স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা – দ্বিতীয় খণ্ড (সমালোচনামূলক লেখা)

“বেদ যাঁহাদের হৃদয়নিঃসৃত, তাঁহাদের চিন্তাশক্তি মূলতত্ত্বের অনুধাবন ও আবিষ্কারেই অভিনিবিষ্ট ছিল। তাঁহারা যেন এই-সকল তত্ত্বের বিস্তারিত অনুশীলন করিবার অবসর পান নাই এবং সেজন্য অপেক্ষাও করেন নাই। তাঁহারা বস্তুর গভীরতম প্রদেশে উপনীত হইতে ব্যগ্র ছিলেন। এই জগতের অতীত কিছু যেন তাঁহাদিগকে আকর্ষণ করিতেছিল, তাঁহারা যেন আর অপেক্ষা করিতে পারিতেছিলেন না। বস্তুতঃ উপনিষদের মধ্যে ইতস্ততোবিক্ষিপ্ত, আধুনিক বিজ্ঞানে আলোচিত বিশেষ সিদ্ধান্তগুলি অনেক সময়ে ভ্রমাত্মক হইলেও উহাদের মূলতত্ত্বগুলির সহিত বিজ্ঞানের মূলতত্ত্বের কোন প্রভেদ নাই।” (পৃষ্ঠা ২)

“খ্রীষ্টজন্মের বহু পূর্বেই ক্রমবিকাশবাদ বেদে স্থান পাইয়াছে, কিন্তু ডারুইন এই মতবাদটি সত্য বলিয়া স্বীকার না করা পর্যন্ত, ইহা হিন্দুদিগের একটি কুসংস্কাররূপে পরিগণিত হইত।” (পৃষ্ঠা ৩২৭)

“আর সর্বশাস্ত্রেই যে-সকল অলৌকিক ব্যাপারের উল্লেখ আছে, এই যোগীরা সেইগুলি বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন। প্রশ্ন এইঃ প্রত্যেক জাতির ভিতর এই-সব অলৌকিক কার্যের বিবরণ প্রবেশ করিল কিরূপে? যে বলে—এ সমুদয় মিথ্যা, এগুলির ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নাই, তাহাকে যুক্তিবাদী বা বিচারপরায়ণ বলিতে পারা যায় না।” (পৃষ্ঠা ৩৫৫)

মতামত: ধার্মিকদের এরূপ অবান্তর ধারণার বিরুদ্ধেই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা লিখেছিলেন “সবই ব্যাদে আছে”। এই ধর্মযাজকগণ তাঁদের এরূপ বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণের জন্য কোনোদিনই কোনো প্রমাণ, সাক্ষ্য বা দলিলের ধার ধারেন না। 

২) “এই প্রসঙ্গে আপনাদের মধ্যে কাহারও কাহারও হয়তো জানিয়া আনন্দ হইতে পারে যে, আধুনিক ইওরোপীয় বৈজ্ঞানিকদিগের মতানুযায়ী এই পৃথিবীতে যেভাবে জীব-সৃষ্টি হইল, তাহা বৈদিকদর্শনেও পাওয়া যায়। আপনারা সকলেই নিশ্চয় জানেন যে, জীব অন্য গ্রহাদি হইতে পৃথিবীতে আসিয়াছে—এইরূপ একটি মত প্রচলিত আছে। জীব চন্দ্রলোক হইতে পৃথিবীতে আসে—কোন কোন বৈদিক দার্শনিকের ইহাই স্থির বিশ্বাস।” (পৃষ্ঠা ২)

মতামত: পৃথিবীতে জীব চাঁদ বা অন্য গ্রহ থেকে এসেছে, এমন কোনো মত বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে পারেননি কিন্তু তাতে ধর্মের ঠিকাদারদের কীই বা যায় আসে?

৩) “ভারতীয় নারীগণের বাধ্যতামূলক বৈধব্যজনিত দুঃখ প্রতিকারের জন্য আমাদের সংস্কারকগণ প্রচার করিতেছেন। পাশ্চাত্যে বিবাহের পাত্র পাওয়া যায় না, ইহাই বি‎ষম সমস্যা। একস্থানে কুমারীদের সাহায্য করিতে হইবে, তাহারা দু্ঃখ পাইতেছে; অন্যস্থানে বিধবাদের সাহায্য করিতে হইবে, তাহারা কষ্ট পাইতেছে। দেহের পুরাতন বাতব্যাধির মত মাথা হইতে তাড়িত হইয়া ইহা শরীরের অন্য স্থান আশ্রয় করিতেছে; আবার সেখান হইতে পাদদেশ আক্রমণ করিতেছে। সংস্কারক আসিয়া সাধারণের মধ্যে প্রচার করিলেন—বিদ্যা ধন সংস্কৃতি কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিবে না, তাঁহারা এগুলি সকলের আয়ত্তের মধ্যে আনিবার চেষ্টা করিলেন। ইহাতে কেহ কেহ এক হিসাবে কতকটা সুখী হইল বটে, কিন্তু সংস্কৃতি যতই বাড়িতে লাগিল, শারীরিক সুখ হয়তো ততই কমিতে লাগিল। সুখের জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে দুঃখের জ্ঞানও আসিতেছে! কোন্ পথে যাইব? আমরা যে সামান্য সুখ ভোগ করিতেছি, তাহাই হয়তো অন্য কোথাও সমপরিমাণ দুঃখ উৎপন্ন করিতেছে। ইহাই নিয়ম। যুবকেরা হয়তো ইহা স্পষ্ট বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু যাঁহারা দীর্ঘদিন জীবিত আছেন, অনেক যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছেন, তাঁহারা ইহা উপলব্ধি করিতে পারিবেন। ইহাই মায়া।” (পৃষ্ঠা ৬)

মতামত: ১৯০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতবর্ষে প্রতি পুরুষ ও নারীর অনুপাত ১০০০:৯৭২, উনি যেটাকে পাশ্চাত্যের সমস্যা বলে আখ্যা দিলেন, সেটা প্রাচ্যেরও সমস্যা ছিল।

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন বিধবা বিবাহ সংস্কারের বিরোধী তাই তিনি তাঁর এই বক্তব্যে অবান্তর কিছু উদাহরণ ব্যবহার করে পরিশেষে “মায়া” নামক একটি অশ্বডিম্ব প্রসব করলেন। 

৪) “সকল সমাজেই অহরহঃ দেখা যাইতেছে—মূর্খ সাধারণ মানুষ তিরস্কৃত হইলে বেশী দুঃখ অনুভব করে না, কিন্তু প্রহারের আতিশয্য হইলে ক্লিষ্ট হইয়া থাকে। শিক্ষিত ভদ্রলোক কিন্তু একটি কথার তিরস্কারও সহ্য করিতে পারেন না, তাঁহার স্নায়ুমণ্ডল এত সূক্ষ্ম হইয়াছে! তাঁহার সুখানুভূতি সহজ হইয়াছে বলিয়া তাঁহার দুঃখও বাড়িয়াছে। দার্শনিক পণ্ডিতগণের—ক্রমবিকাশবাদীদের মতটি ইহার দ্বারা বিশেষ প্রমাণিত হয় না।” (পৃষ্ঠা ৮) 

মতামত: উপরের উদাহরণের সাথে ক্রমবিকাশবাদ বা ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়াকেই বলে কাঁঠালের আমসত্ত্ব।

৫) “এ-কথাও আমি অস্বীকার করিতে পারি না যে, বাল্যবিবাহ হিন্দুজাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করিয়াছে।” (পৃষ্ঠা ১১)

মতামত: বাল্যবিবাহ নামক একটি অতি প্রাচীন, বর্বর, অমানবিক প্রথাকে নির্লজ্জ সমর্থন। 

৬) “যখন যৌন অপবিত্রতা কোন জাতির মধ্যে প্রবেশ করে, তখনই বুঝিতে হইবে উহার বিনাশ আসন্ন। এই-সকল দুঃখজনক সমস্যার মীমাংসা কোথায়? যদি পিতা-মাতা নিজ সন্তানের জন্য পাত্র বা পাত্রী নির্বাচন করেন, তাহা হইলে এই দোষ অনেকটা নিবারিত হয়। ভারতের কন্যাগণ যতটা ভাবপ্রবণ তদপেক্ষা অধিক বাস্তববাদী, কিন্তু তাহাদের জীবনে কবিত্বের বিশেষ অবকাশ থাকে না। আবার যদি লোকে নিজেরাই স্বামী ও স্ত্রী নির্বাচন করে, তাহাতেও অধিক সুখ হয় না।” (পৃষ্ঠা ১২)

মতামত: মনুবাদী মতের সমর্থন। 

মনু সংহিতার ৯/৩ শ্লোকে আমরা দেখতে পাই – বিবাহের পূর্ব্বে কন্যাবস্থায় স্ত্রীলোককে পিতা রক্ষা করিবেন, বিবাহিতা স্ত্রীকে যৌবনাবস্থায় ভর্ত্তা রক্ষা করিবেন, বৃদ্ধাবস্থায় পুত্রেরা রক্ষা করিবে, পতি-পুত্র-বিহীনা স্ত্রীকেও সন্নিহিত পিত্রাদিরা রক্ষা করিবে, কোন অবস্থায় স্ত্রীলোক স্বাধীন থাকিবে না। (মনুসংহিতা, সম্পাদনা ও অনুবাদ ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭৫৬)  

৭) “‘অমুক ঋষি বা মহাপুরুষ বলিয়াছেন, অতএব ইহা বিশ্বাস কর’—এইরূপ বলাতে যদি ধর্মগুলি উপহাসের যোগ্য হয়, তবে আধুনিকগণ অধিকতর উপহাসের পাত্র। এখনকার কালে যদি কেহ মুশা, বুদ্ধ বা ঈশার উক্তি উদ্ধৃত করে, সে হাস্যাস্পদ হয়; কিন্তু হাক্সলি, টিণ্ডাল বা ডারুইনের নাম করিলেই লোকে সে কথা একেবারে নির্বিচারে গলাধঃকরণ করে।”  (পৃষ্ঠা ১৯)

