাল্টা, সাইপ্রাস, মিশর, দক্ষিণ ইয়েমেন যে শুধু ব্যবসা ও মুনাফার ক্ষেত্র ছিল তাই নয়, এগুলাে বৃটেন থেকে ভারতে যাবার পথ সুরক্ষা করত। ভারত ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের “মুকুটের রত্ন”, উপনিবেশ ছাড়াও ভারত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার টিন ও রাবার বাণিজ্য, চীনের বাজার, অষ্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড যাবার পথে। এইভাবে সারা পৃথিবীতে মালার মত উপনিবেশগুলাে একে অপরের রক্ষার কাজে ও ব্যবসার কাজে বৃটেন ব্যবহার করত।

বৃটেনের মত ফ্রান্সও বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিল। ইন্দোনেশিয়া ছিল হল্যান্ডের দখলে। বেলজিয়াম আফ্রিকার একটা বিরাট অংশ দখল করেছিল। রাশিয়ার জার তার দেশের পূর্ব দিকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত আর দক্ষিণে প্রায় ভারতের সীমানা পর্যন্ত বিরাট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত।

ইউরােপের সবচাইতে দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা শিল্প প্রধান দেশ জার্মানীর ছিল না কোন সাম্রাজ্য। জার্মানীর ভারী শিল্প গুলি সংগঠিত হয়েছিল একটি বিশেষ ধরনে-যা trust নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে তৈরী শেষ হওয়া পর্যন্ত একটি পণ্য উৎপাদনে যত ধরনের কোম্পানী কাজ করে তারা একযােগে কাজ করত। তারা রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযােগিতা করত এবং আশা করত রাষ্ট্র আমদানী শুল্ক আরােপ করে বিদেশী পণ্য সীমিত করে তাদের পণ্যের বাজার দেশে নিশ্চিত করবে। বৃটেনের কিছু পুঁজিবাদীদের রাষ্ট্র সম্পর্কে যে অবিশ্বাস ছিল, তা জার্মানীতে ছিল না। জার্মানীর পুঁজিবাদীরা এটাও আশা করত যে রাষ্ট্র তাদের বিদেশের বাজার অধিকার করতেও সাহায্য করবে।

চীনে জার্মানী চুক্তি করে একটি বন্দর দখলে নিল। আফ্রিকাতে তারা টাঙ্গানিকা, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি ও দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকা জয় করল। মরক্কোর দখল নিয়ে জার্মানী বিবাদে জড়িয়ে পড়ল ফ্রান্স ও স্পেনের সঙ্গে। কিন্তু পৃথিবীর যে অঞ্চলে জার্মানী উপনিবেশ ও বাজারের সন্ধানে নামল, তারা দেখল অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আগেই সেখানে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী এই শক্তিগুলির নেতারা জানতেন যে সাম্রাজ্য দখল করা ও নিয়ন্ত্রণ রাখা নির্ভর করবে সামরিক শক্তির উপর । জার্মানী তাই বৃটেনের নৌশক্তির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সামর্থ্য তৈরী করার জন্য যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ শুরু করল। বৃটেনও তার নৌজাহাজের উন্নয়ন শুরু করল। ফ্রান্স তার অধিবাসীদের বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে চাকুরীর মেয়াদ দুই বৎসর থেকে বাড়িয়ে তিন বৎসর করে সৈন্যসংখ্যা বাড়াল। রাশিয়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমরাস্ত্র কারখানা চালু করল আর রেলযােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নয়ন শুরু করল। এইভাবে সাম্রাজ্য রক্ষা ও বৃদ্ধির প্রয়ােজনে সমর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। কাজেই আপাত দৃষ্টিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুর কালকে প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার সময় বলে মনে হয়েছিল – যা বার্নষ্টেইন ও তার সহযােগী সমাজতন্ত্রীদের প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু এই স্থিতিশীলতা সম্ভব হয়েছিল সাম্রাজ্য বিস্তার ও তার ফলে মুনাফার বৃদ্ধির কারণে। এরপর সাম্রাজ্য বিস্তার এর স্থানও কমে আসল। এক সাম্রাজ্য অপর এক সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংঘাতের উপক্রম হল – সমর প্রস্তুতি শুরু হল।

New York Governor Horatio Seymour’s famous “My Friends” speech delivered from the steps of the New York City Hall during the draft riots in 1863. The Cartoon was probably drawn by Henry L. Stephens in 1863 in connection with the New York Tribune. Picture Courtesy of: The Library of Congress location number cph.3b42499

শ্রেণী সংগ্রাম

এই সময় কালে শ্রমজীবীদের সংগ্রাম থেমে থাকে নাই। কোন কোন স্থানে এই সংগ্রাম নির্বাচনী রাজনীতির পরিসরে স্থান নিয়েছিল। বিশেষ করে জার্মানীতে। কিন্তু অধিকাংশ দেশে শ্রমিক আন্দোলন তীব্র আকারে দেখা গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৮০ এর দশকে শ্রম দিবস নিয়ে ধর্মঘট, রেল শ্রমিকদের ধর্মঘট (১৮৯৪ সালের স্ট্রাইক), ১৯০২ সালের পেনসিলভানিয়ার খনি ধর্মঘট এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য। সশস্ত্র পুলিশ ও বেসরকারী নিরাপত্তাকর্মীদের দিয়ে মালিকেরা এই ধর্মঘটগুলাে দমন করে। বৃটেনে ১৮৮৯ সালে ডক শ্রমিকদের ধর্মঘট ও পূর্ব লন্ডনে মহিলা দিয়াশলাই শ্রমিকদের ধর্মঘট হয়, এদেশেও ধর্মঘট কঠোর হাতে দমন করা হয়। ফ্রান্সে ১৮৮৬ সালে ডেকাজুভিল খনি শ্রমিকদের ধর্মঘটে সেনাবাহিনী মােতায়েন ও অনেক শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। উত্তর ফ্রান্সে বস্ত্র কারখানার শ্রমিকদের উপর গুলিবর্ষন করা হয়েছিল।

কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে পুঁজিবাদী দেশগুলি যে লাভ করেছিল এবং এতে তাদের শ্রমিকদের, বিশেষতঃ কারিগরী দিক থেকে দক্ষ শ্রমিকদের, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ফলে শ্রমিক আন্দোলন গুলাে বিপ্লবের পথে না গিয়ে সমাজ সংস্কার সংগ্রামে সীমিত থেকেছে। তবে সেই সময়কার শ্রমিক আন্দোলন পর্যালােচনা করলে দেখা যায় বৃটেনে (বৃটেন ছিল তখন সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি) দক্ষ শ্রমিকরাও মজুরী কমানর বিরুদ্ধে ধর্মঘট করেছে। অন্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ইউরােপ ও উত্তর আমেরিকায় পুঁজিবাদ সেই সময়কালে স্থিতিশীলতার কারণ হল তারা বার বার অর্থনৈতিক সংকটের প্রবণতা কমাতে পেরেছিল। যার ফলে সমাজ সংস্কার সম্ভব মনে করা যায় এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।

পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রসারের ফলে শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যা বাড়তে থাকল ও শ্রমিকদের সংগঠনে পরিবর্তন আসল। খনি শিল্প, লােহা ও ইস্পাত শিল্পের পরিসর বাড়ল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নতুন শিল্প যেমন রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির শিল্পও গড়ে উঠল। বৃটেনে শিল্প বিপ্লবের সময় ছিল বস্ত্র শিল্প শ্রমিকদের প্রাধান্য- এই যুগে ভারী শিল্পের শ্রমিক শুধু বৃটেন নয়, সমস্ত পুঁজিবাদী দেশে প্রধান হয়ে উঠল। এই সময় শিল্পে assembly line এর মাধ্যমে mass production গড়ে উঠে। ১৯০১ সালে হেনরী ফোর্ড বিখ্যাত মডেল টি মটর গাড়ী সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রির জন্য বাজারজাত করেন। ১৯১৩ সালে ডেট্রয়েটে ফোর্ড কোম্পানীর বড় কারখানা চালু করেন, যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক assembly line পদ্ধতিতে মটর গাড়ী উৎপাদন শুরু করে। দুই দশকের মধ্যে দশটিরও বেশী দেশে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এই পদ্ধতিতে বড় বড় কারখানায় উৎপাদন করতে থাকে। তবে সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই সময় অস্থিতিশীলতা শুরু হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে উৎপাদনকারী দেশগুলােতে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমতে থাকে। তার ফলে শুরু হয় শ্রমিক আন্দোলন, যা এই দেশগুলিতে অনেকগুলাে শ্রমিক ধর্মঘটের রূপ নেয়। এর আগের সময়কালের শ্রমিক আন্দোলন, যা মালিকদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে দর কষাকষির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং সংসদীয় পদ্ধতিতে কর্মকান্ড পরিচালনা করত, তার বদলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর শ্রমিক নেতা তৈরী হল। আমেরিকায় ১৯০৫ সালে, Industrial Workers of the World নামে সংগঠন তৈরী হল, যা প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক সংগঠন The American Federation of Labour এর চাইতে আরও জঙ্গীভাবে খনি শ্রমিক, বস্ত্র শ্রমিক, বন্দর শ্রমিকদের ধর্মঘট পরিচালনা করেছিল। তারা মহিলা ও সংখ্যালঘু শ্রমিকদের সংগঠনের মধ্যে নিয়ে আসল। এদেরকে অতীতে শ্রমিক সংগঠন গুলাে গুরুত্ব দেয় নাই। ফ্রান্সে Confederation General deTravail (CGT) একই রকম জঙ্গী আন্দোলন গড়ে তােলে। তারা সংসদীয় রাজনীতিতে অংশ না নিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সামাজিক বিপ্লবের নীতিতে বিশ্বাস করত। তাদের মতবাদ syndicalism নামে পরিচিতি পায়। স্পেন, আয়ারল্যান্ড এমনকি বৃটেনেও একইভাবে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন ধারার সৃষ্টি হয়।

সংসদীয় রাজনীতির বিকল্প হিসেবে বিপ্লব বেছে নেওয়ার চিন্তা রাশিয়াতে ১৯০৫ সালের বিপ্লব ঘটায় আরও শক্তি পায়। পশ্চিম ইউরােপে পুরনাে শাসকগােষ্ঠীসমূহকে ১৮১৪ – ১৫ সালে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বড় ভূমিকা রাখায় জার (Tsar) শাসিত রাশিয়ার প্রতিবিপ্লবী শক্তি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি ছিল। ১৯০৫ সালে জারের শাসন প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। রাশিয়ার রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে জারের সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলত এমন একটি সংগঠনের শ্রমিকরা জারের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যায়। সৈন্যরা তাদের উপর গােলাবর্ষণ করে। এই ঘটনার পর শ্রমিকদের আন্দোলন জঙ্গী আকার ধারণ করে। বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক ধর্মঘট ডাকা হয়। একটি নতুন ধরনের সংগঠন গড়ে উঠে সেন্ট পিটার্সবার্গে। যার নেতৃত্ব দেন ২৬ বৎসর বয়স্ক লিও ট্রটস্কী। প্রতিটি কারখানা বা শিল্প থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়ে উঠা এই সংগঠনের নাম হয় “সােভিয়েত” (এই শব্দ council শব্দের রুশ প্রতিশব্দ)। এই সােভিয়েতই হয় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। কৃষ্ণসাগরে অবস্থিত নৌবাহিনীতে “পটেমকিন” নামের যুদ্ধজাহাজের নাবিকদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ দেখা দেয়। মস্কো শহরে ডিসেম্বর মাসে সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটদের বলশেভিক নামে এক অংশ বিপ্লব ঘটানর চেষ্টা করে। এর নেতৃত্বে ছিলেন ম্লাদিমির লেনিন।

শ্রমিকদের সংগঠন হিসেবে সােভিয়েত ছিল অতীতের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। ফরাসী বিপ্লব ছিল এলাকা ভিত্তিক সংগঠন, আর প্যারী কমিউন ছিল ছােট ছােট শিল্পের প্রতিনিধিভিত্তিক, সােভিয়েত ছিল বৃহৎ শিল্পের শ্রমিকদের প্রতিনিধিভিত্তিক। সেন্ট পিটার্সবার্গ ছিল এরকম বৃহৎ শিল্প কারখানার শহর, যদিও সামগ্রিকভাবে রাশিয়া ছিল পশ্চাদপদ। অধিকাংশ রাশিয়ান ছিল কৃষক, যাদের উৎপাদন পদ্ধতি ছিল মধ্যযুগীয়। জারতন্ত্রের ভিত্তি ছিল রুশ অভিজাত শ্রেণী, রাশিয়ান পুঁজি মালিকেরা নয়। তাই ১৯০৫ সালের বিপ্লবের লক্ষগুলাে ছিল মূলতঃ পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে যাওয়ার প্রচেষ্টা। যা সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডের বিপ্লব ও অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সের বিপ্লবের মত ছিল। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র তৈরী ও রেলপথ তৈরীর প্রয়ােজনে রাশিয়ায় কয়েকটি স্থানে (যার মধ্যে সেন্ট পিটার্সবার্গ ছিল অন্যতম) বৃহৎ শিল্প স্থাপন করেছিল। এতে শিল্প শ্রমিকশ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছিল, যার সংখ্যা ছিল প্রায় বিশলক্ষ। এই শ্রমিকশ্রেণীর উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ রুশ বিপ্লবের চরিত্র বদলে দিয়েছিল। রুশ বিপ্লবের চরিত্র ও শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা নিয়ে যারা এতে অংশগ্রহণ করছিল তাদের মধ্যে মতভেদ ছিল। একদল মনে করত রাশিয়ার পুঁজিবাদী স্তরের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার দরকার নাই সরাসরি সমাজতন্ত্রে যাওয়া সম্ভব, যা হবে কৃষক ও গ্রাম ভিত্তিক। প্রয়ােজন শুধু সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা ভেঙ্গে দেওয়া। এরা পরিচিত ছিল নারােদনিক (যার

অর্থ জনগণের বন্ধু) নামে এবং এরা সােশ্যাল রেভুলিউশনারী দল গঠন করেছিলেন। কিছু সংখ্যক মার্কসপন্থী মনে করতেন এই বিপ্লব পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে রূপ নেবে। তাদের এক অংশ (সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটিক দলের মেনশেভিক অংশ নামে পরিচিত) মনে করতেন পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণই তখনকার লক্ষ্য। এই দলের বলশেভিক অংশও তখন পর্যন্ত এই মত পােষণ করত। কিন্তু লিও ট্রটস্কী মনে করলেন এই বিপ্লব আরও এগিয়ে যেতে পারে। শ্রমিকশ্রেণীর অংশ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের দাবীও তােলা সম্ভব।১২ ১৯১০ সালের পরেও ইউরােপ ও উত্তর আমেরিকায় শ্রমিক আন্দোলন ঘটতে থাকে। পুঁজিবাদী দেশগুলাের সাম্রাজ্য বিস্তার ও অর্থনৈতিক উন্নতির পরও তাদের নিজেদের দেশে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠছিল না।

The Economics of first World War courtesy of You Tube

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ

সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টায় একটি পুঁজিবাদী দেশ অন্যটির সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। এটা প্রথম দেখা গেল ১৯০৪ সালে। রাশিয়ার সাম্রাজ্য সীমানা পূর্ব দিকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত প্রসারিত করার চেষ্টা করায় তারা জাপানের সাম্রাজ্য কোরিয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকে বিস্তার এর চেষ্টার মুখােমুখি হয়। দুই পক্ষের যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হয়। ফ্রান্স ও জার্মানীর মধ্যে মরক্কোতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে দুইবার যুদ্ধের উপক্রম হয় ১৯০৬ ও ১৯১১ সালে। কিন্তু সবচাইতে বিস্ফোরণম্মুখ এলাকা ছিল বলকান উপদ্বীপ। এখানকার ছােট ছােট দেশগুলির সঙ্গে এক একটি পুঁজিবাদী দেশের সংযােগ ছিল। আর এই ছােট দেশগুলির মধ্যে সংঘাতও হত প্রায়ই। দুইবার চুক্তি হওয়ার পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় নাই।

২০১৪ সালের জুলাই মাসে অন্থীয়ার আর্চ ডিউক সারায়েভাে (Sarajevo) শহর পরিদর্শনে আসেন। এই শহরটি ছিল অষ্ট্ৰীয়ান সাম্রাজ্যের অধীন বসনিয়া প্রদেশের রাজধানী। সেখানে একজন সার্বীয় (Serbian) আততায়ী তাকে হত্যা করে। সার্বীয়া চাইছিল অষ্ট্ৰীয়া থেকে বসনিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে সার্বীয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে। এই ঘটনার পর অষ্ট্ৰীয়া সার্বীয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। সার্বীয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক থাকায় রাশিয়া অষ্ট্ৰীয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি নেয়। অষ্ট্ৰীয়ার মিত্র জার্মানী তখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। ফ্রান্স মনে করে জার্মানী রাশিয়াকে পরাজিত করতে পারলে জার্মানী আরও শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে আবির্ভূত হবে। তাই ফ্রান্স জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ইংল্যান্ডও জার্মানীর বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সমর্থনে যুদ্ধে যােগ দেয়। অল্পদিনের মধ্যেই অনেকগুলাে রাষ্ট্র দুই পক্ষের কোন এক পক্ষে যুদ্ধে যােগ দেয়। শুরুতে central powers (অষ্ট্ৰীয়া, হাঙ্গেরী ও জার্মানী) ছিল এক দিকে আর allied powers (বৃটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া) ছিল অপরদিকে। কয়েক মাসের মধ্যে জাপান allied powers এর সঙ্গে যােগ দেয় আর তুরস্ক যােগ দেয় বিপরীত দিকে। ১৯১৫ সালে ইতালী ও ১৯১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র allied powers এ যােগ দেয়। যুদ্ধ শুরুর ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে ছােট মনে হতে পারে। কিন্তু এর পিছনে ছিল একটি বিস্ফোরণম্মুখ পরিবেশ। আর এই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল সাম্রাজ্য বিস্তার এর দ্বন্দ্বের কারণে। অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তখন এলাকা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ নেয়।

যুদ্ধের শুরুতে সব পক্ষই মনে করেছিল যুদ্ধ হবে স্বল্পস্থায়ী। জার্মানীর যুবরাজ অল্পদিনেই বিজয় আশা করেছিলেন। বৃটিশরাও মনে করেছিল তারা অল্প দিনেই জয়ী হবে। প্রথমদিকে সাধারণ মানুষ যুদ্ধের পক্ষে ছিল। বার্লিনে মানুষ রাজপথে যুদ্ধের পক্ষে শােভা যাত্রা বের করে। কফি হাউসগুলিতে দেশাত্ববােধক গান চলতে থাকে। ট্রেনগুলাে উৎসাহী সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে রওনা হয়। ফ্রান্সে যুদ্ধ করতে যাওয়া সৈন্যদের মধ্যে একই ধরনের উদ্দীপনা দেখা যায়। রাশিয়াতেও মানুষ অল্প কিছুদিন আগের শ্রমিক ধর্মঘট ভুলে গিয়ে যুদ্ধের পক্ষে দাঁড়ায়। তবে যুদ্ধের পক্ষে এই উৎসাহ শ্রমিকদের অনেক অংশের মধ্যে ছিল না। জার্মানীর শিল্প অঞ্চল Ruhr এ যুদ্ধের সমর্থনে প্রকাশ্যে কোন তৎপরতা দেখা যায় নি। দেখা যায়নি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের কারখানাগুলিতে।১৫ ইউরােপের শাসকশ্রেণী তাদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজ নিজ দেশের অন্যান্য শ্রেণীর মানুষদের এর সমর্থনে নিয়ে আসার জন্য পত্রপত্রিকা, শােভাযাত্রার আয়ােজন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করে। এ সত্ত্বেও যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে লন্ডন, প্যারিস ও বার্লিনে যুদ্ধবিরােধী সমাবেশে হাজার হাজার মানুষ যােগ দেয়।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেখা গেল যুদ্ধ অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে এই ধারণা সঠিক নয়। প্রথম কয়েক মাসে জার্মান বাহিনী বেলজিয়াম ও উত্তর ফ্রান্সের মধ্য দিয়ে প্যারিসের ৫০ মাইলের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল। পূর্ব দিকে রাশিয়া জার্মান

সীমান্ত পেরিয়ে অনেকটা ভেতরে চলে এসেছিল। দুই দিকেই এই বাহিনী পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হল। ফ্রান্স ও বৃটেনের সম্মিলিত বাহিনী Merne এর যুদ্ধে জার্মান বাহিনীকে ৩০ মাইল পিছিয়ে যেতে বাধ্য করল। জার্মানরা সেখানে প্রতিরক্ষা বহ গড়ে তুলল। রাশিয়ানরা Tannenberg এর যুদ্ধে বিরাট ক্ষয় ক্ষতি হওয়ার পর পরাজিত হয়ে জার্মানীর সীমানার বাইরে বিতাড়িত হয়। এরপর থেকে এই যুদ্ধ পরিণত হয় শক্তি ক্ষয়ের যুদ্ধে। দুই পক্ষই চেষ্টা করতে থাকে অপর পক্ষের প্রতিরক্ষা ভেদ করে এগিয়ে যেতে কিন্তু উভয় পক্ষই ব্যর্থ হয় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ। অনেকেই মনে করেছিল যুদ্ধ চার। মাসেই শেষ হবে-তা শেষ পর্যন্ত চার বৎসরের বেশী স্থায়ী হয়। যুদ্ধ পূর্বে ছড়িয়ে পড়ে তুরস্ক, উত্তর গ্রীস ও মেসােপটেমিয়ায়।

এর আগের যেকোন যুদ্ধের চাইতে এই যুদ্ধে বিস্তৃতি আরও অনেক বড় এলাকা জুড়ে ছিল। তাছাড়া গুণগতভাবেও এযুদ্ধ ছিল নতুন ধরনের। সমুদ্র, আকাশ ও স্থলে নূতন মারণাস্ত্রের দ্বারা যুদ্ধ করা হয়। সমুদ্রে যুদ্ধজাহাজ দিয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষের সরবরাহ বন্ধ করার জন্য বন্দর অবরােধ করে। সামরিক বিমান প্রথম ১৯১১ সালে ইতালীয়রা অটোম্যানদের বিরুদ্ধে উত্তর আফ্রিকায় প্রথম ব্যবহার করে। কিন্তু এই যুদ্ধে প্রথমবারের মত ব্যাপকভাবে যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করা হয় এবং যুদ্ধ বিমানের আক্রমণ যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরেও এবারই প্রথম করা হয়। স্থলযুদ্ধে যন্ত্রযানের ব্যবহার অনেক বাড়ে। রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র পরিবহনের জন্য ঘােড়ার চাইতে মটরলরীর গুরুত্ব বাড়তে থাকে ও যুদ্ধ শেষের দিকে দুটোই সমান ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। অস্ত্রের মারণ ক্ষমতা ভীতিপ্রদভাবে বেড়ে গেল। ১৯১৪ সালে প্রত্যেক বাহিনীর রাইফেল, মেশিন গান ও ফিল্ড গান (কামান) ছিল, যাদের ধ্বংসাত্নক ক্ষমতা ও লক্ষবস্তুতে আঘাত করার নির্ভুলতা আগের অস্ত্রের চাইতে অনেক বেশী ছিল। এ কারণে হতাহতের সংখ্যাও অনেক বাড়ে। ১৯১৪ সালে একজন বৃটিশ সৈন্য যে রাইফেল ব্যবহার করত তা দিয়ে আধা মাইল দূর পর্যন্ত একজন মানুষকে গুলি করা যেত। যে মেশিন গান ব্যবহার করা হত তা মিনিটে ৬০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে পারত। ফিল্ড গানগুলি মিনিটে তিন থেকে চার বার ১০০০০ গজ দূরত্বে গােলা নিক্ষেপ করতে পারত। আরও বড় কামান ছয়-সাত মাইল দূরের লক্ষ্য বস্তুতে গােলা নিক্ষেপ করতে পারত। ১৬