মতামত: অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধর্মপ্রবক্তাদের মতোই ডারউইনের বিবর্তনবাদ মানতে নারাজ স্বামী বিবেকানন্দ অথচ বর্তমানে প্রায় ৯৭ শতাংশ বিজ্ঞানী ডারউইনের বিবর্তনবাদকে মান্যতা দিয়েছেন। বাস্তবে সকল ধর্মব্যবসায়ীরা বিজ্ঞানের পরীক্ষিত সত্যকে মানতে নারাজ।

https://www.pewresearch.org/politics/2009/07/09/section-5-evolution-climate-change-and-other-issues/

৮) “আগে ছিল ধর্মের কুসংস্কার, এখন হইয়াছে বিজ্ঞানের কুসংস্কার; আগেকার কুসংস্কারের ভিতর দিয়া জীবনপ্রদ আধ্যাত্মিক ভাব আসিত; আধুনিক কুসংস্কারের ভিতর দিয়া কেবল কাম ও লোভ আসিতেছে।” (পৃষ্ঠা ১৯)

মতামত: অন্যান্য ধর্মযাজকগণের মতোই স্বামীজী তাঁর বক্তব্যে সত্যতা প্রমাণের জন্য কোনো প্রমাণ, সাক্ষ্য বা দলিলের ধার ধারলেন না।

https://www.shongshoy.com/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AF%E0%A7%8C%E0%A6%A8%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8/

৯) “ক্রমবিকাশবাদী পণ্ডিতগণ মনে করেন, তাঁহারা যেন এই সিদ্ধান্ত একেবারে খণ্ডন করিয়াছেন। তাঁহাদের মতে মানুষ ক্ষুদ্র মাংসল প্রাণী-বিশেষের (mollusc) ক্রমবিকাশমাত্র, অতএব পূর্বোক্ত পৌরাণিক সিদ্ধান্ত সত্য হইতে পারে না। ভারতীয় পুরাণ কিন্তু উভয় মতেরই সমন্বয় করিতে সমর্থ।” (পৃষ্ঠা ১৯)

মতামত: কেবলমাত্র “উপনিষদ” নামক একটি ধার্মিক বইয়ের বিভিন্ন গাঁজাখুরি গপ্পোকথার ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানের ওপর ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সচেষ্ট স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ।

১০) “পরীক্ষা দ্বারা বরং ইহা প্রদর্শন করা সম্ভব—যাহাকে আমরা জড় বলি, তাহার অস্তিত্ব নাই, উহা কেবল শক্তির এক বিশেষ অবস্থামাত্র।” (পৃষ্ঠা ২০)

মতামত: কোন পরীক্ষা দ্বারা জড় পদার্থ অস্তিত্ববিহীন প্রমাণ করা যায়? স্বামীজীর কাছে উত্তর আশা করাও বৃথা কারণ উনি অন্যসব ধর্মের ঠিকাদারদের মতোই কোনোদিনই কোনো প্রমাণ, সাক্ষ্য বা দলিলের ধার ধারেননি।  

১১) “যদি আজ মনুষ্যজাতির খুব সামান্য অংশও স্বার্থপরতা সঙ্কীর্ণতা ক্ষুদ্রত্ব ত্যাগ করিতে পারে তবে কালই এই জগৎ স্বর্গে পরিণত হইবে—নানাবিধ যন্ত্রপাতি এবং বাহ্য-জগৎ-সম্বন্ধীয় জ্ঞানের উন্নতিতে তাহা কখনও হইবে না। যেমন অগ্নিতে ঘৃত নিক্ষেপ করিলে অগ্নিশিখা আরও বর্ধিত হয়, তেমনি এগুলি দুঃখই বৃদ্ধি করে। আত্মজ্ঞান ব্যতীত যাবতীয় জড়ের জ্ঞান অগ্নিতে ঘৃতাহুতি মাত্র। জড়বিজ্ঞান—স্বার্থপর লোকের হাতে পরস্ব কাড়িয়া লইবার এবং পরার্থে জীবন উৎসর্গ না করিয়া অপরকে শোষণ করিবার আর একটি যন্ত্র তুলিয়া দেয় মাত্র।” (পৃষ্ঠা ২৭)

মতামত: বিজ্ঞান শিক্ষা বা বিজ্ঞান সচেতন মনন গড়ে তোলার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি স্বামীজীর।

১২) “যাঁহারা সকামভাবে সৎকার্য করেন, তাঁহারা মৃত্যুর পর চন্দ্রলোকে গমন করেন। এখানে নানাবিধ স্বর্গ আছে। তাঁহারা এখানে সূক্ষ্ম- শরীর—দেবশরীর লাভ করেন। তাঁহারা দেবতা হইয়া এখানে বাস করেন ও দীর্ঘকাল ধরিয়া স্বর্গসুখ উপভোগ করেন। এই ভোগের অবসানে আবার তাঁহাদের পুরাতন কর্ম বলবান হয়, সুতরাং পুনরায় তাঁহাদের মর্ত্যলোকে জন্ম হয়। তাঁহারা বায়ুলোক, মেঘলোক প্রভৃতি লোকের ভিতর দিয়া আসিয়া অবশেষে বৃষ্টিধারার সহিত পৃথিবীতে পতিত হন। বৃষ্টির সহিত পতিত হইয়া তাঁহারা কোন শস্যকে আশ্রয় করিয়া থাকেন। তৎপরে সেই শস্য কোন ব্যক্তি ভোজন করিলে তাহার ঔরসে সেই জীবাত্মা পুনরায় দেহ পরিগ্রহ করে।” (পৃষ্ঠা ৩৫)

মতামত: ইহা দ্বৈতবাদীদের মত; তথাপি স্বামীজী বুঝতে পারছেন না যে ধর্মগুলি কেন উপহাসের যোগ্য হয়ে উঠেছে! (দেখুন – ৭)

১৩) “বেদান্তদর্শনের মতে মানুষই জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী আর এই পৃথিবীই সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান, কারণ এইখানেই মুক্ত হইবার সম্ভাবনা। দেবতা প্রভৃতিকেও মুক্ত হইতে হইলে মানবজন্ম গ্রহণ করিতে হইবে। এই মানবজন্মেই মুক্তির সর্বাপেক্ষা অধিক সুবিধা।” (পৃষ্ঠা ৩৬)

মতামত: অন্য কোন গ্রহে প্রাণ আছে কিনা সে নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছেন, তাঁরা আজও  কোনও চূড়ান্ত ফলাফলে পৌঁছাতে পারেননি কিন্তু স্বামীজী ও তাঁর মতো অন্য বাবাজীরা কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষার পরোয়া না করেই বাতলে দিলেন – পৃথিবী থেকেই মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা, আসলে ওঁরা তো পৃথিবীতেই পসার জমাতে এসেছেন, বিশেষ করে ভারতবর্ষে।

১৪) “বাস্তবিক নিজের মস্তিষ্ক তো কেহ কখনও দেখে নাই।” (পৃষ্ঠা ৫৪)

মতামত: বর্তমানে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কারের ফলে ইহাও সম্ভব হয়েছে।

১৫) “আমরা ধর্মবিষয়ে স্বাধীনতা দিয়াছিলাম, তাহার ফলস্বরূপ এখনও আমরা ধর্মজগতে মহাশক্তির অধিকারী। তোমরা সামাজিক বিষয়ে সেই স্বাধীনতা দিয়াছ, তাহার ফলে তোমাদের অতি সুন্দর সামাজিক প্রণালী। আমরা সামাজিক উন্নতি-বিষয়ে কিছু স্বাধীনতা দিই নাই, তাই আমাদের সমাজ সঙ্কীর্ণ। তোমরা ধর্ম সম্বন্ধে স্বাধীনতা দাও নাই, ধর্ম-বিষয়ে প্রচলিত মতের ব্যতিক্রম করিলেই অমনি বন্দুক, তরবারি বাহির হইত! তাহার ফল—ইওরোপে ধর্মভাব সঙ্কীর্ণ।” (পৃষ্ঠা ৫৭)

মতামত: সর্বৈব মিথ্যা কথা। রামায়ণে মর্যাদাপুরুষোত্তম রাজা রাম বেদ অধ্যয়ন করার অপরাধে এক নিচু জাতের বালক, শম্বুককে হত্যা করেন। দক্ষিণ ভারতে শিব ও বিষ্ণু ভক্তদের মধ্যেও প্রচুর দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল। তাই, এই বক্তব্য পুরোপুরি ভ্রান্ত।

https://www.deccanchronicle.com/nation/in-other-news/170416/where-shiva-vishnu-bhakts-clashed.html

১৬) “বেদান্তের আলোকে তোমরা বুঝিবে—সব বিজ্ঞান কেবল ধর্মেরই বিভিন্ন বিকাশ মাত্র, জগতের আর সব জিনিষও ঐরূপ।” (পৃষ্ঠা ৫৭)

মতামত: আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন : ‘বিশ্বাস’ আর যা-ই দিক, বিজ্ঞান দিতে পারে না।

১৭) “সকল সমাজেই দুইটি বিভিন্ন দল দেখিতে পাওয়া যায়। একদল জড়বাদী, বিরুদ্ধবাদী, আর একদল নিশ্চিতবাদী সংগঠনকারী। মনে কর—সমাজে কোন দোষ আছে, অমনি একদল উঠিয়া গালাগালি করিতে আরম্ভ করিল। ইহারা অনেক সময় গোঁড়া হইয়া দাঁড়ায়। সকল সমাজেই ইহাদিগকে দেখিতে পাইবে; আর মেয়েরা প্রায়ই এই চীৎকারে যোগ দিয়া থাকেন, কারণ তাঁহারা স্বভাবতই ভাবপ্রবণ।” (পৃষ্ঠা ৫৭)