এই উন্নত মারণাস্ত্রের ব্যবহার যুদ্ধে অনেকদিন অচলাবস্থা থাকার একটি বড় কারণ। অনেক গােলা নিক্ষেপের পর যখন এক পক্ষ আক্রমণে এগিয়ে যেত, তখনও দেখা যেত প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ টিকে আছে এবং মেশিন গানের দ্বারা আক্রমণকারীদের থামিয়ে দিতে পারছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ১৯১৬ সালের পর জার্মানরা U-boat বা সাবমেরিন ব্যবহার করা শুরু করল। তারা বৃটেনের বন্দরগুলির চারদিকে জাহাজগুলােকে কোন রকম সাবধান না করেই সাবমেরিন আক্রমণ করে জাহাজ ডুবিয়ে দিতে লাগল। জাহাজগুলাে বৃটিশের না অন্য দেশের, যুদ্ধ জাহাজ না বাণিজ্যিক জাহাজ তা তারা দেখত না। উদ্দেশ্য ছিল এইভাবে বৃটিশ বন্দরগুলাে অবরােধ করা। আমেরিকার জাহাজ ডুবানর পর আমেরিকা জার্মানীর বিরুদ্ধে যােগ দেয়। রাশিয়ার বিপ্লব ঘটায় সেদিক থেকে জার্মানীর আক্রমণের ভয় ছিল না। কিন্তু ১৯১৮ সাল নাগাদ অন্য সব যুদ্ধক্ষেত্রে জার্মানী হারতে থাকে। ১১ই নভেম্বর ১৯১৮ যুদ্ধবিরতি ঘােষণা হয়।

মানবজাতির ইতিহাসে এই যুদ্ধ ছিল সবচাইতে বেশী রক্তক্ষয়ী। প্রায় এককোটি সৈন্য মারা যায়। আরও দুই কোটি সৈন্য গুরুতর আহত হয়। নিহতদের মধ্যে ১৮ লক্ষ ছিল জার্মানীর, ১৭ লক্ষ রাশিয়ার, ১৪ লক্ষ ফ্রান্সের, ১৩ লক্ষ অষ্ট্ৰীয়াহাঙ্গেরীর, সাড়ে সাত লক্ষ বৃটিশ ও ছয় লক্ষ ইতালীর। প্রত্যক্ষ যুদ্ধের কারণে অসামরিক মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল প্রায় এক কোটি এবং আর দুই কোটি অসামরিক মানুষ দুর্ভিক্ষ ও রােগে মারা যায়।”Verdun এর যুদ্ধে পাঁচ মাসে ২০ লক্ষ মানুষ অংশ নেয় এর অর্ধেকই নিহত হয়। কিন্তু কোন পক্ষই এই যুদ্ধে এগােতে পারেনি। ১৯১৬ সালে Sonne এর যুদ্ধে চার মাসে দশ লক্ষ মানুষ মারা যায়। এই যুদ্ধের প্রথম দিনেই বৃটেনের ১০ হাজার মানুষ মারা যায়।

যুদ্ধের ফলে সমাজে সামগ্রিক কর্মকান্ড আমূল বদলে গিয়েছিল। ১৯১৫-১৯১৬ সাল নাগাদ দুই পক্ষই উপলদ্ধি করে যে তারা একটি মরনপণ যুদ্ধে জড়িত হয়েছে। জনমানুষের কথা না ভেবে তারা তখন সমস্ত জাতীয় সম্পদ যুদ্ধের কাজে লাগানর ব্যবস্থা করল। ভােগ্যপণ্যের বদলে শিল্প-কারখানা অস্ত্রশস্ত্র তৈরীর জন্য বদলে ফেলা হল। এজন্য শ্রমিকদের এক ধরনের কাজ ও দক্ষতা থেকে অন্য ধরনের কাজ ও দক্ষতা অর্জন করতে হল। বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ও কৃষকদের সৈন্য হিসাবে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান হলে তাদের পরিবর্তে কাজ করার মানুষ সব সময় পাওয়া যেত না। এর ফলে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন কমে গেল। জার্মানীর শ্রমিকেরা গড়ে এই সময় ১৩১৩ ক্যালরির সমান খাবার পেত, যা জীবনধারনের জন্য যা প্রয়ােজন

তার চাইতে এক-তৃতীয়াংশ কম। অপুষ্টিতে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ মানুষ মারা যায়। বড় দেশগুলির শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেক মানুষকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হল। এদের জায়গা পূরণ করল মহিলারা। অতীতে মহিলারা কখনই এত সংখ্যায় শিল্পকারখানায় কাজ করে নাই। বৃটেনে শুধু গােলাবারুদ তৈরীর কারখানাগুলােতে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে হল ৮ লাখ। জার্মানীতে বড় কারখানাগুলােতে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে হল ২০ লাখ। মহিলাদের এতে কাজ দ্বিগুণ হয়ে গেল। কল কারখানায় কাজের সঙ্গে সঙ্গে ঘর বাড়ীর দায়িত্ব পালন ও ছেলেমেয়েদের দেখাশােনা করা। কিন্তু মহিলারা এর ফলে পুরুষদের সঙ্গে নিজেদের সমান ভাবাও শুরু করলেন। যুদ্ধে জড়িত প্রায় সব দেশই টাকা ধার নিয়ে ও টাকা ছাপিয়ে খরচ চালানর ব্যবস্থা করল। ফলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিল ও দ্রব্যমূল্য বাড়ল। যুদ্ধ শেষে ১৯১৪ সালের তুলনায় আমেরিকায় জিনিস পত্রের দাম বাড়ল আড়াই গুণ, বৃটেনে তিন গুণ, ফ্রান্সে সাড়ে পাঁচ গুণ এবং জার্মানীতে ১৫ গুণ। এই অসমান দাম বাড়ার জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও সমস্যা হল। যুদ্ধের ফলে ঘরবাড়ী, ক্ষেত-খামার, খনি, কারখানা, যােগাযােগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হল। বেশী ক্ষতি হল উত্তর ফ্রান্স, উত্তর ইতালী, পূর্ব ইউরােপ ও বেলজিয়ামে। সমুদ্র পরিবহনের খুব ক্ষতি হল। এর বড় কারণ ছিল সাবমেরিন যুদ্ধের ফলে অনেক জাহাজ ডুবে গিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হল। যুদ্ধের আগে বৃটেন, জার্মানী, ফ্রান্স ও আমেরিকা পৃথিবীর সবচাইতে বড় শিল্প প্রধান দেশ হিসেবে একে অপরের সঙ্গে সবচেয়ে বেশী পণ্য লেন দেন করত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জার্মানীর সঙ্গে আমেরিকা ছাড়া অন্য দেশগুলির বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেল। আমেরিকা বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। বৃটেন জার্মান বন্দর গুলাে অবরােধ করে শুধু জার্মানীর জাহাজই নয়, অন্যান্য দেশের জাহাজও আসা যাওয়া বন্ধ করে দিল। জার্মানরা সম্মুখ নৌ যুদ্ধে টিকতে না পেরে সাবমেরিন দিয়ে জাহাজ ডােবান শুরু করল যাতে বৃটেনে পণ্য পৌছাতে না পারে। যুদ্ধের ফলে ইউরােপের শিল্পোন্নত দেশগুলাে তাদের পণ্যের বাজার হারাল। জার্মানী প্রায় তার সমস্ত বাজার হারাল। এটা তার পরাজয়ের একটা কারণ। জার্মানীর বৈজ্ঞানিক ও কারিগরদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা দ্বারা তারা অনেক বিদেশী পণ্যের বিকল্প তৈরী করেছিল। এমনকি বৃটেনের মত একটি নৌ শক্তিও অনেক বাণিজ্য কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হল। ১৯১৮ সাল নাগাদ বৃটেনের রপ্তানী ১৯১৪ সালের তুলনায় অর্ধেক কমে গেল। ইউরােপের দেশগুলাে অনেক জিনিস – যা তারা আগে অন্য ইউরােপীয় দেশের কাছ থেকে কিনতে পারত – ইউরােপের বাইরের দেশ থেকে কিনতে বাধ্য হল। আমেরিকা অনেক ইউরােপীয় বড় দেশে পণ্য সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হল। জাপানও ইউরােপের বাজারে একটা বড় স্থান করে নিল।