মতামত: সকল সমাজে মেয়েদের বিরুদ্ধবাদী, জড়বাদীদের সাথে যোগ দেওয়ার কারণ প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ পুরুষদের দ্বারা রচিত আর কোনো সংগঠিত ধর্মই নারীদের পূর্ণমানবের সন্মান দেয় না। 

১৮) “সাদা কথায় ইহার অর্থ এই, দিবারাত্র ভণ্ডামি, মিথ্যাচার ও প্রতারণার জীবন যাপন কর—তোমার ক্ষতগুলি যতদূর পার ঢাকিয়া রাখ। তালির উপর তালি দাও, শেষে প্রকৃত জিনিষটিই যেন নষ্ট হইয়া যায়, আর তুমি কেবল একটি জোড়াতালির সমষ্টিতে পরিণত হও। ইহাকেই বলে—সাংসারিক জীবন। যাহারা এইরূপ জোড়াতালি লইয়া সন্তুষ্ট, তাহারা কখনও ধর্মলাভ করিতে পারিবে না!” (পৃষ্ঠা ৬৪)

“সত্য জানিব অথবা এই চেষ্টায় প্রাণ দিব; কারণ সংসারের দিকে তো আর কিছু পাইবার আশা নাই, ইহা শূন্য—ইহা প্রতিদিন লয় পাইতেছে।” (পৃষ্ঠা ৬৪)

“সকল ধর্মই জগৎ হইতে বাহিরে যাইবার অর্থাৎ মুক্তির উপদেশ দিতেছে। এই সকল বিভিন্ন ধর্মের উদ্দেশ্য—সংসার ও ধর্মের মধ্যে একটা আপস করিয়া লওয়া নহে, বরং ধর্মকে নিজ আদর্শে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত করা, সংসারের সঙ্গে আপস করিয়া ঐ আদর্শকে ছোট করিয়া ফেলা নহে।” (পৃষ্ঠা ৬৫)

মতামত: স্বামীজীর বহু বক্তব্য দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। প্রথম খণ্ডে নিজেই বলেছিলেন “সংসারী অপেক্ষা সংসারত্যাগী মহত্তর, এ-কথা বলা বৃথা। সংসার হইতে স্বতন্ত্র থাকিয়া স্বাধীন সহজ জীবনযাপন অপেক্ষা সংসারে থাকিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করা অনেক কঠিন কাজ।” (পৃষ্ঠা ৪৯) 

কোনটাকে সত্যি বলে স্বীকার করব?

১৯) “অদ্বৈতবাদই একমাত্র ধর্ম, যাহা আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণের সিদ্ধান্তসমূহের সহিত ভৌতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিকেই যে শুধু মেলে তাহা নয়, বরং ঐ-সকল সিদ্ধান্ত অপেক্ষাও উচ্চতর সিদ্ধান্ত স্থাপন করে, আর এইজন্যই ইহা আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণের অন্তর এতখানি স্পর্শ করিয়াছে। তাঁহারা দেখিতেছেন, প্রাচীন দ্বৈতবাদাত্মক ধর্মসমূহ তাঁহাদের পক্ষে পর্যাপ্ত নহে, উহাতে তাঁহাদের জ্ঞানের ক্ষুধা মিটিতেছে না। কিন্তু এই অদ্বৈতবাদে তাঁহাদের জ্ঞানের ক্ষুধা মিটিতেছে। মানুষের শুধু বিশ্বাস থাকিলে চলিবে না, এমন বিশ্বাস থাকা চাই, যাহাতে তাহার জ্ঞানবৃত্তি চরিতার্থ হয়। যদি মানুষকে বলা হয়—যাহা দেখিবে, তাহাই বিশ্বাস কর, তবে শীঘ্রই তাহাকে উন্মাদাগারে যাইতে হইবে।” (পৃষ্ঠা ৭৬)

মতামত: দ্বৈতবাদকে খণ্ডন করার জন্য স্বামীজী বিজ্ঞানীদের নিজের পক্ষে টেনে নিলেন; যদিও বিজ্ঞান পরীক্ষা, নিরীক্ষা, প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত; কারো বিশ্বাসের ওপর নয়, কারো কথার ওপর নয়। 

২০) “কুসংস্কারের এমনি প্রভাব যে, যাহারা এই পুনর্জন্মবাদ অস্বীকার করে, তাহারাই আবার বিশ্বাস করে, এক সময়ে আমরা বানর ছিলাম; কিন্তু তাহাদের বানর-জন্ম কেন স্মরণ হয় না—এ বিষয়ে অনুসন্ধান করিতেও ভরসা করে না।” (পৃষ্ঠা ৯৬)

“পুনর্জন্মবাদ ব্যতীত জ্ঞান অসম্ভব। মনে কর, আমি রাস্তায় গিয়া একটা কুকুর দেখিলাম। উহাকে কুকুর বলিয়া জানিলাম কিরূপে? যখনই উহার ছাপ আমার মনের উপর পড়িল, উহার সহিত মনের ভিতরকার পূর্বসংস্কারগুলি মিলাইতে লাগিলাম। দেখিলাম—আমার যাবতীয় পূর্বসংস্কার স্তরে স্তরে সাজানো রহিয়াছে। নূতন কোন বিষয় আসিবামাত্র আমি সেটিকেই প্রাচীন সংস্কারগুলির সহিত মিলাইয়া দেখি। যখনই দেখি, সেই ভাবের আর কতকগুলি সংস্কার রহিয়াছে, অমনি আমি ঐগুলিকে সেগুলির সহিত মিলাই, তখনই আমার তৃপ্তি আসে। আমি তখন উহাকে কুকুর বলিয়া জানিতে পারি, কারণ উহা পূর্বাবস্থিত কতকগুলি সংস্কারের সহিত মেলে।” (পৃষ্ঠা ৯৭)

মতামত: পুরো বক্তব্যটাই কাঁঠালের আমসত্ত্ব।

২১) “যদিও দেখিয়াছি, পুনর্জন্মবাদ প্রমাণ করিতে হইলে তাহার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিও থাকিবে—ইহা প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন নাই, তথাপি আমরা ইহা দৃঢ়ভাবে বলিতে পারি যে, অনেকের এরূপ স্মৃতি দেখা যায়, আর তোমরাও সকলে যে-জন্মে মুক্তিলাভ করিবে, সেই জন্মে এই স্মৃতি লাভ করিবে। কেবল তখনই জানিতে পারিবে—জগৎ স্বপ্নমাত্র, তখনই অন্তরের অন্তরে বুঝিবে যে, আমরা এই জগতে অভিনেতামাত্র, আর এই জগৎ রঙ্গভূমি, তখনই প্রবলবেগে অনাসক্তির ভাব তোমাদের ভিতর আসিবে, তখনই যত কিছু ভোগতৃষ্ণা—জীবনের উপর এই তীব্র আগ্রহ—এই ‘সংসার’ চিরকালের জন্য চলিয়া যাইবে। তখন তুমি স্পষ্টই দেখিবে, তুমি জগতে কতবার আসিয়াছ, কত লক্ষ লক্ষ বার তুমি পিতা-মাতা পুত্র-কন্যা স্বামী-স্ত্রী বন্ধু ঐশ্বর্য শক্তি লইয়া কাটাইয়াছ। কতবার এই-সকল আসিয়াছে, কতবার চলিয়া গিয়াছে। কতবার তুমি সংসার-তরঙ্গের উচ্চ চূড়ায় উঠিয়াছ, আবার কতবার তুমি নৈরাশ্যের গভীর গহ্বরে নিমজ্জিত হইয়াছ। যখন স্মৃতি তোমার নিকট এইসকল আনিয়া দিবে, তখনই কেবল তুমি বীরের ন্যায় দাঁড়াইবে, এবং জগৎ তোমায় ভ্রূভঙ্গী করিলে তুমি শুধু হাসিবে। তখনই তুমি বীরের মত দাঁড়াইয়া বলিতে পারিবে—‘মৃত্যু, তোমাকেও আমি গ্রাহ্য করি না, তুমি আমাকে কি ভয় দেখাও?’ যখন তুমি জানিতে পারিবে, তোমার উপর মৃত্যুর কোন শক্তি নাই, তখনই তুমি মৃত্যুকে জয় করিতে পারিবে। আর সকলেই কালে এই অবস্থা লাভ করিবে।” (পৃষ্ঠা ৯৬)

মতামত: গল্পের গোরুকে গাছে তোলা।

২২) “আমরা আমাদের পূর্বকর্মের দ্বারা শরীর-বিশেষ আশ্রয় করিয়া থাকি, আর যে-সকল পিতা-মাতা তাঁহাদের কর্মের গুণে ঐ আত্মাকে সন্তানরূপে পাইবার উপযুক্ত হইয়াছেন, তাঁহাদের নিকট হইতেই নূতন শরীরের উপাদান সংগৃহীত হয়।” (পৃষ্ঠা ৯৯)

মতামত: স্বামীজী বর্ণিত এই প্রক্রিয়ায় পিতামাতার সহবাসের বিশেষ কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না! 