বিদেশে পুঁজিলগ্নিও ইউরােপীয় দেশ গুলাের আয়ের একটা বড় উৎস ছিল। বৃটেন, ফ্রান্স ও জার্মানীর অনেক পুঁজি বিদেশে বিনিয়ােগ করা ছিল। বৃটেন যত জিনিস রপ্তানী করত তার চাইতে অনেক বেশী আমদানী করত। এই ঘাটতি পূরণ করা হত বিদেশে লগ্নি করা পুঁজির আয় হতে। যুদ্ধের ফলে কোন কোন দেশ এই পুঁজি যুদ্ধের ব্যয় মেটানাের জন্য খরচ করল। কিছু পুঁজির দাম কমে গেল মুদ্রাস্ফীতির জন্য। আর কারও কারও পুঁজি বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। জার্মানীর বিদেশে লগ্নি করা পুঁজি বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। ফ্রান্স, রাশিয়ায় যে বিনিয়ােগ করেছিল, রুশ বিপ্লবের পর সেটা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল।যুদ্ধ শেষে বৃটেনের পুঁজির প্রায় ১৫ শতাংশ, ফ্রান্সের প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেল আর জার্মানীর বিনিয়ােগ করা পুঁজির সবটাই চলে গেল। আমেরিকা যুদ্ধের আগে ছিল অন্যান্য ইউরােপীয় দেশের কাছে দেনাগ্রস্ত যুদ্ধের সময় পণ্য বিক্রি করে ও অন্যদের বিনিয়ােগ কিনে নিয়ে হয়ে গেল ঋণদাতা দেশ।

যুদ্ধরত সবগুলাে দেশই অর্থনীতির একটি বড় অংশ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসল। এসব দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও সমরনায়কেরা অনুধাবন করল,যুদ্ধে সফলতার জন্য কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে একচেটিয়া পণ্য উৎপাদন শুরু হয়। যুদ্ধশেষে দেখা গেল বৃটেনের আমদানীর ৯০ শতাংশ, খাদ্য সরবরাহের ৮০ শতাংশ ও প্রায় সব পণ্যের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করে।১৯ জার্মানীতে যুদ্ধের শেষের দিকে জেনারেল হিন্ডেনবার্গ ও লুন্ডেনডর্ফ একচেটিয়া শিল্পপতিদের সঙ্গে মিলে অর্থনীতির পুরােটাই নিয়ন্ত্রণ করত। বাজার অর্থনীতি বলতে কিছু ছিল না যুদ্ধরত দেশগুলিতে।

প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক সংগঠনগুলাের নেতৃত্ব প্রায় সবদেশেই সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানিয়েছিল। যদিও জীবন যাত্রার মান ক্রমেই কমে আসছিল। জার্মানীতে ১৯১৭ সাল নাগাদ অসামরিক কারখানাগুলির শ্রমিকদের আয় আগের তুলনায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। তারপরও শ্রমিক সংগঠনগুলাে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ধর্মঘটের বিরুদ্ধে ছিল। যারা এটা মানতে চাইত না-তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হত, বৃটেনে তাদের দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করা হত আর জার্মানীতে

তাদের ধরে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু যতই শ্রমিকদের আয় কমতে থাকল, কাজের সময় বাড়তে থাকল, কর্মস্থল আরও বিপদজনক হয়ে উঠতে থাকল ততই শ্রমিকদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যেতে থাকল। মহিলা শ্রমিকরাও এই প্রতিরােধে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯১৬-১৭ সালে জার্মানীর বিভিন্ন শহরে খাদ্য স্বল্পতার বিরুদ্ধে শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছিল। বৃটেনের গ্লাসগােতে ১৯১৫ সালে বাড়ী ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে মহিলা শ্রমিকদের নেতৃত্বে মাসাধিককাল ব্যাপী তীব্র ও সফল আন্দোলন হয়।২২ দক্ষ শ্রমিকদের যুদ্ধে পাঠানাে হত না। কারণ তারা অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি তৈরিতে ছিল অপরিহার্য। সংখ্যায় কম হলেও তারা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করলেও তাদের নেতাদের (shop stewards)মধ্যে যােগাযােগ ছিল। ধীরে ধীরে সাধারণ শ্রমিক ও দক্ষ শ্রমিকদের প্রতিবাদ সংযুক্ত হতে শুরু করল এবং যুদ্ধের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। এই প্রতিবাদের নেতৃত্বে অনেক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রীরা ছিল।

যুদ্ধক্ষেত্রে যারা যাচ্ছিল তারা যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করছিল, যার জন্য তারা তৈরী ছিল না। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখােমুখি থাকা, মৃত ও আহতদের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া, দৈনন্দিন জীবনে জীবনযাত্রার কঠিন অবস্থা (যেমন, দূষিত পানি ও খাবার, নােংরা বাসস্থান) এগুলাের কারণে যুদ্ধ সম্পর্কে তাদের মােহ কাটতে লাগল। বিপরীতে তারা দেখল উচ্চপদস্থ অফিসারদের ভাল থাকার জায়গা, ভাল খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করা।

বড় সেনা বিদ্রোহ প্রথমে তুরস্কে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে হল। একটি যুদ্ধে আড়াই লক্ষ সৈন্য মারা যাওয়ার পর ৬৮টি ডিভিশন (ফরাসী সেনাবাহিনীর প্রায় অর্ধেক) যুদ্ধে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানাল। কোন কোন স্থানে সৈন্যরা লাল পতাকা তুলে বিপ্লবের গান International গাইল। বিদ্রোহ দমন করার জন্য ৪৯ জন সৈন্যকে হত্যা করা হয়। ১৯১৭ সালে ইতালীতে ৫০০০০ সৈন্য সেনা বিদ্রোহ করে। বৃটেনের প্রায় ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) সৈন্য বুলনের (Boulogne)কাছে বিদ্রোহ করে। দাবী মেটানাের আশ্বাস দিয়ে বিদ্রোহ থামানাের পর বিদ্রোহের নেতাদের মেরে ফেলা হয়।

যুদ্ধ করার জন্য লক্ষ লক্ষ কৃষককে গ্রাম থেকে নিয়ে এসে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। জার্মানী, ইতালী, রাশিয়া, অষ্টীয়া-হাঙ্গেরী এসব দেশে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে মানুষদের ধরে আনা হয়। সেনাবাহিনীতে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনার মুখােমুখি হয়, যা তাদের গ্রামের জীবনে কোনদিনই তারা পেত না। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন ভাষাভাষি, বিভিন্ন জাতীয়তার মানুষ, ধর্মীয় চিন্তা, গণতন্ত্র এমনকি সমাজতন্ত্রে উদ্বুদ্ধ এমন বিভিন্ন মতের মানুষদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধের জীবন কাটাতে হত।

Brussels at the end of the Great War

উত্তাল ইউরােপ

ব্রেস্ট লিটোভষ্ক এ কঠোর শর্ত আরােপ করে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করার পর জার্মানীর উপর চাপ কিছুটা কমল। কিন্তু তা ছিল অল্প সময়ের জন্য। ১৯১৮ সালের মার্চে জার্মানী আক্রমণ চালিয়ে ফ্রান্সের অভ্যন্তরে আরও কিছু এলাকায় অগ্রসর হতে পারল। কিন্তু ঐ বৎসর আগষ্ট মাসে আরেকটি অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর জার্মানী পিছু হটতে বাধ্য হলাে। জার্মানীর জনশক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসছিল। এ দিকে মিত্রশক্তির সঙ্গে আমেরিকা যােগ দেওয়ায় সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহ অনেক বাড়ল। জার্মান ক্ষমতাসীনরা বুঝতে পারল তাদের শান্তিচুক্তি করার বিকল্প নাই। জার্মানীর রাজা কাইজার দ্বিতীয় উইলহেম একটি নতুন সরকার নিয়ােগ দেন। কিন্তু তাতে যুদ্ধের ব্যাপারে মিত্রশক্তির মনােভাব নমনীয় হয়নি। মিত্রশক্তি ফ্রান্স ও বেলজিয়াম থেকে জার্মান বাহিনীকে হঠিয়ে দিতে থাকল। বলকান উপদ্বীপেও মিত্রশক্তি অষ্ট্ৰীয়ার বাহিনীকে তাড়িয়ে দিল। জার্মান সমরনায়করা বৃটেনে নৌবাহিনীর আক্রমণ চালানর সিদ্ধান্ত নিলেও নৌসেনাদের বিদ্রোহের জন্য তা ঘটে নাই। কিয়েল শহরে নৌসেনারা ডক শ্রমিকদের সঙ্গে মিলে শহরে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে একটি সেনা কাউন্সিল গঠনের ঘােষণা দিল। বিদ্রোহ এরপর ব্রেমেন, হামবুর্গ, হ্যানােভার, কলােন, ড্রেসডেন, লিপজিগ শহরে ছড়িয়ে পড়ল। ৯ই নভেম্বর বার্লিনে হাজার হাজার সৈনিক ও শ্রমিক শহরে শােভাযাত্রা করে জার্মানীকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘােষণা করল। তারা সদ্য কারামুক্ত বিপ্লবী কার্ল লিবনেকট (Karl Liebknecht) কে নেতা হিসাবে মেনে নিল। তবে সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট দলের একজন নেতা (যে যুদ্ধ চলাকালীন একজন মন্ত্রী ছিল) Scheidemann ও নিজেকে সরকার প্রধান বলে ঘােষণা করল। কাইজার উইলহেম (রাজা) পালিয়ে হল্যান্ড চলে গেলেন। সৈন্য ও শ্রমিকদের ১৫০০ প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত একটি সংসদের কাছে অনুমােদনের জন্য সােশ্যাল ডেমক্র্যাট দলের দুই অংশ মিলে একটি সরকারের প্রস্তাব পেশ করল। জার্মানী ও জার্মানী অধিকৃত বেলজিয়ামে সৈনিক- শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের কাউন্সিল এই সময় রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হল।