২৩) “বল, আমি যে কষ্ট ভোগ করিতেছি, তাহা আমারই কৃতকর্মের ফল। ইহা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আমার দ্বারাই এই দুঃখকষ্ট দূরীভূত হইবে।” (পৃষ্ঠা ১০২)

“লক্ষ লক্ষ প্রজার শাসক সার্বভৌম রাজা অপেক্ষা অধিকতর কর্ম-ব্যস্ত মানুষ আর কল্পনা করা যায় না, তথাপি এই রাজারা গভীর চিন্তাশীল ছিলেন।” (পৃষ্ঠা ১৬৮)

মতামত: স্বামীজীর এই ধরণের বহু বক্তব্যই তাঁর সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের খুশি করবার স্বার্থে।

২৪) “এই সঙ্গে আর একটি প্রশ্ন আসে—ভবিষ্যৎ জানা সম্ভব কিনা? আপনারা অনেকে হয়তো এমন লোক দেখিয়াছেন, যিনি কোন ব্যক্তির ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলিয়া দিতে পারেন। যদি ভবিষ্যৎ কোন নিয়মের অধীন না হয়, তবে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বলা কিরূপে সম্ভব? কিন্তু আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, অতীত ঘটনারই ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি হইয়া থাকে।” (পৃষ্ঠা ১০৬)

মতামত: অসাধারণ দক্ষতার সাথে স্বামীজী আরেকটি কুসংস্কারকে অভ্রান্ত প্রমাণ করে দিলেন!

২৫) “প্রকৃতির ভূত ও ভবিষ্যৎ গণিতের মত সঠিকভাবে বলা সম্ভব।” (পৃষ্ঠা ১০৭)

মতামত: স্বামীজী এই গণিতটা বোধ হয় ওঁর গুরুভাইদের শেখাতে ভুলে গিয়েছিলেন নয়তো প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগেই ওঁরা আমাদের সতর্ক করে দিতে পারতেন। 

২৬) “জগতে এমন অবস্থা কখনও আসিতে পারে না, যখন সবই ভাল হইয়া যাইবে, মন্দ কিছুই থাকিবে না। ইহাতে অনেকের চিরপোষিত আশা চূর্ণ হইতে পারে বটে, অনেকে ইহাতে ভয়ও পাইতে পারেন বটে, কিন্তু ইহা স্বীকার করা ব্যতীত আমি অন্য উপায় দেখিতেছি না।” (পৃষ্ঠা ১১৫)

আবার একটু আগেই তিনি নিজেই বলেছেন “যখনই আমি নিজেকে একটি ক্ষুদ্র দেহ বলিয়া মনে করি, তখনই জগতের অন্যান্য শরীরের সুখদুঃখের দিকে না চাহিয়া আমি দেহটিকে রক্ষা করিতে এবং উহার সৌন্দর্য সম্পাদন করিতে ইচ্ছা করি। তখন তুমি ও আমি ভিন্ন হইয়া যাই। যখনই এই ভেদজ্ঞান দেখা দেয়, তখনই উহা সর্বপ্রকার অমঙ্গলের দ্বার খুলিয়া দেয় এবং সর্বপ্রকার দুঃখ সৃষ্টি করে। সুতরাং পূর্বোক্ত জ্ঞানলাভে এই উপকার হইবে যে, যদি আজ মনুষ্যজাতির খুব সামান্য অংশও স্বার্থপরতা সঙ্কীর্ণতা ক্ষুদ্রত্ব ত্যাগ করিতে পারে তবে কালই এই জগৎ স্বর্গে পরিণত হইবে” (পৃষ্ঠা ২৭)

এবার তো বুঝতে পারছি না, জগতের কী হবে? ওঁর দুটো বক্তব্য তো পরস্পর বিরোধী।

২৭) “পাশ্চাত্যদিগের ন্যায় হিন্দুরাও সব হাতে-কলমে করিতে চান; তবে জীবন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী পৃথক‍্। পাশ্চাত্যগণ বলেনঃ বেশ ভাল একখানি বাড়ী কর, উত্তম খাদ্য ও পরিচ্ছদ সংগ্রহ কর, বিজ্ঞানের চর্চা কর, বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি কর। এইগুলি করিবার সময় তাঁহারা খুব কাজের লোক। কিন্তু হিন্দুরা বলেন, জ্ঞান-অর্থে আত্মজ্ঞান—তাঁহারা সেই আত্মজ্ঞানের আনন্দে বিভোর হইয়া থাকিতে চাহেন।” (পৃষ্ঠা ১২৩)

মতামত: ঠিকই তো বিজ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করে কী হবে? এই আত্মজ্ঞানে বলীয়ান হয়ে যে দেশে ৯৭ কোটি নরনারী ঠিক করে খেতে পান না, সে দেশে আমরা ১,৮০০ কোটি টাকার রাম মন্দির বানিয়ে গর্ববোধ করছি।  

https://bangla.hindustantimes.com/lifestyle/in-india-almost-97-crore-people-do-not-get-enough-to-eat-says-a-united-nations-report-31657435461727.html

২৮) “আপেল ভূমিতে কিরূপে পড়ে, অথবা বৈদ্যুতিক প্রবাহ কিরূপে স্নায়ুকে উত্তেজিত করে, যদি কেবল এইটুকু জানাই জীবনের একমাত্র কাজ হয়, তবে তো আমি এখনই আত্মহত্যা করি। আমার সংকল্প—সর্বকিছুর মর্মস্থল অনুসন্ধান করিব—জীবনের প্রকৃত রহস্য কি, তাহা জানিব। তোমরা প্রাণের ভিন্ন ভিন্ন বিকাশের আলোচনা কর, আমি প্রাণের স্বরূপ জানিতে চাই; আমার ‘দর্শন’ বলে—জগৎ ও জীবনের সমুদয় রহস্যই জানিতে হইবে—স্বর্গ নরক প্রভৃতি কুসংস্কার দূর করিয়া দিতে হইবে, যদিও এই পৃথিবীর মত ঐগুলির ব্যাবহারিক সত্তা আছে। আমি এই আত্মার অন্তরাত্মাকে জানিব—উহার প্রকৃত স্বরূপ জানিব—উহা কি, তাহা জানিব; শুধু উহা কিভাবে কাজ করিতেছে এবং উহার প্রকাশ কি, সেটুকু জানিলেই আমার তৃপ্তি হইবে না। আমি সকল জিনিষের ‘কেন’ জানিতে চাই; ‘কেমন করিয়া হয়’—এ অনুসন্ধান বালকেরা করুক।” (পৃষ্ঠা ১২৪)

মতামত: বিজ্ঞান শিক্ষা বা বিজ্ঞান সচেতন মনন গড়ে তোলার বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি স্বামীজীর। 

সত্যিই তো বিজ্ঞান আর কী পারে? একটা মারণ রোগের ওষুধ আবিষ্কার করে কোটি কোটি মানুষকে বাঁচাতে পারে কিন্তু এসব নিয়ে কোনো সদর্থক চিন্তাভাবনা নেই স্বামীজীর।

২৯) “তোমরা দেখিয়াছ, ক্রমবিকাশবাদের প্রমাণ কেবল এইঃ নিম্নতম হইতে উচ্চতম প্রাণী পর্যন্ত সকল দেহই পরস্পর সদৃশ; কিন্তু উহা হইতে তুমি কি করিয়া সিদ্ধান্ত কর যে, নিম্নতম প্রাণী হইতে ক্রমশঃ উচ্চতর প্রাণী জন্মিয়াছে এবং উচ্চতম হইতে ক্রমশঃ নিম্নতর জন্মে নাই? দুদিকেই যুক্তি সমান—আর যদি এই মতবাদে বাস্তবিক কিছু সত্য থাকে, তবে আমার বিশ্বাস এই যে, একবার নিম্ন হইতে উচ্চে, আবার উচ্চ হইতে নিম্নে যাইতেছে—ক্রমাগত এই দেহশ্রেণীর আবর্তন হইতেছে।” (পৃষ্ঠা ১৫৩)

মতামত: বক্তব্যটা পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক আর স্বামীজীর বিশ্বাসের ওপর বিজ্ঞান নির্ভর করে না।

৩০) “প্রাচীন ঋষিগণের নিকট বিশ্বপ্রকৃতি কথা বলিত; পশুপক্ষী—চন্দ্রসূর্য তাঁহাদের সহিত কথা বলিত। তাঁহারা একটু একটু করিয়া সকল জিনিষ অনুভব করিতে লাগিলেন, প্রকৃতির অন্তস্তলে প্রবেশ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা চিন্তা দ্বারা বা বিচার দ্বারা উহা লাভ করেন নাই, কিংবা আধুনিক কালের প্রথা অনুযায়ী অপরের মস্তিষ্কপ্রসূত কতকগুলি বিষয় সংগ্রহ করিয়া একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন নাই, অথবা আমি যেমন তাঁহাদেরই একখানি গ্রন্থ লইয়া সুদীর্ঘ বক্তৃতা করিয়া থাকি, তাহাও করেন নাই; তাঁহাদিগকে সত্য আবিষ্কার করিতে হইয়াছিল।” (পৃষ্ঠা ১৮৮)

মতামত: গল্পের গোরুকে গাছে তুলতে গিয়ে স্বামীজী পশু, পক্ষী, চাঁদ, সূর্যের ভোকাল কর্ড (স্বরতন্ত্রী) পর্যন্ত বানিয়ে ফেললেন।

৩১) “ভগবানকে ‘পিতা’ বলা অপেক্ষা উচ্চতর ভাব আছে; সাধকেরা তাঁহাকে ‘মাতা’ বলিয়া থাকেন। তাহা অপেক্ষাও উচ্চতর ভাব আছে—তাঁহাকে ‘প্রিয়সখা’ বলা। সর্বাপেক্ষা উচ্চ ভাব—তাঁহাকে ‘আমার প্রেমাস্পদ’ বলা।” (পৃষ্ঠা ১৯৬)