উত্তর সাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিরাট এলাকায় যুদ্ধের শেষ সময়ে এই শ্রমিক ও সৈনিকদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত কাউন্সিল (বা সােভিয়েত) বিপ্লবের প্রতিভূ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল। কিন্তু শ্রমিক সৈনিকদের প্রতিনিধিরা শাসনক্ষমতা এমন সব লােকের হাতে তুলে দিল যারা বিদ্যমান শাসন কাঠামাে বজায় রাখতে ছিল বদ্ধপরিকর। নতুন প্রধানমন্ত্রী এবার্ট (Ebert) দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সামরিক বাহিনীর কর্ণধারদের সঙ্গে শ্রমিক সৈনিকদের মােকাবিলা করার জন্য আলােচনা শুরু করেছিলেন। সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট দলের নেতারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংস্কার এর। পক্ষপাতী ছিলেন। তারা যুদ্ধের শুরু থেকেই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সমর্থন করে আসছিলেন। তারাও পরিবর্তন ঠেকানাের জন্য তৎপর হলেন।

বিপ্লব ও পরিবর্তনের নেতা ছিলেন কার্ল লিবনেট ও রােজা লুক্সেমবার্গ । লিবনেকট এর বার্লিন এর শ্রমিক ও সৈনিকদের মধ্যে শক্ত ভিত্তি ছিল। সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট নেতারা সামরিক কমান্ডের সঙ্গে মিলে বার্লিনে একটি অভ্যুত্থান উস্কিয়ে দিল। তারপর বাহির থেকে সৈন্য বাহিনী নিয়ে এসে এই অভ্যুত্থান দমন করল। এই সংঘর্ষের দায় চাপিয়ে দিল লিবনেকট ও লাক্সেমবার্গের উপর, এবং তাদের দুজনকে হত্যা করল। এরপরও বিপ্লব দমন করা সহজ হয়নি। কোন কোন ঐতিহাসিক এর মতে জার্মান বিপ্লব তেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল না এবং বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২৫ প্রকৃতপক্ষে বিপ্লব ১৯২০ সালের আগে সম্পূর্ণ দমন করা যায়নি এবং ১৯২৩ সালে বিপ্লবের আরেকটি ঢেউ উঠেছিল।

১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসের বিপ্লবে জার্মানীর জনসংখ্যার একটা বড় অংশ রাজনীতিতে আগ্রহী হল। অতীতে বিপ্লব ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে শুধু সচেতন শ্রমিকদের মধ্যে আলােচনা হত। এখন তা সমস্ত কর্মজীবী মানুষ ও নিম্ম মধ্যবিত্তদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। অনেক মানুষ আগে মধ্যপন্থী ক্যাথলিক দল ও অন্যান্য দলের সমর্থক ছিল। যুদ্ধের সময় তারা যুদ্ধবিরােধী শ্রমিকদের সংস্পর্শে এসে সমাজবদলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট নেতারা বিপ্লবী স্লোগানের আড়ালে পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে এর মধ্যেই সংস্কারের কথা বলছিল। লিনেকট ও লুক্সেমবার্গ উগ্রপন্থা অবলম্বন করে সমাজবদলের প্রচেষ্টা বিঘ্নিত করেছে-এটা ছিল তাদের বক্তব্য। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটদের সম্মন্ধে মানুষের মােহ কাটতে লাগল। বার্লিনে এরপরও একাধিকবার শ্রমিক সৈনিকদের অভ্যুত্থান হয়। অন্যান্য শহরেও শ্রমিক ধর্মঘট হল। ১৯১৮ সালের শেষ দিক থেকে ক্ষমতাসীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট দলীয়) সামরিক বাহিনীর সহযােগিতায় Freikorps নামে ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনী গঠন করল। ১৯১৯ সালের প্রথম ভাগে এই বাহিনী জার্মানীতে শ্রমিকদের সংগঠনগুলােতে আক্রমণ চালান শুরু করল। অনেক জায়গায় এদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ হয়েছিল। বাভারিয়াতে এপ্রিল মাসে অল্পদিন স্থায়ী হলেও শ্রমিকদের সােভিয়েত রিপাবলিক স্থাপিত হয়েছিল।

জার্মানীতে এই উত্তাল সময় যখন চলছিল, তখন ইউরােপের অন্যান্য অনেক জায়গায় একই ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছিল। তখনকার বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ ফরাসী প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেনসু এর কাছে লিখেছিলেন, “সারা ইউরােপ বিপ্লব চেতনায় পূর্ণ- ইউরােপের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের ব্যাপক জনমানুষ বিদ্যমান, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্মন্ধে প্রশ্ন তুলেছে”। হাঙ্গেরীতে বেলকুনের নেতৃত্বে সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট ও কমিউনিষ্ট দলের সমন্বয়ে একটি সােভিয়েত সরকার শাসন ক্ষমতা নেয়। তারা আভ্যন্তরীণ বিষয়ে সংস্কার করে ও চেকোশ্লোভাকিয়া ও রুমানিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। চেকোশ্লোভাকিয়া ও রুমানিয়া সেই সময় হাঙ্গেরীর কিছু অংশ দখল করে নিচ্ছিল। তবে এই সরকার ভূমি সংস্কার না করায় কৃষকদের সমর্থন হারাল। তারা শ্রমিকদের সংগঠনের উপর নির্ভর না করে সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে ১৩৩ দিনের মাথায় তাদের অপসারণ করে এ্যাডমিরাল হাের্থি একনায়কের শাসন শুরু করে। অষ্ট্ৰীয়ায় সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটরা বিপ্লবের পক্ষে কথা বলছিল। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে আগ্রহী ছিল না। ভিয়েনার শ্রমিক অভ্যুত্থান দমন করতে তারা ভূমিকা রেখেছিল এবং পুঁজিবাদ টিকিয়ে রাখল। ২৭

বিপ্লবের ঢেউ শুধু পরাজিত রাষ্ট্রগুলিতে সাড়া তুলছিল তা নয়। বিজিত দেশগুলিতেও এর প্রভাব পড়েছিল। তবে কম মাত্রায়। বৃটিশ ও ফরাসী সৈন্যবাহিনীর যেসব অংশের সৈনিকদের ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমান রাখা হয়েছিল তাদের মধ্যে বিদ্রোহ হয়। সােভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠান বৃটিশ, ফরাসী ও আমেরিকার সৈন্যরাও কয়েক জায়গায় যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। বৃটেনে ইঞ্জিনিয়ারিং শ্রমিকদের ধর্মঘট হয় গ্লাসগাে ও বেলফাস্টে। লিভারপুল ও লন্ডনে পুলিশ ধর্মঘট হয়। রেলওয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘটের জন্য নয়দিন রেলপথ বন্ধ থাকে। স্পেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি।

কিন্তু দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির জন্য ১৯১৭ সালে পর থেকে বড় আকারের শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিল। দক্ষিণ স্পেনে ১৯১৮১৯২০ সালে পর্যন্ত সময়কে “তিনটি বলশেভিক বছর” বলা হয়। এই অঞ্চলে বৃহদাকার খামারগুলির কৃষিশ্রমিকেরা খামার দখল করে “বলশেভিক” ধরনের শাসন ব্যবস্থা কয়েকটি শহরে স্থাপন করল। এই বিদ্রোহ দমন করতে ২০০০০ সৈন্য পাঠাতে হয়েছিল। উত্তর স্পেনেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। ভ্যালেন্সিয়ায় ধর্মঘটের সময় শ্রমিকেরা শহরের রাস্তার নাম পরিবর্তন করে “লেনিন”, “সােভিয়েত” ইত্যাদি নাম দিল। কাটালােনিয়ায় ১৯১৯ সালের শুরুতে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট হয়েছিল। সৈন্য পাঠিয়েও দমন করা যাচ্ছিল না। ভাড়াটে গুন্ডাদের দিয়ে মালিকপক্ষ শ্রমিক নেতাদের গুপ্তহত্যা করে ও নেতৃত্বে ভাঙ্গন ধরিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ইউরােপব্যাপী বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল ১৯২০ সালে। অভ্যুত্থানের পরিণতি নির্ধারিত হয়েছিল জার্মানী ও ইতালির সংগ্রামে। জার্মানীতে আঞ্চলিক অভ্যুত্থানগুলিতে শ্রমিকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়-প্রায় বিশ হাজার শ্রমিক মারা যায় বলে হিসাব করা হয়। ১৩ই মার্চ সৈন্যরা বার্লিনে সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট সরকারকে উৎখাত করে। সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটদের শাসকশ্রেণী আর প্রয়ােজনীয় মনে করছিল না। আর সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটদের তৈরী ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনী তখন তাদের উপরই আক্রমণ শুরু করল।

সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটরা অতীতে জেনারেলদের সহযােগিতায় শাসন করেছিল। কিন্তু শ্রমিক সংগঠনগুলাে যৌথভাবে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াল। অনেক স্থানে তারা যে শুধু ধর্মঘটই করেছিল তাই নয়, তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তুলল। অনেক শ্রমিকই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীতে ছিল। কাজেই তাদের অভিজ্ঞতা ছিল। জার্মানীর সবচাইতে শিল্প সমৃদ্ধ Ruhr অঞ্চলে হাজার হাজার শ্রমিক লালফৌজ গঠন করে সেনাবাহিনী হটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটদের সহযােগিতায় এই বিদ্রোহ দমন করা হয়।

ইতালিতে ১৯১৯ ও ১৯২০ সাল “লাল বৎসর” অ্যাখ্যা পেয়েছে। শ্রমিক ধর্মঘট ব্যাপক আকারে দেখা দিল ও শ্রমিকেরা সংগঠিত হতে লাগল। তুরিনে ধাতব শিল্পের শ্রমিক আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু ১৯২০ সালের আগস্ট মাসে মিলানে ইঞ্জিনিয়ারিং শ্রমিকরা কারখানা দখল করে নিল। কয়েকদিনের মধ্যে সারা ইতালীতে প্রায় সব ধাতব শিল্প ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের শ্রমিকেরা একইভাবে কারখানা দখল করল। সােয়া চার লক্ষ শ্রমিক এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। তারা কারখানায় অস্ত্র তৈরী করে মজুদ করা শুরু করল। অন্যান্য শিল্পের এক লক্ষ শ্রমিক এদের সঙ্গে যােগ দিল। দক্ষিণ ইতালীতে যুদ্ধফেরত কৃষকেরা জমিদারদের জমি দখল করে ভাগ করে নেওয়া শুরু করল। সরকার এই সময় প্রায় অচল ছিল। কিন্তু শ্রমিক প্রতিনিধিদের বৈঠকে সামান্য ভােটের ব্যবধানে সিদ্ধান্ত হল বিপ্লব নয়, মালিকপক্ষের সঙ্গে আলােচনা। ধাতব শিল্পের শ্রমিকরা যারা ছিল এই অভ্যুত্থানের চালিকাশক্তি, তারা এই সিদ্ধান্তে হতাশ হল ও মনােবল হারিয়ে ফেলল । তারা বিপ্লবের জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সামান্য বেতন বৃদ্ধি ও সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই পেল না।

পশ্চিম ইউরােপে বিপ্লব রাশিয়ার বলশেভিকরা মনে করেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরােপে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে। অনেকে মনে করেন এই সম্ভাবনা মােটেই ছিল না। তবে জার্মানীর সবচাইতে শিল্প সমৃদ্ধ এলাকা Ruhr এ লাল বাহিনী গঠন ও ইতালীর শ্রমিকদের সমস্ত কলকারখানা দখল এই মতের বিপক্ষে যায়। ১৯২০ সালে পশ্চিম ইউরােপের একটা ব্যাপক এলাকার শ্রমিক শ্রেণী, যারা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে মানুষ হয়েছে এবং এই ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে জীবন যাপন করছিলতারা সংগ্রাম শুরু করল। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তাদের বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ হল এবং তারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবের দিকে ঝুঁকে পড়ল। ১৯২০ সালে পশ্চিম ইউরােপে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হতে পারত। রাশিয়ার মত এই বিপ্লব এই | দেশগুলিতে কেন হল না তা নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ আছে। এর একটা কারণ রাশিয়া ও পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলির মধ্যে বাস্তব অবস্থার পার্থক্য। বেশীরভাগ পশ্চিম ইউরােপীয় দেশে পুঁজিবাদ রাশিয়ার চাইতে অনেক বেশী সময় ধরে গড়ে উঠেছিল-যার ফলে সমাজে বিভিন্ন কাঠামাে গড়ে উঠেছিল এবং জনসাধারণকে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল। এছাড়া পশ্চিম ইউরােপের কৃষকদের কোন কোন দেশে জমি দেওয়া হয়েছিল (যেমন ফ্রান্স ও দক্ষিণ জার্মানী) এবং কোন কোন দেশে তাদের সংখ্যা এত কমে গিয়েছিল যে (যেমন বৃটেনে) তারা বিদ্যমান সমাজকাঠামাে পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট

শক্তি ধারণ করত না। রাশিয়াতে একটা বিরাট কৃষক শ্রেণী ছিল যাদের জমি ছিল না। এছাড়া পশ্চিম ইউরােপের বেশীরভাগ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র রাশিয়ার চাইতে বেশী শক্তিশালী ছিল যা যুদ্ধের ফলেও পুরােপুরি ভেঙ্গে পড়েনি।

তবে শুধুমাত্র এই উপাদানগুলি বিপ্লব ও তার পরিণতি বিশ্লেষণ এর জন্য যথেষ্ট মনে হয় না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমাজ পরিবর্তনের চেতনা ধারণ করে বিপ্লবী কর্মসূচীতে নেমে পড়েছিল। কোন কোন বিশ্লেষকের মতে এটি যথেষ্ট ছিল না। বিপ্লবী আন্দোলনে সংগঠন দরকার হয় যে সংগঠন এমন মানুষদের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, যারা পরিবর্তন আনতে বদ্ধপরিকর এবং যারা পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়া জানে। এ ধরনের সংগঠন ইংল্যান্ডে বুর্জোয়া বিপ্লবের সময় দেখা গেছে নিউ মডেল সামরিক বাহিনীর মধ্যে ও ফরাসী বিপ্লবের সময় রবসপিয়ার এর জাকোবিনদের মধ্যে। পশ্চিম ইউরােপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কালে জার্মানী ও ইতালীতে ক্রান্তিকালে এমন সংগঠন ও নেতৃত্ব ছিল না।

ইউরােপের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ১৮৭১ সাল থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত, যখন সামাজিক পরিস্থিতি ছিল শান্ত। সাধারণ মানুষ সমাজে শ্ৰেণী বৈষম্য লক্ষ্য করে বঞ্চনা অনুভব করত, আর এর থেকেই সমাজ পরিবর্তনের মতবাদ অনেকেই সমর্থন করত। কিন্তু এই সমর্থন বেশির ভাগই সক্রিয় ছিল না। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল যেমন, শ্রমিক সংগঠন, সমাজসেবী কল্যাণ সংস্থা, সমবায়ী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। এই সংগঠনগুলি বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার বিরােধী হলেও এই সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই কাজ করত। এই কর্মধারায় আন্দোলনের নেতৃত্ব অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। শাসকশ্রেণীও তাদের সীমিত পরিসরের কাজকর্ম মেনে নিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের আগের বছরগুলিতে যে বড় আকারের শ্রমিক ধর্মঘট হয়েছিল তাতে বিপ্লবী স্রোতধারা সৃষ্টি হল এবং এই বিদ্যমান ভারসাম্যকে নাড়া দিয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালে এই স্রোতধারা আরও বেগবান হয়েছিল। যুদ্ধের শেষে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের তিনটি ধারা দেখা গেল।