একটু আগেই আবার স্বামীজী বললেন “ভগবানকে পিতা মাতা ভ্রাতা বা প্রিয় বন্ধু বলিলে তাঁহাকে ‘বিষয়ীভূত’ করিতে হয়—তাঁহাকে বাহিরে আনিয়া দেখিতে হয়, তাহা তো কখনও হইতে পারে না। তিনি সকল বিষয়ের (object) অনন্ত বিষয়ী (subject)।” (পৃষ্ঠা ৭৩)

দুটি কথা সম্পূর্ণভাবে পরস্পর বিরোধী।

৩২) “অনেক লোক হয়তো এক সময়ে ভাবিত, মাটিতে যাহা কিছু পড়ে, তাহা ভূতেই ফেলিতেছে, কিন্তু মাধ্যাকর্ষণই ইহার যথার্থ ব্যাখ্যা; আর যদিও আমরা জানি, ইহা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা নহে, তথাপি ইহা অপর ব্যাখ্যা হইতে যে অনেক ভাল তাহা নিশ্চয়; কারণ একটি ব্যাখ্যা বস্তুর বহিঃস্থ কারণ হইতে, অন্যটি বস্তুর স্বভাব হইতে লব্ধ। এইরূপ আমাদের সমুদয় জ্ঞানের সম্বন্ধেই। যে-কোন ব্যাখ্যা বস্তুর প্রকৃতি হইতে লব্ধ, তাহা বৈজ্ঞানিক; আর যে-কোন ব্যাখ্যা বস্তুর বহির্দেশ হইতে লব্ধ, তাহা অবৈজ্ঞানিক।” (পৃষ্ঠা ১৯৯)

মতামত: প্রতিবারের মতোই স্বামীজী কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে ভুল প্রমাণ করার আগে কোনো প্রমাণ, সাক্ষ্য বা দলিলকে সামনে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন না।

৩৩) “বাইবেল ও কোরানে যখন বিবাদ, তখন উভয়ের মধ্যে কেহই মধ্যস্থ হইতে পারে না। কোন স্বতন্ত্র ব্যক্তি মীমাংসক হইলেই ভাল হয়। কোন গ্রন্থ মীমাংসক হইতে পারে না, সার্বভৌম কোন-কিছুর দ্বারাই মীমাংসা হওয়া চাই। যুক্তি অপেক্ষা সার্বভৌম আর কি আছে? কেহ কেহ বলেন, যুক্তি সকল সময়ে সত্যানুসন্ধানে সমর্থ নহে। অনেক সময় যুক্তি ভুল করে বলিয়া এই সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে, কোন পুরোহিত-সম্প্রদায়ের শাসনে বিশ্বাস করিতে হইবে। … আমি কিন্তু বলি, যুক্তি যদি দুর্বল হয়, তবে পুরোহিত-সম্প্রদায় আরও দুর্বল, আমি তাঁহাদের কথা না শুনিয়া যুক্তিই শুনিব, কারণ যুক্তিতে যতই দোষ থাকুক, উহাতে কিছু সত্য পাইবার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু অন্য উপায়ে সত্যলাভের কোন আশা নাই।” (পৃষ্ঠা ২০৪)

অথচ উনি নিজেই বলেছেন “মনকে আবার বৃথা তর্কের দ্বারা চঞ্চল করা উচিত নহে। কারণ পরমার্থতত্ত্ব তর্কের বিষয় নহে, প্রত্যক্ষের বিষয়। আমরা বরাবর শুনিয়া আসিতেছি, প্রত্যেক ধর্মই বিশ্বাসের উপর খুব জোর দেয়। আমরা অন্ধবিশ্বাস করিতে শিক্ষা পাইয়াছি। অবশ্য এই অন্ধবিশ্বাস যে মন্দ জিনিষ, তাহাতে কোন সংশয় নাই, কিন্তু এই অন্ধবিশ্বাস ব্যাপারটিকে একটু তলাইয়া দেখিলে বুঝিব, ইহার পশ্চাতে একটি মহান‍্ সত্য আছে। যাহারা অন্ধবিশ্বাসের কথা বলে, তাহাদের বাস্তবিক উদ্দেশ্য এই ‘অপরোক্ষানুভুতি’—আমরা এখন ইহার আলোচনা করিতেছি। মনকে বৃথা তর্কের দ্বারা চঞ্চল করিলে চলিবে না, কারণ তর্কদ্বারা কখনও ঈশ্বরলাভ হয় না। ঈশ্বর প্রত্যক্ষের বিষয়, তর্কের বিষয় নহেন। সমুদয় যুক্তি ও তর্কই কতকগুলি অনুভূতির উপর স্থাপিত। এইগুলি ব্যতীত তর্ক হইতেই পারে না।” (পৃষ্ঠা ১৪২)

দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে পরস্পর বিরোধী। তর্ক করবো নাকি করবো না, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

৩৪) “আমরা সকলেই একটি জীবাণুকোষ হইতে উৎপন্ন হইয়াছি, আর আমাদের যাহা কিছু শক্তি আছে, তাহা ঐ জীবাণুকোষেই কুণ্ডলীকৃত হইয়া ছিল। তোমরা বলিতে পার না, উহা খাদ্য হইতে প্রাপ্ত; রাশীকৃত খাদ্য লইয়া খাদ্যের এক পর্বত প্রস্তুত কর, দেখ তাহা হইতে কি শক্তি বাহির হয়! আমাদের ভিতর শক্তি পূর্ব হইতেই নিহিত ছিল—অব্যক্তভাবে, কিন্তু ছিল নিশ্চয়ই।” (পৃষ্ঠা ২০৭)

মতামত: আরো একবার নিজের মনগড়া কু-যুক্তি দিয়ে ক্রমবিকাশবাদের সমালোচনা কারণ ক্রমবিকাশবাদকে মান্যতা দিলে ওঁর অভ্রান্ত “বেদান্তবাদ” তাসের ঘরের মতো লুটিয়ে পড়ত।

৩৫) “পূর্ববর্তী মতবাদগুলির সমন্বয়-সাধন করাই অদ্বৈতবেদান্তের অন্যতম বিশেষত্ব। অনেক সময় এই সমন্বয় দ্বারা এই দর্শনের অনেক উপকার হইয়াছিল, কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতিও হইয়াছে। বর্তমান কালে ক্রমবিকাশবাদীদের যে মত, আমাদের প্রাচীন দার্শনিকগণ তাহা জানিতেন, তাঁহারা বুঝিতেন, দর্শন-চিন্তাও ধীরে ধীরে গড়িয়া ওঠে। এই কারণেই পূর্ব পূর্ব দর্শনপ্রণালীর মধ্যে একটি সামঞ্জস্য বিধান করা তাঁহাদের পক্ষে সহজ হইয়াছিল। কোন ভাবই পরিত্যক্ত হয় নাই।” (পৃষ্ঠা ২১২)

মতামত: যে কোনো উপায়ে বিজ্ঞানের ওপর অদ্বৈতবাদকে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা।

৩৬) “এক ব্যক্তি যে অপর ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাহাও হয়তো নিজের সন্তানের প্রতি স্নেহের প্রেরণায়—তাহাদিগকে ভরণপোষণ করিবে বলিয়া। তাহার প্রেম অন্য লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি হইতে প্রত্যাহৃত হইয়া ঐ একটি শিশু-সন্তানের উপর পড়িয়া সসীম ভাব ধারণ করিয়াছে। কিন্তু সীমাবদ্ধই হউক, অসীমই হউক, ভালবাসা সেই ভগবান্‌, অন্য কিছুই নহে।” (পৃষ্ঠা ২১৮)

মতামত: ভাগ্যিস ভারতীয় সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ, নয়তো স্বামীজীর যুক্তি অনুযায়ী সব খুনি, ধর্ষকরা নিজেদের বেদান্তবাদী আর বাড়িতে সন্তান আছে এই অজুহাত দেখিয়ে আইনের হাত থেকে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াত।

৩৭) “জ্ঞানই উপাসনা। আমরা যতই জ্ঞানলাভ করিতে পারি, ততই আমাদের মঙ্গল।” (পৃষ্ঠা ২১৯)

আবার একটু আগে নিজেই বললেন “তুমি কি অপরের জন্য প্রাণে প্রাণে অনুভব করিতেছ? যদি কর, তবে তোমার হৃদয়ে একত্বের ভাব বর্ধিত হইতেছে। যদি না কর, তবে তুমি একজন বড় বুদ্ধিজীবী হইতে পার, কিন্তু তোমার কিছুই হইবে না—কেবল শুষ্ক বুদ্ধিবাদী হইয়াই থাকিবে। আর যদি তোমার হৃদয় থাকে, তবে একখানি বই পড়িতে না পারিলেও, কোন ভাষা না জানিলেও তুমি ঠিক পথে চলিতেছ। ঈশ্বর তোমার সহায় হইবেন।” (পৃষ্ঠা ১৮০)

দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে পরস্পর বিরোধী। কোনটা মেনে চলবো? 

৩৮) “সত্যই সকল আত্মার যথার্থ স্বরূপ। সত্যের উপর কে বিশেষ দাবী করিতে পারে? কিন্তু উহাকে কার্যে পরিণত করিতে হইবে, সরলভাবে উহা প্রচার করিতে হইবে, কারণ তোমরা দেখিবে—উচ্চতম সত্য অতি সহজ ও সরল। খুব সহজ ও সরলভাবে উহা প্রচার করিতে হইবে, যাহাতে ঐ ভাব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবিষ্ট হয়, যাহাতে উহা উচ্চতম মস্তিষ্ক হইতে আরম্ভ করিয়া অতি সাধারণ মনেরও অধিকারের বিষয় হইতে পারে, যাহাতে আবালবৃদ্ধবনিতা একই কালে উহা বুঝিতে পারে। এই-সকল ন্যায়ের কূটবিচার, দার্শনিক মতবাদ, এই-সকল দেবতাতত্ত্ব ও ক্রিয়াকাণ্ড একসময়ে উপকার করিয়া থাকিতে পারে, কিন্তু এস আমরা একমনে ধর্মকে সহজ করিবার চেষ্টা করি, আর সেই সত্যযুগ আনিবার সহায়তা করি, যখন প্রত্যেকটি মানুষ উপাসক হইবে, আর প্রত্যেক মানুষের অন্তর্নিহিত প্রকৃত সত্তা—সেই সৎস্বরূপই উপাস্য হইবেন।” (পৃষ্ঠা ২২১)

মতামত: স্বামীজী একটু আগেই বলেছেন “সত্যযুগ বলিয়া যে-যুগের বর্ণনা করিয়াছেন—যখন মানুষের ইচ্ছামৃত্যু ছিল, তখন মানুষ যতদিন ইচ্ছা শরীর রক্ষা করিতে পারিত” (পৃষ্ঠা ১৭)

সামনে সত্যযুগ, ইচ্ছামৃত্যুর গাজর ঝুলিয়ে ধর্মপ্রচার করার আবেদন; ভাগ্যিস লণ্ডনবাসী এসবে বিশেষ গুরুত্ব দেননি তাই ওই দেশ জ্ঞান বিজ্ঞানে বহু অংশে এগিয়ে গেছে। 

আর আজকের দিনের ফেসবুক বা ইউটিউব কনটেন্ট ক্রিয়েটররা যেভাবে শেয়ার করতে বলেন, তাঁদের সাথে স্বামীজীর এই বক্তব্যের কোনো পার্থক্য দেখি না।

৩৯) “জ্যোতির্বিদ্যা পাঠের সুবিধার জন্য তোমাদের মনে করিতে বলা হয়, সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরিতেছে, যদিও তাহা সত্য নহে।” (পৃষ্ঠা ২৪০)

মতামত: স্বামীজী জ্যোতির্বিদ্যা আর জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতেন না। জ্যোতির্বিদ্যাতে সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে, এমন মনে করতে বলা হবে কেন? 

৪০) “ন্যায়দর্শন-প্রণেতারা পুনর্জন্ম-তত্ত্বের সমর্থনে যে-যুক্তিটি বহুবার উপস্থিত করিয়াছেন এবং যাহা আমাদের দৃষ্টিতে এই প্রসঙ্গের সিদ্ধান্ত বলিয়া মনে হয়, তাহা হইল এই যে, আমাদের অভিজ্ঞতা কখনও সম্পূর্ণ বিলীন হয় না। আমাদের কার্যকলাপ (কর্ম) যদিও বাহ্যতঃ বিলুপ্ত হয়, তথাপি ‘অদৃষ্ট’রূপে বর্তমান থাকে, এবং পুনর্বার কার্যের মধ্যে প্রবৃত্তির আকারে আবির্ভূত হয়, এমন কি ছোট শিশুরাও কতকগুলি প্রবৃত্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করে, যথা মৃত্যুভয়।” (পৃষ্ঠা ২৫৬)

মতামত: অবশ্যই শিশুরা কিছু স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু ছোট শিশুদের মধ্যে মৃত্যুভয় থাকে না।

https://www.stanfordchildrens.org/en/topic/default?id=a-childs-concept-of-death-90-P03044

৪১) “পুনর্জন্মবাদ আমাদের নিকট অসীম গুরুত্ব লইয়া উপস্থিত হয়, কারণ আত্মার পুনর্জন্ম ও দেহ-কোষ অবলম্বনে প্রবৃত্তির সঞ্চারণ-বিষয়ে যে বিবাদ চলিতেছে, তাহা প্রকৃতপক্ষে অধ্যাত্মবাদ ও জড়বাদের সংগ্রাম। যদি কোষের মাধ্যমে সঞ্চারণই সন্তোষজনক ব্যাখ্যা হয়, তাহা হইলে জড়বাদ অনিবার্য, এবং তখন আত্মতত্ত্বের কোন প্রয়োজন থাকে না। ইহা যদি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না হয়, তাহা হইলে প্রত্যেক আত্মার একটি নিজস্ব সত্তা আছে এবং আত্মা তাহার বর্তমান জীবনে অতীতের অভিজ্ঞতা বহন করিয়া আনে—এই মতটি সম্পূর্ণ সত্য। এই দুই বিকল্প—পুনর্জন্মবাদ ও জড়বাদ; এই উভয়ের মধ্যে আর কোন কিছুর স্থান নাই। ইহার কোন্‌টি আমরা গ্রহণ করিব?” (পৃষ্ঠা ২৫৭)

এটা পড়ে আমরা বুঝতে পারছি বংশাণুবিজ্ঞান (Genetics) নিয়ে স্বামীজীর কোনো ধারণা ছিল না, যদিও উনি যে সময় দাঁড়িয়ে এটা বলেছিলেন, তখন সবে এই বিজ্ঞান নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে; তাই ওঁর এই বিষয়ে অজ্ঞতা নিয়ে কারো কোনো সমালোচনা থাকা উচিত নয় কিন্তু সব সমস্যার একটাই সমাধান “বেদান্তবাদ” – স্বামীজীর এই চিন্তাটাও প্রচণ্ড রক্ষণশীল এবং অবৈজ্ঞানিক। এটা সম্বন্ধে উনি আগেও একটা মতামত রেখেছেন “যতদিন না এই জড়বাদীরা প্রমাণ করিতে পারেন, কি করিয়া ঐ সংস্কার ঐ কোষে থাকিতে পারে, আর কোথায়ই বা থাকিতে পারে, যতদিন না তাঁহারা বুঝাইতে পারেন, এবং ‘মনোবৃত্তি শরীর-কোষে নিদ্রিত থাকে’, এই বাক্যেরই বা অর্থ কি, ততদিন তাঁহাদের সিদ্ধান্ত স্বীকার করিয়া লওয়া যাইতে পারে না। এ পর্যন্ত বেশ স্পষ্ট বুঝা গেল যে, এই সংস্কার মনেরই মধ্যে বাস করে, মনই জন্মজন্মান্তর গ্রহণ করিতে আসে; মনই আপন উপযোগী উপাদান গ্রহণ করে, আর যে মন বিশেষ প্রকার শরীর ধারণ করিবার উপযুক্ত কর্ম করিয়াছে, যতদিন পর্যন্ত না সে তাহা নির্মাণ করিবার উপযোগী উপাদান পাইতেছে, ততদিন তাহাকে অপেক্ষা করিতে হইবে। ইহা আমরা বুঝিতে পারি। অতএব আত্মার দেহ-গঠনের উপযোগী উপাদান প্রস্তুত করা পর্যন্তই বংশানুক্রমিক সঞ্চারবাদ স্বীকার করা যাইতে পারে। আত্মা কিন্তু জন্মান্তর গ্রহণ করেন—শরীরের পর শরীর নির্মাণ করেন; আর আমরা যে-কোন চিন্তা করি, যে-কোন কার্য করি, তাহাই সূক্ষ্মভাবে থাকিয়া যায়, আবার সময় হইলেই উহারা স্থূল ব্যক্তভাব ধারণ করিতে উন্মুখ হয়।” (পৃষ্ঠা ১০০)

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশন তাঁর এই অবৈজ্ঞানিক বক্তব্যটাকে অসার ও ভিত্তিহীন বলে স্বীকার করবে কী?

৪২) “বিজ্ঞানের কর্তব্য হইল উচ্চতর সামান্যীকরণের সাহায্যে জাগতিক ঘটনাগুলি ব্যাখ্যা করা। সুতরাং কোন ব্যাখ্যা-কালে যদি অপরাপর তথ্যের সহিত সামঞ্জস্য রক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যাখ্যার জন্য উপস্থাপিত নূতন তথ্যের কিয়দংশ নষ্ট করিয়া ফেলা হয়, তবে ঐ ব্যাখ্যা আর যাহা কিছুই হউক, বিজ্ঞান-নামধেয় হইতে পারে না।

অতএব যে ব্যাখ্যায় এই সদা-বিদ্যমান এবং সর্বদা-আবশ্যক মুক্তির ধারণাকে উপেক্ষা করা হয়, তাহা উপরি-উক্ত প্রকারে ভ্রান্ত, অর্থাৎ অপর তথ্যগুলি ব্যাখ্যা করিবার উদ্দেশ্যে উহা নূতন তথ্যের একাংশ অস্বীকার করে, সুতরাং উহা ভ্রান্ত। অতএব আমাদের প্রকৃতির সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া একমাত্র অপর বিকল্পটি স্বীকার করা চলে, তাহা এই যে—আমাদের মধ্যে এমন কিছু আছে, যাহা মুক্ত এবং নিত্য।” (পৃষ্ঠা ২৬০)

মতামত: স্বামীজী দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদকেও স্বীকৃতি দিতে রাজি কিন্তু বিজ্ঞানকে নয় কারণ এই দুটি মতবাদ অদ্বৈতবাদের সাথে একটা ব্যাপারে একমত আর সেটা হলো “আত্মা”-র অস্তিত্ব। যুক্তিবাদের দৃষ্টিতে স্বামীজীর এই বক্তব্য পুরোপুরিভাবে লজিক্যাল ফ্যালাসি।

৪৩) “এই বিশ্ব যেমন অনাদি এবং অনন্ত, ঈশ্বরও তাই। তাহাই হওয়া উচিত, কারণ আমরা যদি বলি যে, এমন এক সময় ছিল, যখন স্থূল বা সূক্ষ্ম কোন আকারেই কোন সৃষ্টি ছিল না। তাহা হইলে বলিতে হয়, তখন কোন ঈশ্বরও ছিল না, কারণ ঈশ্বর আমাদের নিকট এই বিশ্বের সাক্ষিরূপেই বিদিত। কাজেই বিশ্ব যখন ছিল না, তখন তিনিও ছিলেন না। একটি ধারণা হইতেই অপরটি আসে। কার্যের ধারণা হইতেই আমরা কারণের ধারণা লাভ করি। কার্য যদি না থাকে, তাহা হইলে কারণও থাকিতে পারে না। কাজেই ইহা স্বভাবতই ধারণা করা যায়—বিশ্ব যেহেতু শাশ্বত, ঈশ্বরও শাশ্বত।” (পৃষ্ঠা ২৬৫)