প্রথম ধারাটি হল প্রচলিত আপােষপন্থী ধারা যারা বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় সংস্কার করে বৈষম্য নিরসনের পক্ষপাতী ছিল। এরা সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধের সমর্থক ছিল। দ্বিতীয় ধারায় ছিল সংখ্যায় কম সমাজ পরিবর্তনের পক্ষের মানুষ। যারা যুদ্ধকে পুঁজিবাদী শােষণ ব্যবস্থার পরিণতি হিসাবে চিহ্নিত করেছিল এবং বিপ্লবকেই এর থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তৃতীয় ধারা ছিল বিরাট সংখ্যক মানুষ যারা মধ্যপন্থী নামে পরিচিত। জার্মানীতে এরা “স্বতন্ত্র সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট” হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এরা সমাজতন্ত্র ও বিপ্লবের বক্তব্য দিলেও কর্মকান্ডে ছিল সংস্কারপন্থী। যুদ্ধের সময় এই মধ্যপন্থী সমাজতন্ত্রীরা ব্যাপক আন্দোলনের বিরােধিতা করে, যুদ্ধরত পক্ষগুলির আলােচনার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ করার পক্ষপাতি ছিল। যুদ্ধ শেষে এদের নেতৃত্ব সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জন করার কথা বললেও প্রথাগত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবী আদায়ের চেষ্টার পথ অনুসরণ করতেন। জার্মানীর স্বতন্ত্র সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট দল শ্রমিকদের আন্দোলন চরম আকার ধারণ করলে বারে বারেই আলােচনার মাধ্যমে সমঝােতার প্রস্তাব দিয়ে আন্দোলনের ধারা বদলে দেন, যা পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণীর পক্ষেই কাজ করেছিল। এ সত্ত্বেও স্বতন্ত্রদের দলে সুপরিচিত সংসদীয় নেতা থাকার জন্য আর তাদের বিপ্লবী বাগাড়ম্বরের কারণে একটা বড় অংশকে তাদের অনুসারী করতে পেরেছিল। ইতালির সােশ্যালিষ্ট দলের চরিত্রও ছিল একই রকমের। এই দলও ইতালির শ্রমিকদের বিপ্লবী আন্দোলনের যথাযথ নেতৃত্ব দেয়নি। পিয়েত্রো নেনি (Pietro Nenni) যিনি পরবতী ৬০ বৎসর যাবৎ সােশ্যালিষ্টদলের একজন অন্যতম নেতা ছিলেন, বলেন “যদিও দল তাত্ত্বিকভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র অস্বীকার করত কিন্তু বাস্তবে দল ছিল সংসদীয় আন্দোলন ও নির্বাচনের জন্য”।

রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব পশ্চিম ইউরােপীয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ডান ও মধ্যপন্থী অংশের এই দুর্বলতা গুলাে দেখে দেশগুলিতে নতুন কমিউনিষ্ট দল গঠন করে তাদের সমন্বয়ের জন্য কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিক তৈরী করার আহবান জানিয়েছিলেন। যুদ্ধের পর ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে প্রথম আন্তর্জাতিক এর সভা হয়। এই সভায় প্রতিনিধিদের উপস্থিতি কম হয়েছিল। ১৯২০ সালের জুলাই ও আগস্টে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে প্রতিনিধিদের উপস্থিতি যথেষ্ট ছিল বলে মনে করা হয়। শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষে যে জোয়ার সেই সময়ে এসেছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায় পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলির বড় বড় সমাজতান্ত্রিক দলগুলাের এই আন্তর্জাতিকে প্রতিনিধি পাঠনােতে। আন্তর্জাতিকের কংগ্রেসে সমাজতান্ত্রিক দলগুলাের বিপ্লবী চরিত্র নিশ্চিত করার জন্য কর্মকান্ড ও নেতৃত্বের কিছু পরিবর্তন করার জন্য শর্ত দেওয়া হয়। এতে যে সব দল প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। জার্মানীর স্বতন্ত্র সােশ্যাল

ডেমােক্র্যাট দল ও ফ্রান্সের সােশ্যালিস্ট দলের বড় অংশই এই নীতিমালা মেনে নিয়ে নতুন ধরনের কমিউনিষ্ট দল গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ততদিনে জার্মানী ও ইতালির জনগণের সংগ্রামের পরিণতি নির্ধারিত হয়ে গেছিল।

১৯২৩ সালে ফ্রান্সের সৈন্যরা জার্মানীর শিল্পসমৃদ্ধ Ruhr অঞ্চল দখল করে। জার্মানীতে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি হয়। রক্ষণশীল দলীয় সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ ধর্মঘট হয়। Thuringia ও Saxony নামে দুইটি রাজ্যে কমিউনিষ্টরা সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটদের সঙ্গে মিলে শ্রমিক সরকার গঠন করে আন্দোলন সমস্ত জার্মানীতে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এরপর তারা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা বাতিল করে যদিও শ্রমিকদের অধিকাংশ এর পক্ষে ছিল।৩ যে সমস্ত সংস্কারপন্থী সমাজতন্ত্রীরা বিপ্লবের বিপক্ষে অবস্থান নিল তাদের ধারণা ছিল অভ্যুত্থান বিফল হবার পর পুঁজিবাদী গণতন্ত্র আবার ফিরে আসবে। পরবর্তী ঘটনাবলী প্রমাণ করে তাদের ধারণা ভুল ছিল।

তথ্যসূত্র

. Harman C. A People’s History of the World. London, 2008 p 383 ২. Harman C. p 387 V. Bernstein E. Evolutionary Socialism. London, 1909 p 159 8. Harman C. p 392 C. Luxemburg R. Social Reform or Social Revolution. Colombo, 1996 y Vandervort B. Wars of Imperial Conquest 1830-1914. London, 1998 p 27 9. Packenham T. The Scramble for Africa. London, 1992 p 546 b. Packenham T. p 562 ৯. Packenham T. p 600 so. Derfler L. Paul Lafargue and the Flowering of French Revolution. Harvard, 1998 p 48 ss. Harman C. p 401 ১২. Harman C. p 402 ১৩. Harman C. p 404-405 । 38. Serge V. Memoirs of a Revolutionary. London, 1963 p 47 se. Shlyapnikov A. On the Eve of 1917. London, 1982 p 18 sy. Roberts JM. A Short History of the World. New York, 1993 p 431 19. Cameron R. A Concise Economic History of the World. New York, 1997 p 346 36. Blackbourne D. The Fortuna History of Germany. 1780- 1918. London, 1977 p 475 Jd. MacIntyre D. The Great War,Courses and Consequences. Glasgow, 1979 p 63 ২০. Blackbourne D. p 488 ২১. Harman C. p 409 83. http://libcom.org/history/1915-the Glasgow-rent strike.accessed 08 march 2013 10. Allison W and Fairley J. The Monocled Mutineer. London, 1984 p 81-111 ২৪. Harman C. p 432 16. Hobsbawm E. The Age of Extremes. London, 1994 p 68 fy. Quoted in Carr EH. The Bolshevik Revolution-vol-3. Harmondsworth, 1966 p 135 ২৭. Harman C. p 435 ২৮. Carr EH. p 134

. Meaker EH. The Revolutionary Left in Spain 1914-1923. Stamford, 1974 p 142 vo. Spriano P. The Occupation of Factories, Italy1920. London, 1975 p 21,60 ৩১. Harman C. p 440 ৩২. Spriano P. p 129 yo. Harman C. The Lost of Revolution: Germany 1918 to 1923. London, 1982 p 272

 

 

মুক্ত কর হে বন্ধ- ষষ্ঠ অধ্যায় (শিল্প বিপ্লব)

You may also like...