মতামত: আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করে দিয়েছে এই বিশ্ব শাশ্বত নয়, বিশ্বের বয়স ৪৫৪.৩ কোটি বছর। তাহলে স্বামীজীর শাশ্বত ঈশ্বরের দাবীটা এখন বৈধ নয়।

https://education.nationalgeographic.org/resource/resource-library-age-earth/

https://www.shongshoy.com/%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%97-%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%82-%e0%a6%a5%e0%a7%87%e0%a6%95%e0%a7%87-%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%ac/#i-6

৪৪) “মন জড়ে রূপান্তরিত হয়, আবার জড়ও মনে রূপান্তরিত হয়, ইহা শুধু কম্পনের তারতম্য।

একটি ইস্পাতের পাত লও, উহাকে কম্পিত করিতে পারে—এইরূপ একটি শক্তি ইহাতে প্রয়োগ কর; তারপর কি ঘটিবে? যদি একটি অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, তবে প্রথম তুমি শুনিতে পাইবে একটি শব্দ—একটি গুনগুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত কর, দেখিবে ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হইয়া উঠিয়াছে। শক্তি আরও বর্ধিত কর, ইস্পাতের দণ্ডটি আলোকময় হইয়া উঠিয়াছে। শক্তি আরও বর্ধিত কর, ইস্পাতটি একেবারে অদৃশ্য হইয়া যাইবে। উহা মনে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছে।” (পৃষ্ঠা ২৬৮)

মতামত: অন্ধকার ঘরে ইস্পাত দণ্ডটি আলোকময় হলো আবার অদৃশ্যও হয়ে গেল আর তার থেকে মন জড়ে রূপান্তরিত হয়, সেটাও প্রমাণ হয়ে গেল? আসলে ওঁর লেখাগুলো মুক্তমনে যদি খুঁটিয়ে পড়া যায় তাহলে ওঁর প্রতিটি বিজ্ঞান ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকবে। বাস্তবে প্রতিটি ধর্ম ব্যবসায়ী এভাবেই কিছু বিজ্ঞান বিষয়ক শব্দাবলী ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানায়, এটাকে pseudoscience বলে।

ছদ্মবিজ্ঞান বা pseudoscience এমনই একটি দাবি, বিশ্বাস বা অনুশীলন যা বিজ্ঞান হিসাবে উপস্থাপিত হয় কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে না। যদি গবেষণার কোনও বিষয়কে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মানদণ্ড অনুসারে উপস্থাপন করা হয় তবে এটি এই মানদণ্ডগুলি অনুসরণ করে না।

৪৫) “আর একটি উদাহরণ লওঃ দশদিন আহার না করিলে আমি কোনপ্রকার চিন্তা করিতে পারি না। শুধু কয়েকটি এলোমেলো চিন্তা আমার মনে থাকিবে। আমি অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িব এবং সম্ভবতঃ আমার নামও ভুলিয়া যাইব। তারপর কিছু খাদ্য গ্রহণ করিলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যে চিন্তা করিতে আরম্ভ করিব; আমার মনের শক্তি ফিরিয়া আসিয়াছে। খাদ্যই মনে রূপান্তরিত হইয়াছে।” (পৃষ্ঠা ২৬৯)

মতামত: প্রতিটি ছত্রে ছত্রে অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা; খাদ্য শক্তিতে রূপান্তরিত হলো না, খাদ্য সরাসরি মনে রূপান্তরিত হয়ে গেল।

https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK26882/

৪৬) “তাহা হইলে ঈশ্বর, পূজা-অর্চনা প্রভৃতির কি হইবে? এগুলিরও প্রয়োজন আছে। আমি নিজেকে ঈশ্বর ও আমি—এই দুই অংশে ভাগ করিয়াছি; আমিই পূজিত হই এবং নিজেকে পূজা করি। কেন করিব না? ঈশ্বরই তো আমি। আমার আত্মাকে কেন পূজা করিব না? সর্বেশ্বর ভগবান্‌ যিনি, তিনি তো আমার আত্মাও। সবই খেলা, সবই কৌতুক; আর কোন উদ্দেশ্য নাই।

জীবনের পরিণাম ও লক্ষ্য কি? কিছুই না, কারণ আমি জানি—আমিই সেই অসীম। তোমরা যদি ভিক্ষুক হও, তোমাদের লক্ষ্য থাকিতে পারে। আমার কোন লক্ষ্য নাই, কোন অভাব নাই, কোন উদ্দেশ্য নাই। আমি তোমাদের দেশে আসিয়াছি, বক্তৃতা করিতেছি—নিছক মজার খেলা, আর কোন অর্থ নাই। কি অর্থই বা থাকিতে পারে?” (পৃষ্ঠা ২৮৪)

মতামত: দ্বৈতবাদের এত সমালোচনা করেও অবশেষে আমাদের দেশের পুরুতমশাইদের পেট চালানোর ব্যবস্থাটাকেও রেখে দিয়ে গেলেন। এর চেয়ে বড় দ্বিচারিতা আর কী হতে পারে?

স্বামীজী ঠিকই বলেছেন ভিক্ষুক হলে দিনের শেষে একটু খাবারের লক্ষ্য থাকবে বৈকি; একজন শ্রমিক সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও পরিবারের মুখে দু’বেলা পেট ভর্তি খাবার তুলে দিতে পারেন না কিন্তু ওঁর জীবনের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কোনো কাজ না করে, কোনোরকম পরিশ্রম না করে কী সুন্দর “ঠাকুর খেলা” নিয়ে শান্তিতে দিন কাটিয়েছেন, এমনকি ভক্তদের টাকায় একাধিকবার বিদেশেও গেছেন আর ওঁর দেখানো পথে ওঁর গুরুভাইয়েরা আজও সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করে চলেছেন।  

আসলে এই পোড়া দেশে একমাত্র এই বাবাজীরাই কোনোরকম কাজ না করে ভক্তদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে বেশ সুখে শান্তিতে নির্গুণ ব্রহ্ম নিয়ে দিন কাটানোর সুযোগ পান।

৪৭) “একজন শিক্ষিত লোকের অবস্থা দেখ।

‘লোকে বলে এরূপ, লোকে বলে ওরূপ। …’

‘বন্ধু, আপনি কি বলেন?’

‘আমি কিছুই বলি না।’

তিনি শুধু উদ্ধৃত করেন অন্যের চিন্তা; কিন্তু নিজে কিছুই করেন না। এই যদি শিক্ষা হয়, তাহা হইলে পাগলামি আর কাহাকে বলে? যাঁহারা গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন, তাঁহাদের দিকে চাও! … এই-সব আধুনিক লেখকগণ—দুইটি বাক্যও তাঁহাদের নিজেদের নয়! সবই উদ্ধৃতি! …” (পৃষ্ঠা ২৮৬)

মতামত: স্বামীজী তাঁর ভক্তদের আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে নির্গুণ ব্রহ্মের খোঁজ নিয়ে ব্যস্ত রাখতে বিশেষ আগ্রহী।    

৪৮) “সে এক মুঠা অন্ন, একটু শ্বাস-প্রশ্বাস, পোষাক-পরিচ্ছদ, দেশপ্রেম, দেশ, নাম ও যশের দাস। এই ভাবে সে দাসত্বের মধ্যে বাস করে এবং দাসত্ব-হেতু তাহার প্রকৃত স্বরূপ চাপা পড়িয়া যায়। তুমি যাহাকে মানুষ বল, সে একটি ক্রীতদাস।” (পৃষ্ঠা ৩০০)

“যোগীরা বলেন, যোগী ব্যতীত আর সকলেই দাসবৎ—খাদ্যের দাস, বায়ুর দাস, নিজ স্ত্রীর দাস, নিজ পুত্রকন্যার দাস, টাকার দাস, স্বদেশীয়দের দাস, নামযশের দাস, এবং এই জগতের সহস্র সহস্র বিষয়ের দাস! যে ব্যক্তি এইসব বন্ধনের কোনটিতে আবদ্ধ নন, তিনিই যথার্থ মানুষ, যথার্থ যোগী।” (পৃষ্ঠা ৩৫৬)

মতামত: দেশপ্রেম, স্বদেশী আন্দোলনকেকেও ক্রীতদাসের স্বরূপ বলে চিহ্নিত করেছেন স্বয়ং স্বামীজী। এরপরেও বহু বামপন্থী আজও স্বামীজীর মধ্যে দেশপ্রেমী সত্ত্বা খুঁজে পান!

৪৯) “পক্ষান্তরে শুধু বুদ্ধিবৃত্তির চরম অনুশীলনের ফলে কত ধর্মহীন জীবন গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহা কি তোমরা লক্ষ্য কর নাই? ইহা তোমাদের পাশ্চাত্য সভ্যতার একটি দোষ যে, তোমরা কেবল বুদ্ধির উন্মেষকারী শিক্ষার পশ্চাতে ধাবিত; হৃদয়বৃত্তির দিকে তোমরা তাকাও না। শুধু বুদ্ধিবৃত্তি মানুষকে দশগুণ অধিক স্বার্থপর করিয়া তোলে; এবং এইরূপেই তোমাদের ধ্বংস হইবে।” (পৃষ্ঠা ৩০১)

মতামত: জ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার ফলেই আমেরিকা আজ প্রথম বিশ্বের দেশ হিসেবে পরিগণিত হয় আর আমরা মন দিয়ে বেদান্ত চর্চার ফলে সেই তৃতীয় বিশ্বের দেশ হয়েই রয়ে গেলাম। 

স্বামীজীর ভবিষ্যৎবাণী এখন অবধি বাস্তবে রূপায়িত হয়নি, অদূর ভবিষ্যতে তা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না।

৫০) “যাঁহারা কখনও দূরবীক্ষণযন্ত্র অণুবীক্ষণযন্ত্র অথবা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার দেখেন নাই, তাঁহারাই যুগ-যুগান্তর পূর্বে পরমাণু সম্বন্ধে, অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব সম্বন্ধে এবং মানুষের অতি সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্বন্ধে মহাসত্যসমূহ আবিষ্কার করিয়াছিলেন। তাঁহারা এই-সকল বিষয় কিরূপে জানিয়াছিলেন? হৃদয়বৃত্তির সাহায্যেই জানিয়াছিলেন। তাঁহারা হৃদয়কে নির্মল করিয়াছিলেন। বর্তমানেও আমরা ইহা করিতে পারি—পথ আমাদের জন্য প্রশস্তই রহিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন নয়, হৃদয়বৃত্তির অনুশীলনই বিশ্বের দুঃখ-দৈন্য হ্রাস করিতে পারে।

বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলনের দ্বারা শত শত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইয়াছে; ইহার পরিমাণ এই যে, মুষ্টিমেয় লোক বহু লোককে ক্রীতদাসে পরিণত করিয়াছে।” (পৃষ্ঠা ৩০৩)

“এই-সব কলকারখানা ও জড়বিজ্ঞানের মূল্য কি? উহাদের একটি মাত্র ফল এই যে, উহারা জ্ঞান বিস্তার করিয়া থাকে। আপনারা অভাব বা দারিদ্র্য-সমস্যা পূরণ করিতে পারেন নাই, বরং অভাবের মাত্রা আরও বাড়াইয়াছেন। কলকব্জা দ্বারা কখনও দারিদ্র্য-সমস্যার সমাধান হইতে পারে না।” (পৃষ্ঠা ৩৫৯)

মতামত: বিশ্বের সার্বিক উন্নয়নে বিজ্ঞানের ভূমিকা অপরিসীম, এই বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে মানুষকে কৃষি বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব সংঘটিত করেছে; মহাকাশে পাড়ি দিয়েছে; চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে, মানুষ মারণ রোগ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে কিন্তু এই জ্ঞান বিজ্ঞান যে ধর্ম বিষয়ক অবান্তর চিন্তাভাবনাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না, তাই বুদ্ধিবৃত্তির ওপর এত ক্ষোভ!

এরপরেও রামকৃষ্ণ মিশনে যে কেন বিজ্ঞান পড়ানো হয়, সেটাই বোধগম্য হয় না।

৫১) “আমরা ঈশ্বরকে ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করিতে পারি না। কেহই চক্ষুর দ্বারা ঈশ্বর দর্শন করে নাই, কখনও করিবেও না।” (পৃষ্ঠা ৩০৩)

মতামত: তাহলে অবশ্যই রামকৃষ্ণদেবও দেখেননি। স্বামীজী নিজেই মেনে নিলেন যে রামকৃষ্ণ মিশনে পাঠ্য “শিশুদের রামকৃষ্ণ” বইতে মিথ্যা কথা লেখা আছে!

https://www.youtube.com/watch?v=2sr8X5bQQ8o

৫২) “চরম একত্বকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করিতে পারিলেই জড়বিজ্ঞান লক্ষ্যে উপনীত হয়। একত্বে পৌঁছিলেই আমাদের বিশ্রাম। জ্ঞানই চরম অবস্থা।

সকল বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ ধর্মবিজ্ঞান বহুপূর্বেই সেই একত্ব আবিষ্কার করিয়াছে, সেই একত্বে—অদ্বৈত-তত্ত্বে উপনীত হওয়াই জ্ঞানযোগের লক্ষ্য।” (পৃষ্ঠা ৩১৬)

মতামত: এতক্ষণ বিজ্ঞানের সব আবিষ্কারকে বেদ, বেদান্ত, প্রাচীন ঋষিদের আবিষ্কার বলে চালানো হচ্ছিল, হঠাৎ করে ধর্মই বিজ্ঞান হয়ে গেল! 

উনি পরেও বলেছেন “যে-বিজ্ঞান মানুষের অতীন্দ্রিয় সত্তার মধ্য দিয়া প্রকৃতির অতীত সত্তাকে বুঝিতে চায়, তাহাকেই ‘ধর্ম’ বলে।” (পৃষ্ঠা ৩২৩) 

আসলে এগুলোকেই বলে ছদ্মবিজ্ঞান বা pseudoscience (দেখুন ৪৪)।

৫৩) “পদার্থবিজ্ঞান উভয় দিকেই অতীন্দ্রিয়বিদ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ। যুক্তি সম্বন্ধেও ঠিক তাই—ইহার আরম্ভ অ-যুক্তিতে, সমাপ্তিও অ-যুক্তিতে।” (পৃষ্ঠা ৩২৩)

মতামত: আসলে এইসব “অতীন্দ্রিয়বিদ্যা”, “ধর্মবিজ্ঞান” এগুলো সবটাই বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, আজও সেভাবেই আছে, এর সাথে প্রকৃত বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই সেজন্যই বারংবার কিছু বিজ্ঞানে ব্যবহৃত শব্দাবলীর সাহায্য নিয়ে মানুষের যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞান সচেতনাকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছেন।

এটাকে ছদ্মবিজ্ঞান বা pseudoscience বলে।

৫৪) “ভারতে সঙ্কীর্ণতা ছিল—সামাজিক প্রণালীতে। এখানে (ইংলণ্ডে) সমাজ খুব স্বাধীন। ভারতে সামাজিক বিষয়ে স্বাধীনতা ছিল না, কিন্তু ধর্মমত সম্বন্ধে ছিল। এখানে লোকে পোষাক যেরূপ পরুক না কেন, কিংবা যাহা ইচ্ছা করুক না কেন, কেহ কিছু বলে না বা আপত্তি করে না; কিন্তু চার্চে একদিন যাওয়া বন্ধ হইলেই নানা কথা উঠে। এখানে সত্য চিন্তা করিবার সময় মানুষকে হাজার বার ভাবিতে হয়, সমাজ কি বলে। অপর পক্ষে ভারতবর্ষে যদি একজন অপর জাতির হাতে খায়, অমনি সমাজ তাহাকে জাতিচ্যুত করিতে অগ্রসর হয়।” (পৃষ্ঠা ৫৬)

“এরূপ হওয়া খুব সম্ভব যে, আমি হয়তো দ্বৈতবাদী, আমার স্ত্রী অদ্বৈতবাদী। আমার কোন পুত্র ইচ্ছা করিলে খ্রীষ্ট, বুদ্ধ বা মহম্মদের উপাসক হইতে পারে, তিনিই তাহার ইষ্ট। অবশ্য তাহাকে জাতিগত সামাজিক নিয়ম প্রতিপালন করিতেই হইবে।” (পৃষ্ঠা ৩৫২)

“প্র। যোগীরা কি জাতিভেদকে একটা বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয় বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকেন?
উ। না; জাতিভেদ অপরিণত মনের শিক্ষালয়-মাত্র।” (পৃষ্ঠা ৩৫৬)

ওপরের উদ্ধৃতিগুলো পড়ে যাদের মনে হবে স্বামীজী কখনই “জাতিভেদ” প্রথার সমর্থক ছিলেন না, তাঁদের স্বামীজীর নিচের বক্তব্যটাকেও একটু খুঁটিয়ে পড়ার অনুরোধ করবো। বাস্তবে উনি সমাজের চিরাচরিত “জাতিভেদ” প্রথাকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারেই সচেষ্ট ছিলেন। 

“আমরাই কেবল একটা স্থায়ী জাতিবিভাগ গঠন করিতে সমর্থ হইয়াছি। অপরে উহার জন্য চেষ্টা করিতেছে, কিন্ত এখনও সফল হয় নাই। আমাদের সমাজে অবশ্য যথেষ্ট কুসংস্কার ও মন্দ জিনিষ আছে। আপনাদের দেশের কুসংস্কার ও মন্দ জিনিষগুলি আমাদের দেশে চালাইয়া দিতে পারিলেই কি সব ঠিক হইয়া যাইবে? জাতিভেদ আছে বলিয়াই এই ত্রিশ-কোটি লোক এখনও খাইবার জন্য এক টুকরা রুটি পাইতেছে। অবশ্য রীতিনীতি হিসাবে ইহা যে অসম্পূর্ণ, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এই জাতিবিভাগ না থাকিলে আজ আপনারা পড়িবার জন্য একখানিও সংস্কৃত বই পাইতেন না। এই জাতিবিভাগের দ্বারা এমন একটি দৃঢ় প্রাচীরের সৃষ্টি হইয়াছিল যে, জাতির উপর বহিরাক্রমণের শত প্রকার তরঙ্গাঘাত আসিয়া পড়িয়াছে, অথচ কোনমতেই উহাকে ভাঙিতে পারে নাই। এখনও সেই প্রয়োজন দূর হয় নাই, সেজন্য জাতিভেদ এখনও রহিয়াছে।” (পৃষ্ঠা ৩৫৮)

এখনও রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পুজোর আবশ্যিক শর্ত হিসাবে ব্রাহ্মণ বাড়ির অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা মেয়েকে পুজো করা হয়, যেটা আপাদমস্তক একটা বর্ণবাদী, পুরুষতান্ত্রিক প্রথা। 

লেখক

ধীমান সাও

You may also like...